বিজ্ঞাপন

পিছিয়ে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর: ৩ কারণ বলছেন সংশ্লিষ্টরা

August 24, 2021 | 10:17 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: কনটেইনার পরিবহন আগের বছরের চেয়ে কমে যাওয়ায় চট্টগ্রাম বন্দর বিশ্বের ব্যস্ততম বন্দরের তালিকায় নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। ২০২০ সালের এক বছরের কনটেইনার পরিবহনের হিসেবে বন্দরের অবস্থান ৯ ধাপ পিছিয়ে সেই আশঙ্কা সত্যি হয়েছে। বন্দরের কর্মকর্তা ও ব্যবহারকারীরা এজন্য তিনটি কারণ চিহ্নিত করেছেন।

বিজ্ঞাপন

বন্দর পিছিয়ে যাওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্টদের মতে যে কারণগুলো উঠে এসেছে সেগুলো হলো— বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে আমদানি-রফতানি কমে যাওয়া, বিধিনিষেধ ঘোষণার কারণে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়া এবং বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর বন্ধ থাকা।

লন্ডনভিত্তিক শিপিং বিষয়ক বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো সংবাদমাধ্যম লয়েডস লিস্টের বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৯ ধাপ পিছিয়ে এখন ৬৭। সোমবার (২৩ আগস্ট) রাতে লয়েডস লিস্ট এ তালিকা প্রকাশ করেছে। গত একদশক ধরে ক্রমাগত এগিয়ে থাকার তালিকায় থাকা চট্টগ্রাম বন্দরের পিছিয়ে যাওয়া নিয়ে বন্দরসংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা তৈরি হয়েছে।

আরও পড়ুন- করোনার ধাক্কা: বৈশ্বিক তালিকায় ৯ ধাপ পেছাল চট্টগ্রাম বন্দর

বিজ্ঞাপন

বিশ্বের বন্দরগুলোর এক বছরের কাজের গতি এবং কনটেইনার পরিবহনের হিসাব করে প্রতিবছর বিশ্বের শীর্ষ ১০০টি বন্দরের তালিকা করে লয়েডস লিস্ট। ২০১৮ সালে কনটেইনার পরিবহনের হিসেব করে ২০১৯ সালে প্রকাশিত তালিকায় বন্দরের অবস্থান ছিল ৬৪তম। ২০১৯ সালের হিসেবে ২০২০ সালে প্রকাশিত তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দর আরও ছয় ধাপ এগিয়ে যায়, বন্দরের অবস্থান হয় ৫৮তম।

এর আগে, লয়েডস লিস্টে ২০১০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ছিল ৮৮। এরপর ২০১১ সালে ৮৯তম, ২০১২ সালে ৯০তম, ২০১৩ সালে ৮৬তম, ২০১৪ সালে ৮৭তম, ২০১৫ সালে ৭৬তম, ২০১৬ সালে ৭১তম ও ২০১৭ সালে ৭০তম অবস্থানে পৌঁছায় চট্টগ্রাম বন্দর।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০২০ সালের মার্চ মাস থেকে করোনার প্রভাবে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং কমতে থাকে। আগের বছরের চেয়ে আমদানি-রফতানি পণ্যবাহী ও খালি কনটেইনার পরিবহন কমে ২ লাখ ৪৮ হাজার ২১০ টিইইউস। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান পিছিয়ে তিন বছর আগের জায়গায় পৌঁছেছে।

বিজ্ঞাপন

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘বৈশ্বিক তালিকায় চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ৯ ধাপ পিছিয়ে ৬৭তম হয়েছে। তার মানে এই নয় যে বন্দরের দক্ষতা-সক্ষমতা কমে গেছে। ২০১৯ সালেও আমরা ৩০ লাখের বেশি কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছি। ধারাবাহিকভাবে বন্দর কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। এটা হয়েছে কেবল করোনা মহামারির কারণে। শুধু চট্টগ্রাম বন্দর নয়, বিশ্বের অনেক বন্দরও কিন্তু পিছিয়ে গেছে।’

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সদ্যসমাপ্ত ২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার ৯৭৭ টিইইউস। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার ১৮৭ টিইইউস। ২০১৮ সালে ২৯ লাখ ৩ হাজার ৯৯৬ এবং ২০১৭ সালে ২৬ লাখ ৬৭ হাজার ২২৩ টিইইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছিল চট্টগ্রাম বন্দর।

২০২০ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছে তিন হাজার ৭২৮টি। ২০১৯ সালে এর চেয়ে ৭৯টি জাহাজ বেশি হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল। সে বছর জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল তিন হাজার ৮০৭টি। ২০১৮ সালেও জাহাজ হ্যান্ডলিং করা হয়েছিল সদ্যসমাপ্ত বছরের চেয়ে ১৯টি বেশি। সে বছর জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছিল তিন হাজার ৭৪৭টি। ২০১৭ সালে জাহাজ হ্যান্ডলিং হয়েছিল ৩৭০টি।

বাংলাদেশ শিপিং এজেন্ট অ্যাসোসিয়শেনের পরিচালক মুনতাসির রুবায়েত বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে মহামারি পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পর কনটেইনার ইমপোর্ট-এক্সপোর্ট ভলিউম কমে যায়। মার্চ থেকে করোনার সংক্রমণ দেশে শুরু হয়েছিল। সেই মাস বাদ দিলে এপ্রিল থেকে ভলিউমের সংখ্যা নেমে আসে। এছাড়া আমরা ট্রান্সশিপমেন্ট বন্দর হিসেবে বিশ্বের যেসব বন্দরকে ব্যবহার করি, সেখানে প্রচুর কনটেইনার জট, ডেডলক ছিল। ২০১৯ সালে আমরা যে পরিমাণ জাহাজ হ্যান্ডলিং করেছি, ২০২০ সালে এসে তার পরিমাণ কমে যায়। এটি কেবল করোনার কারণে হয়েছে।’

বিজ্ঞাপন

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে কনটেইনারে তৈরি পোশাক, ওষুধ, ইস্পাতসহ বিভিন্ন শিল্পপণ্য ও ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়। আর বাংলাদেশ যেসব পণ্য রফতানি করে, তার পুরোটাই কনটেইনারের মাধ্যমে হয়।

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর আগে ২০২০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসে আমদানি-রফতানি মিলিয়ে যথাক্রমে দুই লাখ ৮৫ হাজার ৯৭৯ টিইউস ও ২ লাখ ৪১ হাজার ৯৪০ টিইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করে চট্টগ্রাম বন্দর। মার্চ মাসে করোনার সংক্রমণ শুরু হয় দেশে। সেই মাসেও ২ লাখ ৪৯ হাজার ৬৬৯ টিইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়।

কিন্তু এপ্রিলে কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের পরিমাণ প্রায় অর্ধেক কমে যায়। এপ্রিলে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে এক লাখ ৩২ হাজার ৯২১ টিইউস। মে মাসে ২ লাখ ৪ হাজার ৮০১ টিইউস, জুন মাসে ২ লাখ ১৯ হাজার ১৫০, জুলাই মাসে ২ লাখ ৩১ হাজার ৬৬৩ টিউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়। তবে আগস্ট মাস থেকে আবারও বাড়তে থাকে।

আগস্টে ২ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৭ টিইউস, সেপ্টেম্বরে ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৬২ টিইউস, অক্টোবরে ২ লাখ ৫৩ হাজার ৩৩৭ টিইউস, নভেম্বরে ২ লাখ ৫৮ হাজার ২২ টিইউস এবং ডিসেম্বরে ২ লাখ ৭৪ হাজার ৯৬৬ টিইউস কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয় চট্টগ্রাম বন্দরে।

১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার পরিবহন শুরু হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের ইতিহাসে শতাংশের হারে কনটেইনার পরিবহন সবচেয়ে বেশি কমেছে ২০২০ সালে। এর আগে ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের পর প্রায় ছয় শতাংশ কনটেইনার পরিবহন কমেছিল চট্টগ্রাম বন্দরে।

বেসরকারি অপারেটর সাইফ মেরিটাইমের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ আবদুল্লাহ জহির বলেন, ‘বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আমদানি হয় চীন থেকে। করোনা মহামারি শুরুর পর দেশের আমদানিকারকরা চীনের পণ্যের জন্য এলসিও খুলতে পারেননি। চীন অনেকদিন ধরে তাদের রফতানি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিল। এ কারণে টোটাল ভলিউম কমে গেছে। স্বাভাবিকভাবে হ্যান্ডলিংও কমেছে।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো. ওমর ফারুক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রতিবেশী অনেক বন্দরের চেয়ে চট্টগ্রাম বন্দরের অবস্থান ভালো। বিশ্বজুড়ে করোনা পরিস্থিতিতে আমদানি-রফতানি দু’টোই কমে গিয়েছিল। করোনার সংক্রমণ শুরুর পর চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি-রফতানি পণ্যের জাহাজ হ্যান্ডলিংই প্রায় এক মাস বন্ধ ছিল। এখন বৈশ্বিক পরিস্থিতির ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে, স্বাভাবিকভাবে আমদানি-রফতানি বাড়বে। তখন চট্টগ্রাম বন্দরেও জাহাজ ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং বাড়বে। এতে চট্টগ্রাম বন্দর আবারও অগ্রগতির তালিকায় আসবে।’

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন