বিজ্ঞাপন

ঢাকাকে বাঁচাতেই হবে

March 13, 2022 | 9:53 pm

রহমান মৃধা

ব্যাল্যান্স বা ভারসাম্য কী? কীভাবে তা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব? আদৌ সম্ভব কিনা তা প্রতিষ্ঠিত করা? মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনের ২৪ ঘণ্টাকে যদি তিন ভাগে ভাগ করি যেমন ৮ ঘণ্টা ঘুম, ৮ ঘণ্টা কাজ, বাকি ৮ ঘণ্টা যা খুশি তাই করা তাহলে আমাদের জীবনযাপনে ভারসাম্য থাকার কথা। এখন আমরা সামাজিক জীব এবং বাস করছি পৃথিবীতে। যেখানে রয়েছে নানা ধরণের বাধাবিঘ্ন বা সুবিধাঅসুবিধা। সব মিলে সম্ভব হয়ে উঠছে কী ভারসাম্য ঠিক রাখা? উঠছে না।

বিজ্ঞাপন

আমরা হয় কোনো রকমে মানিয়ে চলি অথবা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে চলি। যেমন ৮ ঘণ্টা কাজের জায়গা হয় ১০ ঘণ্টা বা কোনো সময় ৬ ঘণ্টা কাজ করি। যার কারণে বাকি যে ১৬ ঘণ্টা ছিল, তাও ছিল ৮ ঘণ্টা করে তা আর ঠিক রাখা সম্ভব হয় না। ফলে ভারসাম্য যেভাবে থাকার কথা তা থাকে না। ভারসাম্য যখন ঠিক থাকতে পারে না তখন হয় ডেভিয়েশন বা চ্যুতি। আর এই ডেভিয়েশনের কারণে সৃষ্টি হয় উচ্ছৃঙ্খলতা এবং দুষণ পরিবেশ যা ঘটছে বিশ্বের সর্বত্র। তবে বাংলাদেশে, বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায় এর পরিমাণ মাত্রার সীমা ছাড়িয়ে চলেছে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। যা সমাজের জন্য কখনও মঙ্গলজনক কখনও বা অমঙ্গলজনক।

বাংলাদেশে ট্রাফিক নিয়ম না মানার কারণে গত কয়েক বছর আগে সারাদেশ জুড়ে বয়ে গেল ঝড়। স্কুলের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দিল সবার ভুলত্রুটি। পরে দুই তিন সপ্তাহ না যেতেই চলে এলো ঈদুল আযহা। সবাইকে তার আপনজনের কাছে যেতে হবে তাও একই সময়ে। কী করা! আইন বলে যে কথা আছে সেটা সবাই ভুলে আগের জায়গায় ফিরে গেল।

যদি ট্রাফিকের নিয়ম অনুযায়ী যানবাহন চলাচল করে তবে সীমিত যানবাহন চলাচলের সুযোগ রয়েছে পুরো দেশে। আমরা বিষয়টি ছোটবড় সবাই জানি। কিন্তু মাঝে মাঝে দেখা যায় চাহিদার তুলনায় যানবাহনের সংখ্যা কম, যার ফলে সম্ভব হয়ে উঠে না নিয়ম মাফিক ও নিরাপদে যানবাহন চালানো। পৃথিবীর কোথাও এমনটি নিয়ম নেই যে গাড়ির বা ট্রেনের ছাদে করে যাত্রী চলাচল করতে পারে যা বাংলাদেশে রয়েছে। তবুও সরকার, যানবাহনের মালিক এবং জনগণ সব নিয়ম কানুনের কোরবানি দিয়ে যার যা খুশি তাই করছে কোন বাধা ছাড়া।

বিজ্ঞাপন

সবাই জানে যে একটি অঘটন ঘটলে কত মানুষ প্রাণ হারাতে পারে। তারপরও হচ্ছে কি ভারসাম্য রক্ষা করা? হচ্ছে না। কারণ কী? সব সময় যদি “hand to mouth” কনসেপ্ট ব্যবহার করা হয় তখন এমনটিই ঘটে থাকে। যে সমস্যাগুলো আমাদের নিজেদের তৈরি সে সমস্যার সমাধান করতে হলে আমাদেরকে শর্ট এবং লং টার্ম পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এগুতে হবে।

একটি দেশ চালাতে হলে সেই দেশের ভৌগলিক ক্যাপাসিটি বা ক্যাপাবিলিটি সম্পর্কে যথেষ্ট পরিমাণ জ্ঞান থাকতে হবে। আছে কি সেটা আমাদের? থাকলে কীভাবে সব কিছুই ঢাকাতে স্থাপন করা হচ্ছে দিনের পর দিন? সারাদেশের সবকিছুই কি হতে হবে ঢাকাতে? তাহলে বাকি দেশটার কী হবে? বনজ সম্পদের হেড কোয়ার্টার, কবরস্থানের হেড কোয়ার্টার এগুলোও কি ঢাকাতেই থাকতে হবে? এখন যেহেতু সবকিছু ঢাকাতে সেহেতু সবার দৌড় ঢাকার দিকে। যার ফলে শুধু ট্রাফিক নয় সর্বক্ষেত্রে সমস্যা দেখা যাচ্ছে। এর থেকে রেহাই পেতে হলে ঢাকাকে ফাঁকা করতে হবে প্রথমে এবং তা সম্ভব বিকেন্দ্রীকরণের মধ্যে দিয়ে।

৬৪টি জেলার ভূমি ও অবকাঠামোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা খুবই প্রয়োজন এখন। হাজার হাজার কোটি ডলার খরচ করে স্যাটেলাইট পাঠানো হয়েছে মহাকাশে। সেই স্যাটেলাইটের যুগে কি আছে দরকার সবকিছু এক জাগায় থাকার? রাজধানীকে দুষণমুক্ত এবং বসবাসের উপযুক্ত করতে হলে সত্ত্বর সরাতে হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে। যেকোনো অবস্থাতেই ঢাকায় বসবাস করতে হবে এ মনমানসিকতা দূর করতে হলে প্রথমে যে কাজগুলো করতে হবে তা হলো: কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নানা শিল্পকারখানা, হেডকোয়ার্টার ইত্যাদি ঢাকা থেকে সরাতে হবে। এতে করে উন্নত হবে পুরো দেশ এবং হবে দেশের জনসংখ্যার সঠিক বিন্যাস। এর ফলে লজিস্টিকের ভারসাম্যতা থাকবে নিয়ন্ত্রণে।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা শহরের উপর চাপ কমাতে আরো যে কাজগুলো করতে হবে সেগুলো হলো: ঢাকা শহরের ভেতরে শিল্প, ব্যবসা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান স্থাপনে কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করতে হবে, প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে এবং ঢাকা শহরকে পরিবেশগত ও সামাজিক বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।

জেলা শহরগুলোয় ঢাকার সব সুযোগসুবিধা দেওয়া দরকার। যাতে যেকোনো কারণেই মানুষের ঢাকায় আসতে না হয়। আমাদের সবার দায়িত্ব ঢাকা শহরকে পুরোপুরি মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর। এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। এতে করে অন্য শহরগুলোর সুযোগসুবিধা বাড়বে, দ্বিতীয় সারির শহরগুলো উন্নত হবে, সমগ্র গ্রাম এলাকায় কর্মসংস্থান ও সুযোগসুবিধা বাড়বে।

মানবজাতির অধঃপতন তখনই ঘটে যখন তারা শুধু নিজেকে নিয়ে এবং ক্ষণিকের সময়টুকু নিয়ে ভাবে। একটি দেশ যখন নতুন প্রজন্মদের ভুলে যায় তখনই হিসাবের গড়মিলটা বড় আকারে দেখা দেয়। আগামী রমজান মাসে কেউ কি ছাদে করে নিয়ম ভেঙ্গে গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে যাবে না? নিয়মের বাইরে কিছু করবে না? না তা হবে না। কিছু লোক পাল্টাবে, তাদের ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধার জন্য তারা কিছু নিয়মকে অনিয়মের আওতায় আনবে। সঙ্গে নতুন সমস্যা এবং আগের পুরনো সমস্যার বোঝা বাড়তে থাকবে। সহজ ভাষায় বলতে হয় ব্যাংকে ঋণ রয়েছে, নতুন ঋণ নিয়ে কিছু পুরনো ঋণ শোধ দেওয়া। সঙ্গে সুদে মূলে নতুন ঋণের বোঝা বাড়ানো। উদাহরণ, গ্রামীণ ব্যাংকের ধার শোধ করতে ব্র্যাক ব্যাংকে যেতে হবে তারপর আশা ব্যাংকে এবং সর্বশেষে হতে হবে সর্বহারা! এমনটি যদি জাতির ম্যানেজমেন্ট স্টাইল হয়, তাহলে বাংলাকে সোনার বাংলা করা হবে কি? না, হবে না। বাংলা হবে কোটি কোটি মানুষের অভিশাপের বাংলা, দুর্নীতির বাংলা, অন্যায় অত্যাচারের বাংলা। ঋণমুক্ত, অভাবমুক্ত ও সুন্দর সোনার বাংলা পেতে হলে মানবতা ও মনুষ্যত্বের ভারসাম্য রক্ষা করা দরকার আগে এবং এর জন্য দরকার সবার মানসিকতার পরিবর্তন। তা না হলে সম্ভব হবে না বাংলাদেশের ভারসাম্য বা ব্যাল্যান্স নিয়ন্ত্রণে আনা।

বর্তমানে বিশ্বের সভ্য জগতে চলছে ধ্বংসাত্মক অ্যাক্টিভিটিজ যার ফলে ইউক্রেন হারাতে বসেছে তার হেরিটেজ। অন্য দিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ধ্বংসাত্মক ক্ষতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে যার জ্বলন্ত প্রমাণ এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়ার সপ্তাহব্যাপী বৃষ্টিপাত। যদি প্রকৃতি হঠাৎ করে বাংলাদেশ তথা রাজধানীকে ছোবল মারে তবে ঢাকাকে রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে আর দেরি নয় দেশকে, দেশের রাজধানীকে প্রকৃতির হাত থেকে রক্ষা করতে প্রোঅ্যাক্টিভ পদক্ষেপ এবং ক্রিয়েটিভ পদ্ধতির ব্যবহারই একমাত্র সমাধান।

বিজ্ঞাপন

ধরুন একটি ঝুড়িতে ১৮টি আম তার মধ্যে একটি আমের পচন ধরেছে, বাকি ১৭টি আম শত চেষ্টা করলেও পচা আমটিকে ভালো করতে পারবে না। তবে একটি পচা আম ১৭টি আমকে পচাতে পারবে। ঠিক একইভাবে দেশের পরিকাঠামো যদি দুর্নীতিগ্রস্ত এলিট গ্রুপের কারণে সঠিক পরিকল্পনা থেকে পথভ্রষ্ট হয়ে থাকে, তাহলে তাকে এখন নিয়ন্ত্রণাধীনে আনতে হবে। অর্থাৎ ১৭ কোটি মানুষের রাজধানী ঢাকাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক প্রাকৃতিক আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে ঢাকাকে অবিলম্বে বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ততোই শ্রেয়।

খন্দকার ফারুক আহমেদ ও শাম্মী আকতারের কন্ঠে ‘ঢাকা শহর আইসা আমার আশা পুরাইছে’ গানটি শোনার পর ঢাকা শহরে এসেছিলাম। গ্রাম থেকে এসে ঢাকা শহর ভ্রমণে মনের মধ্যে যে উত্তেজনা এবং অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সেটা কি আর হবে? হবে না, কারণ আমি এখন বসত করি বিশ্বের এক উন্নত দেশে যেখানে শব্দ দুষণ, ট্রাফিক জ্যাম, ঘনবসতিপূর্ণ জীবন বা দুর্নীতির কোনো বালাই নেই। সাগরের পাড়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে আছি প্রায় চল্লিশ বছর ধরে। তারপরও মাতৃভূমিকে তার পরিকাঠামোকে সুন্দর পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে দেখতে চাই। বড় সাধ জাগে সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মতো করে দেখতে আমার দেশকে, কারণ— ‘পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী, কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি, গুঞ্জরিয়া আসে অলি, পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে, তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সেযে আমার জন্মভূমি..’

লেখক: সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন