বিজ্ঞাপন

অরুণ কুমার বিশ্বাস-এর গোয়েন্দা গল্প ‘আলিম বেগের খুলি’

May 3, 2022 | 12:34 pm

০১.
অলোকেশ লন্ডনে। পড়লেখা নয়, নিউ স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের এক বিশেষ আমন্ত্রণে বিলেতে অবস্থান করছেন। ১০ নম্বর ব্রডওয়েতে অবস্থিত ইয়ার্ডের অফিসে বসে কথা বলছিলেন অলোকেশ। আলোচনার বিষয় বিবিধ। তবে বিশ্বব্যাপী চলমান রাজনৈতিক মেরুকরণ তাদের আলোচনায় বিশেষ প্রাধান্য পায়। কথায় কথায় উঠে আসে পলাশীর যুদ্ধ ও সিপাহি বিদ্রোহের বিষয়টি।

বিজ্ঞাপন

ডেপুটি সার্জেন্ট বিল নিক্সন তুললেন রবার্ট ক্লাইভের বিষয়টি। তার ভাষায় ক্লাইভ সাহেবের মতো মানুষ হয় না। ইংরেজদের কাছে তিনি বীরের মর্যাদা পেয়ে থাকেন। অলোকের পেটের ভিতর কিছু একটা মোচড় দেয়, তার পিত্তি জ্বলে যায়। তিনি সখেদে বললেন, একদম ঠিক বলেছেন বিল ভায়া। যদ্দূর জানি, আপনাদের কাছে পেঁচা জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রতীক। কিন্তু আমাদের দেশে পেঁচা মানেই অলক্ষুণে, লোভী আর অমঙ্গলজনক পাখি। সার্জেন্ট বিল যা বোঝার বুঝে নিলেন। তাই আর এই নিয়ে কথা বাড়ালেন না। স্রেফ চেপে গেলেন। কিন্তু অলোকেশ ভুলেও ভাবতে পারেননি যে তার এবারকার বিলেত যাত্রা সেই সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাসে আটকে যাবে। তাকে একরাশ কষ্টের বোঝা বয়ে নিয়ে দেশে ফিরতে হবে।

লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির বর্ষীয়ান প্রফেসর কিম ওয়াগনার। ছাত্রদের তিনি ইতিহাস পড়ান। ভালোবেসেই পড়ান। তার পছন্দের বিষয় ব্রিটিশ ভারতীয় সংঘর্ষের ইতিহাস। বয়স হয়েছে তার। ছাত্রদের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত শেখালেও আদতে কিম খুব শান্তিপ্রিয় মানুষ। কারও সাতে-পাঁচে নেই, প্যাঁচেও নেই। লন্ডনে ক’দিন ধরে খুব ঠান্ডা পড়ছে, যাকে বলে হিমপ্রবাহ। কিম ওয়াগনার তার সুপরিসর কক্ষে বসে ইমেইল বার্তা চেক করছিলেন। সামনে ধূমায়িত কফির মগ। কফির গোত্রবিচারে ক্যাপাচিনো কিমের বিশেষ পছন্দ। এটি মূলত ইতালীয় ধাঁচের কফি। ডাবল এসপ্রেসো, সাথে বাষ্পায়িত দুধের ফেনা মিশিয়ে ক্যাপাচিনো তৈরি হয়। সেখানে ইচ্ছামতো গাছপালা-পাখি কিংবা ভালোবাসার সাইনও ফুটিয়ে তোলা যায়। খেতে খুব সুস্বাদু, তা বলা যাবে না। তবে কিম ওয়াগনার এতেই স্বচ্ছন্দ, মোকা বা লাত্তে তার পছন্দ নয়।

‘কী ভীষণ শীত রে বাবা! একেবারে হাড় অবদি হিম ঢুকে পড়ছে!’ স্বগতোক্তি করলেন কিম ওয়াগনার। জানালার ফাঁক গলে একজোড়া কাঠবেড়ালির নাচানাচি দেখে তার মন ভালো হয়ে গেল। তিনি আবারও ইমেইল বার্তায় মনোযোগী হলেন। কিম কম্পিউটারের যান্ত্রিক ইঁদুর ধরে স্ক্রল ডাউন করছেন, একের পর এক মেইলের বার্তা-শিরোনাম দেখছেন, দরকারি মনে হলে খুলছেনও। হঠাৎ একখানে তার চোখ আটকে যায়। এসেক্স থেকে এক ভদ্রমহিলা বার্তা পাঠিয়েছেন একটি খুলির বিষয়ে। অন্তত দেড়শ বছর আগেকার একজনের মাথার খুলি। সম্ভবত তিনি ইন্ডিয়ান।

বিজ্ঞাপন

বার্তাপ্রেরক এলিজাবেথ ওরফে লিজা। তিনি পেশায় একজন ডক্টর। এসেক্সেই থাকেন। তার স্বামী পল ইউকে আর্মিতে আছেন। সম্ভ্রান্ত পরিবার যাকে বলে। লিজা বর্ণনায় বলেছেন, খুলিটা তাদের বাড়িতে অনেকদিন ধরে আছে। খুলির সাথে চেয়াল নেই, গোটা দশেক দাঁত আছে। রঙটাও বদলে গেছে। চট করে দেখলে চেনা যায় না। মেহগিনির বিচির মতো গাঢ় বাদামি হয়ে গেছে।

ভ্রু কোঁচকান কিম ওয়াগনার। মামুলি খুলি নিয়ে ভাববার মতো টাইম তার নেই। সময় তো আর খোলামকুচি নয় যে ইচ্ছামতো ওড়াবেন! তিনি প্রায় ক্লোজ করেই দিচ্ছিলেন। হঠাৎ কী মনে হলো, তিনি মেইল বার্তাটি আবার পড়তে শুরু করলেন।

এক সিপ ক্যাপাচিনো মুখে তুললেন কিম ওয়াগনার। নাহ, কফিটা একদম বিস্বাদ হয়ে গেছে। নাকি তার মেজাজ বিগড়েছে! এসেক্সের সেই ডাক্তার ভদ্রমহিলা আরও লিখেছেন, খুলিটা তিনি নিজের কাছে রাখতে আর ভরসা পাচ্ছেন না। খুলি নিয়ে ভয়টা কীসের, তা অবশ্য খোলাখুলি তিনি লেখেননি। তিনি প্রফেসরের সাথে মুখোমুখি বসে কথা বলতে চান। যদি তিনি দয়া করে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতেন।

বিজ্ঞাপন

পোস্টস্ক্রিপ্টে লিজা আরও লিখেছেন, খুলির পরিচয় সম্পর্কে তিনি অল্প কিছু জানেন। কারণ খুলির ভেতরেই একটা চিরকুট পাওয়া গেছে। কাগজটা এতই পুরনো যে হলুদ হতে হতে তা প্রায় ধুলোটে এখন। তবে লেখাটা স্পষ্টই আছে। কলমের কালি চটেনি। চিরকুট পড়ে জানা যায়, আলিম বেগ নামের একজন বিদ্রোহী হাবিলদারের মাথার খুলি এটি। তিনি ৪৬ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পদাতিক দলের সৈন্য ছিলেন। ভারতীয়। শুধু তাই নয়, ১৮৫৭ সালে যে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, তাতে আলিম বেগ ছোট্ট একটি দলের নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। তিনি সাহসী, একগুঁয়ে এবং ব্রিটিশবিদ্বেষী। চিরকুটের ভাষ্যমতে, ‘হাবিলদার বেগ ওয়জ ব্রেইভ, স্টার্বন অ্যান্ড অ্যান্টি-ব্রিটিশ!’

চোখ পিট পিট করেন কিম ওয়াগনার। তার কফি খাওয়া আজ লাটে উঠেছে। তিনি রীতিমতো ঘামছেন। কারণ চিরকুটের পরের কথাগুলো আরও ভয়ংকর। লিজা তার ইমেইল বার্তায় লিখেছেন, এই খুলির মালিক আলিম বেগ বিদ্রোহের সময় ইংরেজ ডাক্তার গ্রাহামকে তার মেয়ের সামনে গুলি করে মেরেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি হান্টার নামক এক মিশনারিকে তার স্ত্রী-কন্যাসহ হত্যা করেন।

‘কী সাংঘাতিক কথা!’ শিউরে উঠলেন প্রফেসর কিম ওয়াগনার। সাতসকালে এ কোন দুঃসংবাদ দিয়ে তার প্রাতরাশ হলো! লোকটা তো ভীষণ মারকুটে/মারদাঙ্গা ছিল দেখা যায়! প্রফেসর কিম ঝটপট পুরো মেইলখানার একটা প্রিন্ট করে নিলেন। তার মানে তিনি এই বার্তায় ইন্টেরেস্ট পাচ্ছেন। ইতিহাসের মানুষ কিম ওয়াগনার! এমন চটকদার খবর পেলে চেপে যেতে পারেন!

চিরকুটে লিজা আরও লিখেছেন, সিপাহি বিদ্রোহের একবছর পর অর্থাৎ ১৮৫৮ সালে এই সিপাহিকে কামানের গোলায় উড়িয়ে দেয় ব্রিটিশ আর্টিলারি দল। আলিম বেগের বয়স তখন মাত্র ৩২ বছর। ঘটনাস্থল শিয়ালকোট, বর্তমানে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশ। সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ক্যাপ্টেন ক্যাস্টেলো, তিনিই নাকি আলিম বেগের খুলি ইংল্যান্ডে নিয়ে আসেন। জাহাজযোগে। সুভ্যেনির হিসেবে!

বিজ্ঞাপন

আপাতত এটুকুই। প্রফেসর ওয়াগনার কী করবেন, ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না। তিনি কুলকুল করে ঘামছেন, আবার কাঁপছেনও। সিপোহী বিদ্রোহ নিয়ে তার বিস্তর পড়াশুনো রয়েছে। কিন্তু এই আলিম বেগের কথা তিনি কস্মিনকালেও শোনেননি। কিমের নিজেকে বেশ বেয়াকুব আর কূপমণ্ডুক বলে মনে হচ্ছে। অবশ্য তিনি এও ভাবছেন, লন্ডনের সাহিত্যাকাশে নতুন করে কোনো নক্ষত্র উদিত হতে যাচ্ছে নাকি! মানে এসেক্সের ওই ডাক্তার ভদ্রমহিলা। কী যেন নাম! এলিজাবেথ ওরফে লিজা।

কিন্তু চিরকুট! ওটা দেখতে চাইলেই তো তার জারিজুরি সব ফাঁস হয়ে যাবে! না না, তিনি মিথ্যা বলবেন না, কিছুতেই না। প্রফেসর কিম নিজের জানার সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে আরও বারকয়েক ইমেইল বার্তাটি পড়লেন, বেশ মনোযোগ সহকারে।

দু’টো সন্দেহ তার মনে উঁকি দিচ্ছে। এক, বানানো গল্প কি না। দুই, ঘটনা যদি সত্যি হয়েও থাকে, তাতে প্রফেসরের কী করার আছে! তিনি ইতিহাসের শিক্ষক। ছেলেপানদের ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি শেখান। নতুন করে ইতিহাস সৃজনের কোনো আবশ্যকতা তো তার নেই। বস্তুত, আজকের ঘটনাবলিই একদিন ইতিহাস হবে।

কিম বাইরে তাকালেন। সেই ওক গাছটার দিকে। যেখানে কিছুক্ষণ আগে দু’টো কাঠবেড়ালি নাচানাচি করছিল। কিন্তু ওরা এখন নেই। রোদ সরে গেছে, তাই কাঠবেড়ালি অন্য কোথাও রোদের সন্ধান করছে হয়তো। আরেক মগ কফি খাবেন নাকি! তাতে মেজাজটা যদি ফিরে আসে! কে এই আলিম বেগ! একজন মামুলি ভারতীয়র এত সাহস! কোথায় যেন লাগে প্রফেসর কিমের। আঁতে কি!

আবারও কফি বানান প্রফেসর। এসপ্রেসোর ফেনা দিয়ে কাঠবেড়ালি আঁকেন। তারপর ডিরেক্টরি খুলে বসেন। ইয়েস, বিল নিক্সনকে ব্যাপারটা জানালে হয়। তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডে আছেন। তিনি নিশ্চয়ই এই কেসে ইন্টেরেস্ট পাবেন। বিল তার অনেক দিনের পরিচিত। তারা দু’জন একসাথে অক্সফোর্ডে পড়েছেন। নিক্সনও ইতিহাসের ছাত্র।

ফোনে পেলেন বিলকে। কিম বলছি। কেমন আছ বন্ধু— সহাস্যে বললেন প্রফেসর ওয়াগনার।

আছি একরকম। বলো কিম, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?

সরাসরি কাজের কথায় এলেন বিল। তিনি কেজো কেঠো মানুষ। ইয়ার্ডে কাজ করতে গেলে গদাইলস্করি হলে চলে না।

সংক্ষেপে পুরো মেইলবার্তাটি খুলে বললেন প্রফেসর। তারপর জুড়ে দিলেন, আমি কিছুটা অস্বস্তিতে আছি বিল। কারণ এসেক্সের ওই ভদ্রমহিলা আমাদের ওপর ভরসা করেছেন। তিনি এই খুলির বিষয়টা ফয়সালা করতে চান। লিজা আমার কাছে সময় চেয়েছেন।

‘ওকে গুড কিম। আ’ম প্রিটি ইন্টেরেস্টেড। তুমি মহিলাকে সময় জানিয়ে দাও। আর আমি তোমার কাছে একজনকে পাঠাচ্ছি। সম্ভব হলে আজই। মে বি সন্ধ্যায়। মিস্টার অলোকেশ রয়, ডিটেকটিভ ফ্রম ইন্ডিয়া। ভেরি ব্রিলিয়ান্ট চ্যাপ। আমি বিশ্বাস করি, তিনি তোমাকে হেল্প করতে পারবেন। টেক হিম অ্যাজ আ ফ্রেন্ড।’

এটুকু বলে ফোন রেখে দেন বিল নিক্সন। এভাবেই মূলত আলিম বেগের খুলির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে তুখোড় গোয়েন্দা অলোকেশ রয়।

০২.

প্রফেসর চাইলে অলোকেশকে তার কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকতে পারতেন। কিন্তু তাতে বন্ধুত্বের আমেজটা ঠিক আসে না। অলোকেশকে তিনি এক সরাইখানায় ডাকলেন। নামটা ভীষণ অদ্ভুত, গোট ট্যাভার্ন। মানে ছাগলের আনাগোনা সেখানে বেশি। সেন্ট্রাল লন্ডনের ওয়ারেন স্ট্রিটে এর অবস্থান। দ্বিতল, ইউরোপিয়ান ধাঁচে তৈরি। দেখলে সমীহ জাগে। অলোক পান-টান করেন না, তবে তিনি এলডার ফুলের জুস খেতে পারেন। এতে কোনো অ্যালকোহল নেই। কিম নিজের জন্য কনিয়্যাক আর অতিথির মর্জিমতো ফুলের জুস অর্ডার করে সরাইখানার কোণের দিকে একটা সিংগেল টেবিল নিয়ে বসলেন। তারপর অলোকের চোখের সামনে মেলে ধরলেন এসেক্স থেকে ডাক্তার এলিজাবেথের পাঠানো মেইল।

অলোকেশ অবশ্য শুরুতেই প্রফেসরের ভুল শুধরে দিলেন। কারণ তিনি তাকে ‘হেই ইন্ডিয়ান ডিটেকটিভ’ বলে সম্বোধন করেছিলেন। অলোক বিনয়ী গলায় বললেন, নো প্রফেসর, আ’ম নট ইন্ডিয়ান, আ’ম ফ্রম বাংলাদেশ। অলোকেশ স্বদেশ ভালবাসেন। বাংলাদেশি বলে পরিচয় দিতে তিনি গর্ববোধ করেন। লাল-সবুজের বাইরে বস্তুত তার কোনো ভাললাগা নেই।

তারা কাজের কথায় এলেন। ততক্ষণে ড্রিংকস সার্ভ করা হয়েছে। বাইরে মামুলি বৃষ্টি। লন্ডনের বর্ষণ এমনই। বড্ড মনখারাপ করা, প্যানপ্যানে ব্যাপার। ঝমঝমিয়ে টিনের চাল ফুটো করে বৃষ্টি না হলে কি মজা হয়!

প্রথম কথা হলো— কে এই আলিম বেগ? চিরকুট বলছে, তিনি সিপাহি বিদ্রোহে অংশ নিয়েছেন, বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ খতম করেছেন। তারপর তাকেও গোলার আঘাতে মরতে হয়েছে। সত্যি বলতে, আলিম বেগের সাহস দেখে মনে মনে ভীষণ খুশি অলোকেশ। একেই বলে বাঘের বাচ্চা! ব্যাটা মীর জাফর যদি নবারের সাথে বেইমানিটা না করত!

– আচ্ছা কিম, লিজাকে আপনি আগে থেকে চিনতেন?

– না তো। একদমই না। এই প্রথম মেইল পেলাম। তুমি রাজি থাকলে তার বাড়ি যাব বা তাকে আসতে বলব।

– আহা হা! আবার আমি কেন?

– না মানে তুমি সাথে থাকলে সাহস পাই। দুঁদে গোয়েন্দা বলে কথা। গোঁফের ফাঁক দিয়ে মুচকি হাসেন প্রফেসর কিম। ব্যাটা অলোককে পটাচ্ছে!

– সাহসের তো কিছু নেই। তুমি কি ভাবছো আলিম বেগ হান্টার সায়েব আর ডা. গ্রাহামের মতো তোমাকেও মারবে! কীভাবে! সে নিজেই তো মরে লাশ, থুক্কু, শুকনো খুলি হয়ে গেছে! কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বললেন অলোকেশ। কারণ আলিমকে তিনি স্বজন মনে করছেন।

– না না অলোকেশ, আপনি দয়া করে আরেকবার মেইলখানা পড়েন। দেখুন লিজা কী লিখেছে— তারা দেড়শ বছর পুরনো এই খুলিটি বাড়িতে রাখতে ভরসা পাচ্ছেন না। ভরসার কথা তখনই ওঠে, যখন সেখানে ভয়ের কিছু থাকে, তাই না মিস্টার ডিটেকটিভ!

– হুম!

অলোকেশ প্রফেসর কিমের বিচক্ষণতার প্রশংসা না করে পারছেন না। ঠিক ধরেছেন তিনি। তার মানে এখানে রহস্য আছে। হতে পারে ভয়ংকর কোনো ঘটনা। সবচেয়ে বড় কথা, অলোকেশ স্বচক্ষে সেই চিরকুটখানা দেখতে চান। তিনি ইংরেজিতে কাঁচা নন, ঠিক বুঝবেন। ঠিক হলো, সাথে বিলও যাবেন। প্রফেসর কিম সময় নষ্ট না করে স্মার্টফোন থেকে একটা মেইল করে দিলেন। লিখলেন, তারা কালই আসতে চান। সকাল ১১টার মধ্যে, যদি লিজার কোনো রকম অসুবিধা না থাকে। খুলি আর চিরকুট স্বচক্ষে দেখবেন।

ঝটপট উত্তর এলো। লিজার তরফে কোনো সমস্যা নেই। তিনি ওদের জন্য অপেক্ষা করবেন। জলদি আসার জন্য প্রফেসরকে ধন্যবাদও জানালেন লিজা।

সময় জেনে নিয়ে লিজা তাদের তিন জনের জন্য টিকেট কেটে পাঠাচ্ছেন বলে জানালেন। লন্ডনের লিভারপুল থেকে এসেক্সের নিউপোর্ট অবধি ট্রেন চলাচল করে। সেখানে লিজা গাড়ি নিয়ে হাজির থাকবেন, তাদের পিক করার জন্য। ট্রেনে করে যেতে ঘণ্টা দেড়েকের মতো সময় লাগবে। দূরত্ব চল্লিশ মাইল। জেনে রাখা ভালো, লন্ডন থেকে উত্তর-পুবে যে শহর, ওটাই এসেক্স। এটা মূলত কাউন্টি শহর। এসেক্সের হারউইচ সমুদ্রসৈকতের জন্য বিখ্যাত। চেমসফোর্ড সামার ভ্যাকেশন কাটানোর উপযোগী স্থান। তাছাড়া এসেক্সের উপকণ্ঠে অবস্থিত কোল্সেস্টারে রোমান ও নরমান সভ্যতার অংশবিশেষ এখনও দেখা যায়।

এসেক্স লন্ডনের মতো ব্যস্ত শহর নয়। বলা ভালো শহরতলী। লিজা তার কথা রেখেছেন। নিউপোর্ট নেমেই তাকে দেখতে পেলেন ওরা তিন জন— প্রফেসর কিম ওয়াগনারের সাথে বিল নিক্সন ও অলোকেশ রয়। ট্রেন স্টেশন থেকে লিজার বাসা পাথর ছোড়া দূরত্ব। লিজার বাসায় পৌঁছে হালকা রিফ্রেশমেন্ট সেরে আসল কথা পাড়লেন কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের প্রফেসর কিম।

কই, আনুন দেখি সেই খুলি আর চিরকুট।

লিজা ভেতরে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি কাঠের বাক্স নিয়ে বসার ঘরে এলেন। ওক উডের তৈরি বাক্স। যদিও ততটা শক্ত নয়, কিন্তু আসবাব বানাতে ওক উডের জুড়ি নেই। ইচ্ছামতো একে বাগানো ও বাঁকানো যায় আর কী!

খুলি আর কই! এর তো কিছুই নেই দেখছি! গোটাকয়েক দাঁত আর তালু— প্রফেসর বললেন। তিনি বোধহয় কিছুটা হতাশ। অলোকেশের তা নজর এড়ালো না। বিল নিক্সন আলিম বেগের খুলি ছুঁয়েও দেখলেন না। তার নাকি মড়া মানুষের হাড়গোড় দেখতে মোটেও ভালো লাগে না। এ ব্যাপারে তার বিশেষ শুচিবায়ু আছে।

অলোকের কিন্তু আবেগ বা আগ্রহের কিছু কমতি নেই। তিনি অনেকক্ষণ সময় নিয়ে খুলিটা দেখলেন। গন্ধ নিলেন। বুকে জড়ালেন। গোয়েন্দা বলে নয়, আপনবোধে। অনেক পুরনো খুলি, দেখলেই বোঝা যায়। রঙটা একেবারে মলিন হয়ে গেছে। সেই সাদাটে বা হলুদাভ ভাবটা আর নেই। মাড়ির ওপরের দাঁতগুলো নিশ্চয়ই গোলার আঘাতে খুলে পড়ে গেছে! নিচের দিকে কয়েকটা আছে। ইস, কত কষ্টই না পেয়েছিলেন দেশপ্রেমিক আলিম বেগ! আহা!

প্রফেসর চিরকুট দেখছেন। তাতে আলিম বেগের নাম-পরিচয় ছাড়া আর কিছু নেই। দু’জন ইংরেজের কথা অবশ্য উল্লেখ আছে, যাদের তিনি গুলি করে মেরেছেন— মিশনারি হান্টার আর ডা. গ্রাহাম। এ দু’জনই তখন শিয়ালকোটে থাকতেন।

এবার বলুন, ভয়ের কী আছে মিস লিজা? প্রফেসর সরাসরি তার চোখের দিকে তাকালেন। বোঝার চেষ্টা করছেন, দেড়শ বছর পুরনো খুলির পেছনে আসল রহস্যটা কী!

উৎকর্ণ হয়ে আছেন অলোকেশ রয়। তিনিও জানতে চান, কেন এলিজাবেথ এই খুলির বিষয়ে এত দিন পরে হঠাৎ তৎপর হলেন। কী সেই ঘটনা!

কিছুক্ষণ গড়িমসি করে শেষে লিজা যা বললেন তা রীতিমতো হাস্যকর! আর যদি তার কথা সত্যি হয়, তাহলে তাকে ভয়ংকর বললেও কম বলা হয়।

লিজা জানালেন, রাতের কোনো এক সময় এই খুলি বাক্স থেকে বেরিয়ে আসে এবং পূর্ণ চেহারা পায়। না না, মানুষ বা সিপাহি না, একটা কঙ্কাল হয়ে ওঠে আলিম বেগের খুলি।

তারপর! কে কে দেখেছে এই দৃশ্য? রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলেন প্রফেসর কিম ওয়াগনার।

আর কেউ না, শুধু আমি। লিজা বললেন। তার চোখের কোলে ভয়। মনে হলো যেন তিনি কাঁপছেন। অথচ ঘরের ভিতর শীত নেই। মিহি শব্দে রেডিয়েটর চলছে।

আপনাকে কি সে আক্রমণ করেছে কখনো? এবার প্রশ্ন করলেন বিল নিক্সন। তিনি স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চৌকস অফিসার। ডেপুটি সার্জেন্ট।

নো নো। নেভার অ্যাটাক্ড। একটু থেমে লিজা আবার বললেন। তার তো দরকার পড়েনি কোনো। ভয়েই আমি মূর্ছা যাই। সকাল অবধি সেখানেই পড়ে থাকি। পরে আমার স্বামী পানি ছিটিয়ে আমাকে স্বজ্ঞান করে।

হুম! প্রফেসর কিম সময় নেন একটু। তারপর বললেন, গল্পটা বেশ ভালোই ফেঁদেছেন ডক্টর। আমি অবশ্য একটু আধটু হরর মুভি দেখি। খুব যে ভক্ত, তা নয়। তবে আপনার এই উপাখ্যান দিয়ে সিনেমা না হোক, ট্রেলার অন্তত হবে। মিস লেডি আলফ্রেড হিচকক!

লিজা কিন্তু এই তামাশায় যোগ দিলেন না। তিনি সত্যি সত্যিই কাঁপছেন। কারণ খুলিটা তখনো তার সামনে পড়ে আছে। স্পষ্টই বোঝা যায়, প্রফেসর কিম ওয়াগনার লিজার কথার একবর্ণও বিশ্বাস করেননি। বিলও নয়। কিন্তু অলোকেশ! তিনি কী করে বিশ্বাস করবেন! তিনি তো সত্যান্বেষী! ডিটেকটিভ!

লাঞ্চ না করেই লন্ডন ফিরে যান প্রফেসর কিম ও বিল নিক্সন। শহরটা একটু ঘুরে দেখার কথা বলে থেকে যান অলোকেশ রয়। তিনি লিজার সাথে মধ্যাহ্নভোজন করবেন। এমনটাই বন্দোবস্ত হলো। খাওয়া-দাওয়া উছিলা মাত্র, অলোকেশ প্রকৃত ঘটনা খতিয়ে দেখতে চান। একজন মানুষ কতটা কল্পনাপ্রবণ হতে পারে, তাও তার জানা দরকার। সত্যিই কি লিজা গল্প ফেঁদেছে!

লাঞ্চের পরে লাঞ্ছনার শুরু। এবার বলুন মিস লিজা, আপনার কী মনে হয়, কেন এই খুলিটা শুধু আপনাকেই ভয় দেখাচ্ছে! আপনার স্বামী কখনো দেখেছেন?

না, তা দেখেননি?

তবে কি আপনার মনের ভুল বা চোখের?

একদম নয় মিস্টার ডিটেকটিভ। আমি যা বলছি তার পুরোটাই সত্যি। একবর্ণও মিছে নয়। বেশ জোর দিয়ে বললেন ডক্টর লিজা।

নির্দিষ্ট কোনো সময় বা তারিখ আছে লিজা, যখন খুলি কঙ্কালের রূপ নেয়! বা আপনাকে ভয় দেখায়!

না, তা নেই। তবে বাড়িতে অন্য কেউ থাকলে খুলি বাক্সেই থেকে যায়। বেরোয় না। সে আমাকেই টার্গেট করেছে। লিজা বলল, বলতে বলতে প্রায় কেঁদেই ফেলল।

হুম! অলোকেশ দ্রুত কিছু একটা ভাবলেন। পয়েন্ট টু বি নোটেড! মড়ার খুলি লিজাকে ভয় দেখিয়ে মজা পায়। শি ইজ দ্য টার্গেট।

আচ্ছা বলুন তো, এই খুলি আপনার বাড়িতে এলো কী করে? প্লিজ একটু ভেবে তারপর বলুন। অলোকেশ সাগ্রহে লিজার দিকে তাকালেন।

ঠিক জানি না। তবে শুনেছি, গোড়া থেকেই আমাদের বাড়িতে এটা ছিল। ইট কেম ফ্রম মাই গ্রেট গ্র্যান্ড ফাদারস।

গুড, ভেরি গুড। এবার একটু ভেবে বলুন, আপনাদের বংশের কেউ কি কখনো ব্রিটিশ ভারতে থাকতেন? মানে দুশ বছর বা তারও আগে?

লিজা মাথা চুলকান। এপাশ ওপাশ মাথা নাড়েন। মানে তার ঠিক জানা নেই। অলোকেশ ঝটপট কথিত আলিম বেগের আংশিক খুলি ও চিরকুটের স্ন্যাপশট তুললেন। তারপর লিজাকে একটা জটিল হোমটাস্ক ধরিয়ে দিয়ে উঠে পড়লেন লন্ডনগামী ট্রেনে। কাজটা হলো— লিজার পিতামহ ও প্রপিতামহের ঠিকুজি-কুষ্ঠি খুঁজে বের করা। তাহলেই কেবল এই খুলিরহস্য উদ্ধার করা সম্ভব!

০৩.

ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম, ক্রমওয়েল রোড, কেনসিংটন, লন্ডন। কিউরেটর ড. রমনজির দফতরে বসে আছেন অলোকেশ। তিনি আলিম বেগের খুলির বিষয়ে জানতে এসেছেন। রমনজিকে ছবি দেখালেন। সাথে চিরকুটের বয়ান।

এই প্রকৃতি জাদুঘর কোনো মামুলি প্রতিষ্ঠান নয়। এখানে না আছে হেন জিনিস নেই। সে এক এলাহি কারবার। কিউরেটর সাহেব মিনিট কুড়ি নথিপত্র ঘেঁটে বলে দিলেন, আলিম বেগের এই ঘটনা নথিবদ্ধ আছে। তবে কীভাবে তার মৃত্যু হয়েছে, তা তিনি জানেন না। অলোকেশকে তিনি একটি সুপরামর্শ দিলেন। বললেন, আপনি বরং এক কাজ করুন, আলিম বেগের গুলিতে যাদের প্রাণ গেছে বলে শুনেছেন, সেই হান্টার সাহেব আর ডা. গ্রাহামের আত্মীয়-স্বজনদের খুঁজে বের করুন। এটা হয়তো আপনার কোনো কাজে আসবে।

‘থ্যাংক ইউ রমনজি ফর ইওর কাইন্ড সাজেশন্স।’ বেরিয়ে এলেন অলোকেশ।

এবার গেলেন তিনি ব্রিটিশ গ্রন্থাগারে। কিংসক্রস ট্রেন স্টেশনের খুব কাছেই। সেখানে লাইব্রেরিয়ান মিস মার্থার হেল্প নিলেন তিনি। ‘সেপয় মিউটিনি’র ওপর কয়েকটা বই চেয়ে নিয়ে পড়তে থাকলেন। অ্যালফাবেট ধরে পড়তেই উঠে এলো আলিম বেগের নাম। ব্রিটিশ হিস্টোরিয়ান তাকে যে খুব উচ্চ মর্যাদায় দেখিয়েছেন তা নয়, কিন্তু অলোক এক নিশ্বাসে পুরোটা পড়ে ফেললেন। বোঝা গেল, লিজার বাড়িতে পাওয়া খুলিটা আর যাই হোক বেওয়ারিশ নয়। ১৮৯৯ সালে প্রকাশিত সেই বইয়ের সূত্র ধরে পাওয়া গেল একজনের নাম— অ্যান্ড্রু গর্ডন। তিনি একজন মিশনারি। সম্ভবত ১৮৫৭ সালে আলিম বেগের হাতে খুন হওয়া হান্টারের সাথে তার কোনো যোগসূত্র থাকতে পারে। বেশকিছু মালমশলা পেয়ে গেলেন অলোকেশ। গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে তার একজন ফুলটাইম ইতিহাসের ছাত্র হতে মন চাইছে।

এ সংক্রান্ত পুরনো পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে আরও কিছু তথ্য পেলেন অলোকেশ। ১৯১১ সালে প্রকাশিত ‘স্ফিয়ার’ নামের একটি পত্রিকায় আলিম বেগের বিষয়ে প্রতিবেদন আছে। এর সাথে লিজার চিরকুটের হুবহু মিল পাওয়া যায়। রিপোর্টে জানা যায়, ১৮৫৮ সালে ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পদাতিক বাহিনীর ১৯ জন সিপাহিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মধ্যে একজন হয়তো আলিম বেগ। কিন্তু চিরকুট বলছে, গোলার আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল তার। কোথায় যেন একটু ফাঁক থেকে যায়!

পরদিন সকালেই ট্রেনে চাপলেন অলোকেশ। তাকে যেন নিশিতে পেয়েছে! উত্তর লন্ডনের ব্রেন্ট ক্রসের একটি বাড়ি। অনেকদিন পরিত্যক্ত পড়েছিল। যেন হানাবাড়ি। তবে এখন আবার জনমানব এসেছে। প্রাণ ফিরে পেয়েছে বাড়িটি। কে থাকেন এখানে? এন্ড্রু গর্ডনের নাতি-নাতনি।

বাড়ির বাইরে প্রচুর আইভি লতা আর উইসটেরিয়ার ঝোঁপ। অলোকেশ বেল চাপলেন। একবার, দু’বার, তিনবার! শেষে বেরিয়ে এলেন এক বুড়ি। বয়স তার সত্তরের কম নয়। চামড়া সব কুঁচকে গেছে, ঘোলাটে চোখের দৃষ্টি। তবে দাঁত একটাও পড়েনি, নাকি বাঁধানো জিনিস!

অলোকেশ নিজের পরিচয় দিলেন। কিন্তু তাতে বুড়ির কোনো ভাবান্তর হলো বলে মনে হয় না। আন্দাজে ঢিল ছুঁড়লেন অলোকেশ। মৃদু কেশে বললেন, আমি আপনার দাদু মানে হান্টার সাহেবের কথা জানতে চাই।

অমনি দপ করে জ্বলে উঠলেন বুড়ি। তুমি কী করে তাকে চিনলে বলো তো! উইলিয়াম হান্টার! তিনি ছিলেন একজন অসম সাহসী মহাবীর। ইন্ডিয়ান সেপয় মিউটিনির সময় তিনি আততায়ীর গুলিতে নিহন হন বলে শুনেছি।

আচ্ছা ম্যাডাম, তুমি কি জান কে তাকে গুলি করেছিল?

এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়ে বুড়ি। মানে সে জানে না। নিশ্চয়ই এমন কেউ যে কি না ইংরেজ রাজত্ব পছন্দ করত না— বুড়ি মন্তব্য করল। এখানে নতুন কিছু পাওয়ার নেই বুঝে সটকে পড়লেন অলোকেশ। পথে ফোন বাজে তার। কার ফোন? প্রফেসর কিম নাকি ডেপুটি সার্জেন্ট বিল নিক্সন? না না, তারা কেউ নন। ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে মিস মার্থা। উত্তেজিত স্বরে বলল, তুমি কি একবার আসতে পারবে! এক্ষুনি?

কেন বলো তো? এনিথিং সিরিয়াস!

হাতে সময় থাকলে এসো। হতাশ হবে না বোধ করি। মার্থা ফোন রেখে দিল। অলোক বুঝলেন, নিশ্চয়ই আলিম বেগের ব্যাপারে নতুন কোনো তথ্য জোগাড় করেছে মার্থা। মেয়েটা সত্যি ভালো। খুব হেল্পফুল। মেয়েরা ভালোই হয়! ব্রেন্টক্রস থেকে আন্ডারগ্রাউন্ড টিউব ধরে সোজা কিংসক্রস। এখানে একটা বইয়ের দোকান আছে। যেকোন বই মাত্র দুই পাউন্ড। কী ভীষণ সস্তা!

ব্রিটিশ লাইব্রেরি ঢুকতেই মার্থা সহাস্যে এগিয়ে এলো। এই নাও একখানা জবরদস্ত বই। ‘দ্য স্কাল অফ আলিম বেগ’। আমি কিছু জায়গা মার্ক করে রেখেছি। পুরোটা পড়তে হবে না। হাইলাইটেড অংশটুকু পড়ো আপাতত। ব্যস, অলোক অমনি নাওয়া-খাওয়া ভুলে বই নিয়ে বসে গেল।

বই থেকে জানা যায়, আলিম বেগ ভারতের উত্তরাঞ্চলের সুন্নি মুসলিম সম্প্রদায়ের একজন ছিলেন। তার কাজ ছিল কঠোর নিয়ম মেনে ক্যাম্প পাহারা দেওয়া, চিঠি বহন করা, রেজিমেন্টের বড় অফিসারদের ফুটফরমাশ খাটা। আর তার খুলিটি যুক্তরাজ্যে যে নিয়েছিল, তার নাম জর্জ ক্যাস্টেলো। তার জন্ম আয়ারল্যান্ডে। ১৮৫৭ সালেই তাকে সেনা কম্যান্ড হিসেবে ভারতে পাঠানো হয়। ১৮৫৮ সালের অক্টোবরে ভারত থেকে যুক্তরাজ্যগামী জাহাজে চড়ে ক্যাস্টেলো দেশে ফিরে আসেন।

তার মানে কী দাঁড়ালো— ক্যাস্টেলোই কি আলিম বেগের মৃত্যুর জন্য দায়ী! উঁহু! তা কী করে হয়! একজন মামুলি কমান্ডার কি কারও মৃত্যুপরোয়ানা জারি করতে পারে!

০৪.

আরও দু’টো দিন কেটে গেল। প্রফেসর কিম নিজ উদ্যেগে অলোকের সাথে যোগাযোগ রেখেছেন। এই অবধি আলিম বেগ সম্পর্কে যতটুকু তিনি জেনেছেন, কিমের সাথে তা শেয়ার করলেন। কিম এবার সত্যি ভাবনায় পড়ে গেলেন। তার মানে আলিম বেগের কাহিনি স্রেফ গালগপ্পো নয়। এটা সত্যি। কিন্তু তাই বলে দেশড় বছর আগেকার খুলি মধ্যরাতে কঙ্কাল হয়ে কাউকে ভয় দেখাবে! এ কী করে সম্ভব! এসেক্সের ডাক্তার লিজার সাথে কি তবে আলিম বেগের মৃত্যুর কোনো যোগসূত্র আছে! এমন কি হতে পারে, লিজার বংশের কেউ তখন শিয়ালকোট ছিলেন! তিনিই হয়তো….! মনের কথা মনে চেপে রাখলেন প্রফেসর কিম ওয়াগনার। তিনি ইতিহাসবিদ, তবে দেশদ্রোহী নন। অলোকেশের কাছে তার এই ভাবনার কথা কিছুতেই ফাঁস করবেন না কিম।

এসেক্স থেকে লিজার ফোন এলো এর ঠিক পরদিন। লিজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলল, ইউ সেভ মি অলোক। আমি আর পারছি না। ভয়ে আমি মরেই যাব।

তুমি বরং এক কাজ করো এলিজাবেথ। মড়ার খুলিটা আস্তাকুঁড়ে ফেলে দাও বা অন্য কাউকে দিয়ে দাও। তাহলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশি— বুদ্ধি দেন অলোকেশ।

তা কি আমি করিনি ভেবেছো! তাতে উল্টো ফল হয়েছে। মানে হিতে বিপরীত!

উল্টো ফল! সে আবার কী! ভেঙে বলো লিজা। জানো তো, গোয়েন্দা, উকিল আর ডাক্তারের কাছে কথা লুকোতে নেই।

আবারও কাঁদতে বসলো লিজা। বলল, দুই দুইবার আমি এই খুলি বাড়ির বাইরে রেখে এসেছিলাম। তবে বাক্স ফেলিনি। সেই রাতেই খুলি আবার কঙ্কাল হয়ে এসে আমাকে ভয় দেখায়। অন্যান্য রাতের চেয়ে আরও বেশি ভয়ংকর হয়ে ওঠে মড়ার খুলি। দেখে পিলে চমকে যায়। আমি জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফিরলে দেখি খুলিটা দিব্যি বাক্সর মধ্যে রাখা আছে।

তার মানে তুমি বলতে চাও ওটা নিজের থেকে ফিরে এসেছে! তাও আবার বাক্সের মধ্যে! অলোকের যেন ঠিক বিশ্বাস হয় না। এ কেমন হেঁয়ালি! সায়েবরা ভূতে বিশ্বাস করে জানি, তাই বলে এতখানি! সোজা পেয়ে লিজা মেয়েটাকে কেউ আবার বোকা বানাচ্ছে না তো! অলোক বললেন, কিচ্ছু ভেব না লিজা। আমরা আসছি। কাল বিকেলের ট্রেনে। সারা রাত থাকব। তুমি নিউপোর্ট স্টেশনে গাড়ি নিয়ে এসো।

সাথে সাথে বিলকে ফোন করলেন ডিটেকটিভ অলোকেশ। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ডেপুটি সার্জেন্ট বিল নিক্সন। লিজার কথা খুলে বললেন তিনি। এও বললেন যে আলিম বেগ কোনো কল্পগল্প নয়। ব্রিটিশ লাইব্রেরি থেকে মার্থার মাধ্যমে পাওয়া বইয়ের কথাটাও তাকে জানালেন। উইলিয়াম হান্টারের নাতনি সেই বুড়ির কথাও বাদ গেল না।

বিল বলল, না না ভায়া, আমি যাব না। ভুলেও আর ওমুখো হচ্ছি না।

কেন, কেন বলো তো বিল!

এর উত্তরে বিল একটা মজার কথা বলল। সে বলল যে, ভূতে তার প্রচণ্ড ভয়। বিল নিশ্চিত, ওই খুলিতে ইন্ডিয়ান ভূত ভর করেছে। এই ভূত বড়ই খতরনাক হয়। সায়েবরা মরে যে ভূত হয়, আলম বেগের কাছে তা স্রেফ নস্যি। বিলের কথা শুনে বেজায় হাসলেন অলোকেশ। মনে মনে ভাবলেন, যাক, এতদিনে তাহলে বুঝলে যে আমাদের সাথে টক্কর দেওয়া তোমাদের কম্মো নয়! নেহাতই মীর জাফরের মতো কিছু পাপীষ্ঠ ছিল তাই তোমরা কিছুদিন করে খেয়েছ।

পরদিন এসেক্সের উদ্দেশ্যে রওনা হন অলোকেশ। এবার তিনি চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করবেন। প্রফেসর কিমের ভূতের ভয় নেই। তিনি সহজেই রাজি হলেন। বিলকেও বগলদাবা করে নিয়ে চললেন কিম। এই বলে টুপি পরালেন, বিল তুমি না চৌকস পুলিশ অফিসার। তোমার ভূতের ভয় আছে শুনলে লোকে কী ভাববে বলো তো! কেউ কি আর তোমাকে মান্যিগণ্যি করবে!

সন্ধ্যের আগে আগে এসেক্স পৌঁছলেন অলোকেশ ও তার টিম। লিজা অবশ্য বলেই দিয়েছে, আজ রাতে আর আলিম বেগের খুলি তাকে ভয় দেখাবে না। কারণ ভূতেরও প্রাণের ভয় আছে। বেশি মানুষ দেখলে সে ঘাবড়ে যায়। কথা মিছে নয়। সেই রাতে কিন্তু খুলি আর বাক্স ছেড়ে বেরোল না। তবে একটা অভিজ্ঞতা অলোকের হয়েছে। তিনি বুঝে গেছেন, সত্যিই খুলির সাথে লিজার কিছু একটা জোরালো সম্পর্ক আছে। আলিম বেগ মরেও তার খুনির বংশধরদের ছাড়বে না।

লিজার বাড়ির স্ট্যাকরুমে অলোক একটা জিনিস খুঁজে পেলেন। ব্রোঞ্জের তৈরি পাঞ্জা, নাকি র‌্যাংকব্যাজ।

এটা কার বলো তো?

লিজা প্রথমে কিছু বলতে পারল না। পরে ভেবে জানাল, হতে পারে তার দাদুর বাবার সময় থেকে এটা এসেছে। তিনি ব্রিটিশ আর্মিতে চাকরি করতেন!

কী যেন ভাবলেন অলোকেশ। তারপর বললেন, তুমি কি তোমার দাদু বা বাবার মুখে জর্জ ক্যাস্টোলোর কথা কখনো শুনেছ?

আবারও ভাবতে থাকে লিজা। শেষে ঝড়ের বেগে মাথা নেড়ে বলল, ইয়েস আই হার্ড। বাট তুমি জানলে কী করে!

আই নো লিজা। হিসাবটা প্রায় মিলে গেছে। তুমি বরং এক কাজ করো লিজা। এই বাড়িটা ছেড়ে দাও। খুলিটা এখানেই পড়ে থাক বাক্সবন্দি হয়ে। আলিম বেগের খুলি তোমাকে সহজে ছাড়বে না। কী জানি, হয়তো জীবনভর তোমাকে জ্বালাবে।

পরের কথাটুকু আনমনে বললেন অলোকেশ। আরও বললেন, তোমার বংশের কেউ নিশ্চয়ই ১৮৫৮ সালে শিয়ালকোটে আলিম বেগের মৃত্যুপরোয়ানা শুনিয়েছিল। তাই এই খুলি তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। নিতেই থাকবে।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন