বিজ্ঞাপন

সহজে সেবা দিতে পারছেনা সহজ ডটকম

March 28, 2022 | 11:06 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রমজান কিংবা ঈদ— কোনো উৎসব না থাকলেও ট্রেনের টিকিট পেতে যাত্রীদের ভোগান্তি এখন চরমে। অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতে না পেরে যাত্রীরা ছুটছেন রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারে কাউন্টারে। সেখানেও বিপত্তি। সার্ভার জটিলতায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না টিকিট। যাত্রীদের অভিযোগ, অনলাইনে প্রবেশ করা যাচ্ছে না। কাউন্টার থেকেও টিকিট পেতে সমস্যা হচ্ছে। এই বিড়ম্বনার জন্য রেলওয়ের অব্যবস্থাপনাকেই দুষছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

তবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, নতুন পদ্ধতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সময় লাগছে। আর সমস্যা সমাধানে আরও ছয় থেকে সাত দিন সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন অনলাইনে টিকিট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের কর্তারা।

সোমবার (২৮ মার্চ) দেশের সবচেয়ে বড় রেলওয়ে স্টেশন কমলাপুরে গিয়ে দেখা গেছে, কাউন্টারগুলোতে তিল ধারণের জায়গা নেই। ঠাসাঠাসি করে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন যাত্রীরা।

মাকে নিয়ে রাজশাহী যাবেন বলে অনলাইনে একাধিকবার টিকিট কাটার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়ে কাউন্টারে চলে এসেছেন জাকির হোসেন (২৫)। জানালেন, আড়াই ঘণ্টা ধরে লাইনে আছেন। কিন্তু লাইন এগোচ্ছে না। জাকির সারাবাংলাকে বলেন, ‘কেন দেরি হচ্ছে, কখন টিকিট পাব— এমন কোনো তথ্যই কাউন্টার থেকে কেউ জানাচ্ছেন না।’

বিজ্ঞাপন

সিলেটের যাত্রী রকিবুল হাসান (৪৫) সারাবাংলাকে জানান, রোববার এসে দেড় ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে বাসায় ফিরে গেছেন। তারও অভিযোগ, কী কারণে টিকিট দিতে দেরি হচ্ছে, সেই তথ্যটুকু পাচ্ছেন না কারও কাছেই।

তবে চট্টগ্রামের যাত্রী শিউলি আক্তার (৩৫) সারাবাংলাকে জানান, তিনি আধা ঘণ্টা দাঁড়িয়েই টিকিট পেয়েছেন। দেখা গেল, পুরুষদের লাইনগুলোর তুলনায় নারীদের সেবা দেওয়া কাউন্টারগুলোতে তুলনামূলক ভিড় কম থাকায় টিকিট পেতে কিছুটা ভোগান্তি কম হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

কেন এই ভোগান্তি

রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ট্রেনের টিকিট বিক্রি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। যাত্রীদের টিকিট সেবা দ্রুত ও সহজ করতে গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সিএনএসকে বাদ দিয়ে বেসরকারি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকমের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয় বাংলাদেশ রেলওয়ে। চুক্তি অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছর এই সেবা দেবে সহজ ডটকম।

নতুন দায়িত্ব পেয়ে গত শনিবার স্বাধীনতা দিবসে প্রতিষ্ঠানটি সেবা দিতে শুরু করে। কিন্তু প্রথম দিনে কার্যক্রম শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্ধ করে দেওয়া হয় এই সেবা। পরে আবার চালু করা হলেও অনলাইন থেকে যাত্রীরা টিকিট সংগ্রহ করতে পারছেন না বলে অভিযোগ যাত্রীদের। রোববার, সোমবারও এই ওয়েবসাইটে প্রবেশে যাত্রীদের চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়।

যাত্রীরা জানিয়েছেন, লগ-ইন করতে পারলেও মোবাইলে ওটিপি কোড পাচ্ছেন না। আবার একবার নিবন্ধন করা গেলে তাদের মেসেজ আসে দ্বিতীয়বার টিকিট সংগ্রহ করা যাবে না। এমন দুর্ভোগ মাথায় নিয়ে সশরীরে টিকিট সংগ্রহ করতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে ভিড় করছেন সাধারণ যাত্রীরা।

বিজ্ঞাপন

লাইনে দাঁড়ানো সুমন রহমান (২৮) সারাবাংলাকে জানান, তিনি অনেকবার চেষ্টা করে তথ্য দিয়েছেন। কিন্তু ওটিপি কোড পাননি। মার্জিয়া রহমানেরও একই অভিযোগ, অনেক চেষ্টা করেও ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারছেন না। টিকিট সংগ্রহ নিয়ে বিচিত্র এমন সব অভিজ্ঞতা নিয়ে ক্ষোভ জানান যাত্রীরা। সহজ ডটকম এই ভোগান্তির পেছনে তাদের কার্যক্রম শুরুর দিনেই সাইবার আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা বলছে।

সমস্যা নিরসনের উদ্যোগ কী

নিয়ম অনুযায়ী রেলের মোট টিকিটের ৫০ শতাংশ বিক্রি করা হবে অনলাইনে। বাকি ৫০ শতাংশ বিক্রি করা হবে কাউন্টার থেকে। সেই নিয়ম ও চুক্তি অনুযায়ীই বর্তমানে ট্রেনের অনলাইনে টিকিট কাটার নতুন এ পদ্ধতি তৈরি করেছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সহজ ডটকম। কিন্তু টিকিটের জন্য eticket.railway.gov.bd ওয়েব পোর্টালে প্রবেশই করতে পারছেন না যাত্রীরা। গত তিন দিন ধরে এই পরিস্থিতি তৈরি হলেও সমস্যা নিরসনে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি দায়িত্বে থাকা সরকারি-বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠানের কাউকেই।

নতুন সিস্টেমে কাজ করতে গিয়ে ভুল-ত্রুটি হতেই পারে উল্লেখ করে সহজকে সেবাদান প্রক্রিয়া আরও সহজ করতে সময় দিতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ের। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের বক্তব্য দুয়েকদিনেই চট করে বাদ দেওয়া বা শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। তারা বলছেন, দ্রুতই সার্ভার ঠিক করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সহজ ডটকম যা বলছে

অনলাইনে টিকিট বিক্রিতে সমস্যার বিষয়ে সহজ ডটকমের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই কার্যক্রম শুরুর দিকে সার্ভার ঠিক ছিল। একযোগে ৭৭ স্টেশনে রেলের টিকিট বিক্রি করে মাইলফলক তৈরি করেছেন। তাদের বক্তব্য, মাত্র ২১ দিনে তৈরি করা সল্যুশন দিয়ে প্রথম দিনেই ৭৭ স্টেশনে সন্ধ্যা থেকে কয়েক ঘণ্টায় তারা ৪৫ হাজার টিকিট বিক্রি করতে পেরেছেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত চাপ পড়লে সমস্যা দেখা দিতে শুরু করে।

সহজ ডটকমের কর্মকর্তাদের দাবি, সেবা দেওয়ার প্রথম দিনেই তারা সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এই সমস্যা দ্রুতই সমাধান হচ্ছে বলে জানিয়ে তারা বলছেন, উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলা করে সহজ ডটকম যাত্রীসেবায় নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ ব্যবস্থাপক ফারহাত আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, গত ১৫ বছর ধরে চলমান পুরনো সমন্বিত টিকিটিং সিস্টেম হস্তান্তরের কথা থাকলেও আগের প্রতিষ্ঠান গত ২১ মার্চ বিকালে এসে নামমাত্র একটি সিডি হস্তান্তর করেছে, যার সঙ্গে কোনো বিস্তারিত তথ্য ছিল না। এছাড়া আগে ব্যবহৃত মোবাইল অ্যাপও প্রতিষ্ঠানটি হস্তান্তর করেনি। ফলে জনগণের কথা বিবেচনা করে এবং দেশের ৭৭টি কাউন্টারে রেলওয়ে টিকিটিং পরিচালনার কাজ চলমান রাখতে ২১ দিনে সল্যুশন এবং রেলের টিকিট সংগ্রহের নতুন ওয়েবসাইট তৈরি করেছে সহজ, যা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের কাজ।

তিনি বলেন, এছাড়া দেশের সব স্টেশনে হার্ডওয়্যার ইনস্টল করা, বুকিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়াসহ সক্ষমতা বাড়াতে কাজ চলছে। তবে অ্যাপের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির জন্য সময় লাগবে দেড় বছর। এই সময়ের মধ্যে নতুন ইন্টিগ্রেটেড টিকিটিং সিস্টেম তৈরি এবং তা যথাযথ প্রক্রিয়ার ইনস্টল বা প্রতিস্থাপন করে আরও উন্নত ও সহজ উপায়ে টিকিট সরবরাহ করা হবে।

ঘরে বসে টিকিট সংগ্রহের সুযোগ না থাকায় যাত্রীরা স্টেশনে ছুটে আসছেন। ফলে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাউন্টারগুলোতে অন্যান্য স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে যাত্রীদের চাপ বেড়েছে কয়েক গুণ। রেলওয়ে সূত্র বলছে, কেবল কমলাপুরেই নয়, দেশের বাকি ৭৬টি স্টেশনেও যাত্রীদের চাপ রয়েছে। সেসব স্টেশনেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও মিলছে না টিকিট। তবে রেলওয়ে বা সহজ ডটকম যাই বলুক, যাত্রীদের দাবি অবিলম্বে যেন সমস্যার সমাধান করে সহজে ট্রেনের টিকিট পাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

রেলওয়ে কর্মকর্তাদের বক্তব্য

কমলাপুর রেলওয়ের স্টেশন ম্যানেজার মোহাম্মদ মাসুদ সারওয়ার সারবাংলাকে বলেন, সহজ ডটকম ২৫ মার্চ রাত থেকে টিকিট বিক্রি শুরু করে। ২৬ মার্চ তাদের সার্ভারে সমস্যা দেখা দেয়। সহজ ডটকম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। তারা জানিয়েছেন, বহির্বিশ্বের কোথাও থেকে তারা সাইবার আক্রমণের শিকার হয়েছে। এ কারণে ই-টিকিটিং কার্যক্রমে সমস্যা দেখা দিয়েছেন।

স্টেশন ম্যানেজার আরও বলেন, যাত্রীরা অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করতে পারছেন না— এ অভিযোগ এসেছে আমাদের কাছে। আমরা সহজের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। তারা চার-পাঁচ দিন সময় চেয়েছেন। সে পর্যন্ত যাত্রীদের ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেন তিনি।

তবে কাউন্টার থেকে কম্পিউটারের মাধ্যমে যে টিকিট বিক্রি হচ্ছে, সেখানে কোনো সমস্যা নেই বলে জানান মাসুদ সারওয়ার। তিনি বলেন, যে ৫০ শতাংশ টিকিট যাত্রীরা অনলাইনে সংগ্রহ করতেন, সেগুলো কাউন্টারে চলে আসায় চাপ তো রয়েছেই। সেই চাপ সামাল দিতে সবাইকে অতিরিক্ত ডিউটি করতে হচ্ছে। আশা করছি দুয়েকদিনেই সমস্যা কেটে যাবে।

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৯৯৪ সাল থেকে কম্পিউটারভিত্তিক টিকিটিং সিস্টেম চালু করে। শুরুতে ২৭টি স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে টিকিট ইস্যু করা হলেও এখন ১০৪টি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকিট ৭৭টি স্টেশনে কম্পিউটারের মাধ্যমে ইস্যু করা হয়। এসব স্টেশন থেকে প্রতিদিন ১০৫টি আন্তঃনগর ট্রেনের প্রায় ৯০ হাজার এবং মাসিক প্রায় ২৭ লাখ টিকিট কম্পিউটারের মাধ্যমে ইস্যু করা হয়। মোট টিকিটের ৫০ শতাংশ অনলাইন আর ৫০ শতাংশ কম্পিউটারের মাধ্যমে বিক্রি করে বাংলাদেশ রেলওয়ে।

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন