বিজ্ঞাপন

১১৮৩ গ্রাহকের দেড় কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স

June 17, 2021 | 9:53 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: গাইবান্ধা জেলার ১ হাজার ১৮৩ জন গ্রাহকের বিমা দাবির ১ কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫১৫ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে। স্থাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিকের পারিবারিক কোম্পানি এটি। এই কোম্পানিরই এই গ্রাহকদের বিমা পলিসির মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। কিন্তু এখনো কোম্পানি থেকে গ্রহকদের পলিসির টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে না।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, বিমার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানি থেকে লভ্যাংশসহ পলিসির টাকা পরিশোধ না করায় কোম্পানিটির গাইবান্ধা জেলার মাঠ পর্যায়ের বিমা কর্মকর্তারা গ্রাহকের হাতে লাঞ্চিত হচ্ছেন। কেউ কেউ অপমান-লাঞ্ছনার ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। মাঠ পর্যায়ের এই বিমা কর্মকর্তারা বলতে গেলে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারছেন না।

বিমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) সূত্রে জানা গেছে, পলিসির মেয়াদ শেষের পরও টাকা পরিশোধ না করায় সম্প্রতি গাইবান্ধা জেলার মাঠ পর্যায়ের বিমা কর্মকর্তারা আইডিআরএ’র কাছে অভিযোগ করেছেন সানলাইফের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নুরুল ইসলাম, কোম্পানি সচিব রবিউল ইসলাম, অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আসলাম রেজা ও কোম্পানির রংপুর বিভাগীয় প্রধান মো. আবদুল খালেক বাদশার বিরুদ্ধে। বিমা নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির কাছে দাখিল করা লিখিত অভিযোগে বিমা গ্রাহকের টাকা আত্মসাৎ ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে।

আইডিআরএ‘র নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র শাকিল আখতার সারাবাংলাকে বলেন, সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে সারাদেশ থেকেই আমাদের কাছে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। এসব অভিযোগ আমরা খতিয়ে দেখছি এবং ঘটনা সত্যতা নিশ্চিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজ্ঞাপন

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গাইবান্ধা জেলার বিভিন্ন এলাকায় সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের ১ হাজার ১৮৩ জন বিমা গ্রাহক রয়েছেন। তাদের অধিকাংশই দরিদ্র জনগোষ্ঠীর। ২০০৪ সাল থেকে সান লাইফে ইনস্যুরেন্সের গণমুখী বিমা পলিসির আওতায় তারা বিমা পলিসি গ্রহণ করেন। এসব পলিসির মেয়াদ ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে শেষ হয়েছে। কিন্তু লভ্যাংশসহ পলিসির টাকা ফেরত পাচ্ছেন না তারা।

স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে, পলিসির টাকা ফেরত না পেয়ে গ্রাহকরা মাঠ পর্যায়ের বিমা গ্রহণকারী কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত তো বটেই, কোথাও কোথাও রীতিমতো মারধর করছেন। গ্রাহকদের নির্যাতন ও অপমান সহ্য করতে না পেরে বিমা গ্রহণকারী মাঠ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে আত্মগোপনে রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, গাইবান্ধা জেলার ১ হাজার ১৮৩ জন বিমা গ্রাহকের ১ কোটি ৩১ লাখ ৬১ হাজার ৫১৫ টাকা দীর্ঘ ছয় বছরেও পরিশোধ না করায় গত ১৩ জুন গাইবান্ধা জেলার মাঠ পর্যায়ের বিমা কর্মকর্তা (এপিডি  গাইবান্ধা) মো. বাবুল সরকার আইডিআরএ‘র কাছে একটি আবেদন করেন। আবেদনে তিনি সানলাইফের চেয়ারম্যান, এমডি, কোম্পানি সচিব, অতিরিক্ত এমডি ও রংপুর বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের বিমা পলিসির টাকা আত্মসাৎ, জালিয়াতি ও দুর্নীতির অভিযোগ আনেন। এই অভিযোগ তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এবং গ্রাহকের টাকা ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করার আবেদন করেন তিনি।

আইডিআরএ’র কাছে ওই আবেদনে মো. বাবুল সরকার ছাড়াও মাঠ পর্যায়ের আরও তিন জন কর্মকর্তা সই করেছেন। তারা হলেন— গাইবান্ধা জেলা কর্মকর্তা মো. মাসুদ মন্ডল, ব্লক কর্মকর্তা মো. আ. ছালেক ও মো. সামসুল হক।

জানতে চাইলে গাইবান্ধা জেলার সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাঠ পর্যায়ের বিমা কর্মকর্তা মাসুদ মন্ডল সারাবাংলাকে বলেন, সানলাইফের হয়ে আমরা হাজারেরও বেশি গ্রাহককে বিমা পলিসি করিয়েছি। এর মধ্যে ১১৮৩ জনের পলিসির মেয়াদ শেষ হয়েছে। কোম্পানির কাছে তাদের মোট পাওনা ১ কোটি ৩১ লাখ ৬২ হাজার ৫১৫ টাকা। কিন্তু গত ছয় বছরে একজন গ্রাহকও পলিসির একটি টাকাও পাননি। টাকা না পেয়ে এসব গ্রাহকরা আমাদের মতো যারা মাঠ পর্যায়ে বিমা কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন, তাদের ওপর ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন। আমাদের মাঠ পর্যায়ের বিমা কর্মকর্তাদের প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত করছেন। গ্রাহকদেরও তো কিছু বলতে পারি না। তারা বলেন— ‘আমরা কোম্পানির চেয়ারম্যান, এমডি চিনি না, তোমাদের কাছে বিমার টাকা দিয়েছি, তোমার আমাদের টাকা পরিশোধ করবে।’

মাসুদ মন্ডল আরও বলেন, বিমা গ্রাহকদের এই অত্যাচার নতুন না। দুই বছর আগে গাইবান্ধা জেলার সাদুল্লাপুর উপজেলার সুনিল চন্দ (৩৫) নামের এক ব্লক বিমা কর্মকর্তাকে পলিসির টাকার জন্য বাজারে আটকে মারধর করা হয়েছিল। ‍দুই দিন পর তিনি হার্ট অ্যাটাকে মারা যান। এছাড়া আমাদের দু’জন নারী কর্মকর্তাকে পলিসির টাকা ইস্যুতেই তালাক দেওয়া হয়েছে। আমরা পলিসিহোল্ডাদের ভয়ে রীতিমতো পালিয়ে বেড়াচ্ছি।

বিজ্ঞাপন

সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির বিরুদ্ধে ওঠা এসব অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে দেশের বিমা কোম্পানিগুলোর শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইএ) সভাপতি শেখ কবির হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, সারাদেশেই বিমা গ্রাহকরা সানলাইফে বিমা করে প্রতারিত হচ্ছেন। এ ব্যাপারে আইডিআরএ‘র উচিত সানলাইফের স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পদ বিক্রি করে পলিসিহোল্ডাদের টাকা পরিশোধ করে দেওয়া।

তিনি বলেন, আইডিআরএ’র কাছে আমরাও আবেদন করেছি যেন পলিসিহোল্ডাদের টাকা দ্রুত সময়ের মধ্যে পরিশোধ করে দেওয়া হয়। এই কোম্পানির অনেক সম্পদ রয়েছে। এসব সম্পদ বিক্রি করে গ্রাহকদের টাকা পরিশোধ করা সম্ভব। আমরা সেই দাবিই জানাচ্ছি।

এ বিষয়ে জানতে সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. নূরুল ইসলামের মোবাইল ফোনে দফায় দফায় ফোন ও এসএমএস দিয়েও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। কোম্পানির বনানী অফিসের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি।

সানলাইফ ইনস্যুরেন্সের বিরুদ্ধে অবশ্য এমন অভিযোগ নতুন নয়। কুষ্টিয়াতেও এই কোম্পানির বিরুদ্ধে ৪৯৭ জন গ্রাহকের মোট ১১টি মামলা আছে। বিমার মেয়াদপূর্তি হলেও গ্রাহককে টাকা না দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ এসব মামলার বাদীদের। তাদের দাবির পরিমাণ ৯০ লাখ ৬২ হাজার ৯২৬ টাকা। এরই মধ্যে ১১টি মামলার কয়েকটিতে সানলাইফ ইনস্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান অধ্যাপক রুবিনা হামিদ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মো. নূরুল ইসলাম, অডিট অফিসার মো. সাইদুর রহমান খান ও কোম্পানি সচিব মো. রবিউল ইসলামসহ সাত জনের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্টও জারি করেছেন কুষ্টিয়ার জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন