বিজ্ঞাপন

‘গাছপালা-নদী নিয়ে যত ইচ্ছা গান করেন, পালাগান বন্ধ করে দেন’

November 4, 2021 | 10:27 pm

কবীর আলমগীর, জয়েন্ট নিউজ এডিটর

ঢাকা: পালাগানের আসরে ‘যুক্তিতর্ক’ উপস্থাপনের সময় ‘ধর্ম নিয়ে কটূক্তি’ করার অভিযোগে বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন ঢাকা বার অ্যাসোসিয়েশনের আইনজীবী ইমরুল হাসান। সম্প্রতি তিনিই আবার ব্যান্ডদল মেঘদলের বিরুদ্ধে ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ হানার অভিযোগে মামলা করেছেন। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করেছিলেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

পালাগানের ওই শিল্পীর বিরুদ্ধে মামলা করলেও ‘এর আগে কখনো পালাগান শোনেননি’ বলে সারাবাংলাকে জানিয়েছেন মামলা করে আলোচনায় আসা আইনজীবী ইমরুল। তবে বাকি দুই মামলা নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি। অন্যদিকে সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনেরা বলছেন, এ ধরনের মামলা শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার পরিসরকে সংকুচিত করে দেবে।

গত ২৮ অক্টোবর ঢাকা মহানগর হাকিম মইনুল ইসলামের আদালতে মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা করেন আইনজীবী ইমরুল হাসান। অন্যদিকে গত বছরের ২৫ অক্টোবর ঢাবি অধ্যাপক জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। আর গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে তিনি মামলা করেছিলেন রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে।

এরই মধ্যে রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাটিতে আদালত অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছেন। মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণ এখনো হয়নি। ঢাবি অধ্যাপকের নামে দায়ের করা মামলায় এখনো অভিযোগপত্র জমা দেয়নি পুলিশ। আর মেঘদলের মামলাটি আদালত তদন্ত করার ভার দিয়েছেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই)।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- মেঘদলের ১৫ বছর আগের গানে, ‘ধর্মীয় অনুভূতি’র মামলা, তদন্তে পিবিআই

বাউলশিল্পী রিতা দেওয়ানের বিরুদ্ধে বিচার পর্যায়ে থাকা মামলাটি নিয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী ইমরুল হাসান বলেন, ‘আমি এর আগে কখনো পালাগান শুনিনি। এই প্রথম শুনেছি।’

পালাগানের বাহাসের সময় যেসব ‘যুক্তিতর্ক’ তুলে ধরা হয়, তা পালাগানের ঢং। আগে পালাগান শুনলে বা এর সঙ্গে পরিচিত থাকলে ‘ভুল বোঝাবুঝি’ না-ও হতে পারত কি?— প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে ইমরুল হাসান বলেন, ‘গাছপালা, নদীসহ যা কিছু নিয়ে, সবকিছু নিয়ে যত ইচ্ছা গান করেন। গালিগালাজ করে আল্লাহ-নবীকে নিয়ে গান গাওয়ার দরকার কি? পালাগান বন্ধ করে দেন।’

বিজ্ঞাপন

মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ইমরুল হাসান বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না। আপনাকে আগেই বলেছি।’ ঢাবি অধ্যাপক জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা নিয়েও তার কোনো মন্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

মেঘদলের মামলার এজাহারে ইমরুল হাসান উল্লেখ করেছেন, আমাদের প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মাদ (স.)-এর একটি দোয়া বা ইসলামি প্রার্থনা তথা তালবিয়া নিয়ে ইসলামে নিষিদ্ধ বাদ্য বাজনা, তথা আধুনিক মিউজিক ইনস্ট্রুমেন্ট দিয়ে বিকৃত সুরে গানের মতো করে বিকৃতকারে অশ্রদ্ধার সঙ্গে উদ্দেশ্যমূলকভাবে মাতালের মতো গাওয়া হচ্ছে। এই গান মামলার বাদীর ধর্মানুভূতিতে আঘাত হেনেছে।

ইরাক, ইরান, তুরস্ক কিংবা উপমহাদেশেও গান কিংবা গজলের সঙ্গে ‘বাদ্য-বাজনার সংমিশ্রণে’র নজির পাওয়া যায়। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আইনজীবী ইমরুল বলেন, ‘আমি গজলের সঙ্গে বাদ্য-বাজনা মেশানো কোনো গান শুনিনি। বাজনা বাজিয়ে গজল গাওয়া হয়, এটি আমি জানি না। আমি বাংলাদেশ নিয়ে আছি। আমি বাংলাদেশের গজল শুনেছি।’ অন্যদের গান শোনার সময় নেই বলেও এসময় মন্তব্য করেন আইনজীবী ইমরুল হাসান।

বিজ্ঞাপন

কনসার্টে গান গাইছেন মেঘদলের শিল্পী শিবু কুমার শিল

মেঘদলের সাত সদস্যের বিরুদ্ধে ইমরুল হাসান ফৌজদারি দণ্ডবিধির ২৯৫ (ক) ও ১০৯ ধারায় মামলা করেছেন।

২৯৫ (ক) ধারায় এ সংক্রান্ত অপরাধ ও শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিকদের যেকোনো শ্রেণির ধর্মীয় অনুভূতিতে কঠোর অপমানিত করার অভিপ্রায়ে ইচ্ছাকৃত ও বিদ্বেষাত্মকভাবে উচ্চারিত বা লিখিত শব্দাবলির সাহায্যে বা দৃশ্যমান কোনো বস্তুর সাহায্যে উক্ত শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অপমানিত করে বা অবমাননা করার চেষ্টা করে, সে ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনার সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে— যার মেয়াদ দুই বছর পর্যন্ত হতে পারে, বা অর্থদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে।’

অন্যদিকে দণ্ডবিধির ১০৯ ধারায় সাধারণত অপরাধ সংগঠনে সহায়তা করার বিষয়ে দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। সহায়তার কারণে যদি সে অপরাধ ঘটে এবং এ আইনে একই রকম সহায়তার দণ্ডদানের জন্য যদি কোনো স্পষ্ট বিধান না করা হয়ে থাকে, তাহলে ওই সহায়তাকারী যে অপরাধটি সংঘটনে সহায়তা করেছে, সে অপরাধের জন্য প্রযোজ্য দণ্ডই সহায়তাকারীর জন্য প্রযোজ্য হবে।

এই দুই ধারায় অভিযোগ এনে এজাহারে ইমরুল লিখেছেন, পেছনে সাইনবোর্ড আকারে ‘সহিংসতা’ লেখা রেখে মেঘদল (মামলায় মেঘদূত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে) ‘ওম’ গানটি পরিবেশন করেছে। ইউটিউবে গানটি শোনার পর ধর্মানুভূতিতে আঘাত লেগেছে বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।

তবে জানা গেছে, সম্প্রতি দুর্গাপূজা উপলক্ষে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত ২২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ‘সহিংসতার বিরুদ্ধে কনসার্ট’ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে আয়োজিত কনসার্টেই বেশ কয়েকটি ব্যান্ডদলের সঙ্গে অংশ নিয়ে মেঘদল ‘ওম’ গানটি পরিবেশন করে।

মামলাটি নিয়ে সারাবাংলার কাছে কোনো মন্তব্য না করতে চাইলেও ইমরুল হাসান তার ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেছেন, ‘সাধারন (সাধারণ) মুসলিমদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানায় গান পরিবেশনকারী দল/মেঘদূত (মেঘদল) বাংলাদেশি ব্যান্ডের সংশ্নীষ্ট (সংশ্নিষ্ট) গায়কসহ জড়িত সহযোগী সকলের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করলাম। আসা (আশা) করি কেউ আর এমন দুঃসাহস দেখাবে না।’

মামলায় ইমরুল হাসান আরও তিন আইনজীবীকে সাক্ষী করেছেন। তারা হলেন— আইনজীবী সাদেকুর রহমান জীবন, কাজীম ভূঁইয়া ও রিয়াজুল ইসলাম।

ফ্রেমবন্দি মেঘদল পরিবারের সদস্যরা

ইমরুল হাসানের অবস্থান ‘শান্তির বিরুদ্ধে’

একজন আইনজীবী হয়ে ইমরুল হাসানের একের পর এক ধর্মানুভূতির আঘাত হেনে মামলা করায় ক্ষোভ জানিয়েছেন দেশের বিশিষ্টজনেরা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেছেন, ‘মেঘদলের যে গানের কথা বলা হয়েছে, তা চার ধর্মের মধ্যে ঐক্য ও মানবতার পক্ষের একটি গান। এই গানে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার মতো কোনো বিষয় নেই।’

তিনি বলেন, ‘ওই আইনজীবী একের পর এক মামলা করছেন। তিনি সামাজিক বিশৃঙ্খলা তৈরি করছেন, তিনি শান্তির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া দরকার।’

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক কবি নুরুল হুদা সারাবাংলাকে বলেন, ‘সমাজে যারা সদাচারী মনোভাব রাখতে চান, তারা কখনো এরকম কাজ করতে পারেন না। সদাচারী মনোভাবের বাইরে যখন কেউ এরকম কর্মকাণ্ড করবেন, বুঝতে হবে তিনি মানবতার শত্রু।’

ধর্মীয় অনুভূতি কিংবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক বলেন, ‘বিষয়টি স্পর্শকাতর ও জটিল। তবে যা-ই করি না কেন, সব ক্ষেত্রে আমাদের আগে মানুষ হতে হবে। সবার আগে মানুষ হতে পারলে কে হিন্দু, কে মুসলমান, কে বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান— এই বাছ-বিচার আসবে না।’

নুরুল হুদা বলেন, ‘অনেকে তাৎক্ষণিক লাভ-অলাভের চিন্তা করে অনেক কিছু করে বসেন। এটি করতে গিয়েই অনেক সময় জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায়।’

বিশিষ্ট কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনজীবী যে বিষয়টি নিয়ে মামলা করেছেন এটি অন্যায়। এটি কোনোভাবে মেনে নেওয়া যায় না। আমরা এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই।’

সেলিনা হোসেনের আশঙ্কা— এভাবে চলতে থাকলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চার জায়গাটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসবে। এভাবে অন্ধকারের দিকে যাত্রা আমরা মেনে নিতে পারি না।

সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক অবশ্য মামলাটি আমলে নেওয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, “এ ধরনের আইনের অপব্যহার হচ্ছে। একজন জেলা জজের মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি কীভাবে মামলাটির তদন্তের নির্দেশ দিলেন, তা আমি বুঝতে অক্ষম। বিচার বিভাগে ধর্ম ব্যবসায়ী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা ঢুকে পড়েছে। কোনো ‘সেন্সিবল’ বিচারক এরকম আদেশ দিতে পারেন না।”

আলোচিত ‘ওম’ গানটি ‘দ্রোহের মন্ত্রে ভালবাসা’ অ্যালবামে প্রকাশ পায়

যা বলছে ঢাকা আইনজীবী সমিতি

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার স্বার্থে আইনজীবীদের ভূমিকা রয়েছে। সংক্ষুব্ধ হলে যে কেউ বিচার চাইতে পারেন। তবে আইনজীবীদের এমন কোনো কাজ করা উচিত না যাতে অসন্তোষ আরও ছড়িয়ে পড়ে।’

ঢাকা আইনজীবী সমিতির সমাজ কল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক এস এম ইমরুল কায়েস বলেন, ‘একেকজনের আদর্শ (আইডিওলজি) একেক রকম। যেটি আমার কাছে ধর্মানুভূতিতে আঘাত, সেটি অন্যের কাছে নাও হতে পারে। সমাজে বিশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করে— এরকম কোনো কর্মকাণ্ডের বিপক্ষে ঢাকা আইনজীবী সমিতির অবস্থান রয়েছেন। এরকম কাজ কেউ করলে অবশ্যই তার শাস্তি পাওনা হবে।’

সংগীত দল মেঘদলের বিরুদ্ধে মামলা করার ছয় দিন পেরিয়ে গেলেও অবশ্য কিছুই জানেন না বলে দাবি করেছেন ঢাকা আইনজীবী সমিতির সভাপতি আবদুল বাতেন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়টি জানি না। আপনার কাছ থেকে মাত্র শুনলাম।’

সারাবাংলা/একে/টিআর

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন