বিজ্ঞাপন

জাপানি নাগরিক হত্যা: ৬ বছরেও শেষ হয়নি বিচার

June 22, 2022 | 8:51 am

আরিফুল ইসলাম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০১৫ সালের দিকে ৯০ দিনের ভিসায় ঢাকায় আসেন জাপানি নাগরিক হিরোই মিয়াতা। পোশাক ব্যবসায়ীদের গাইড হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন। তবে ব্যবসার সুবাদে পরিচয় হয় স্টক লট ব্যবসায়ী জাকিরের সঙ্গে। জাপানি নাগরিক হওয়ার সুবাদে ব্যবসায় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে— এমন লোভে হিরোই মিয়াতারের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেন তিনি। এই ধারাবাহিকতায় ওই বছরের ২৬ অক্টোবর জাকিরসহ কয়েকজন কৌশলে হিরোই মিয়াতাকে অপহরণ করে আটক করা হয়। আটকের তিনদিন পরে তাকে হত্যা করে গোপনে উত্তরার একটি কবরস্থানে দাফন করেন আসামিরা।

বিজ্ঞাপন

নিখোঁজের পর ওই বছরের ১৯ নভেম্বর জাপানের এক কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। আসামিরা নাটক সাজিয়ে ১২ নম্বর সেক্টরের খালেরপাড় কবরস্থানে ভিকটিমের দাফনের কাজ শেষ করেন। ওই ঘটনায় উত্তরা (পূর্ব) থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান হাওলাদার বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দায়েরের ৬ বছর শেষ হলেও এখনো বিচার শেষ হয়নি। তবে কবে নাগাদ বিচার শেষ হবে তা বলছে পারছে সংশ্লিষ্টরা।

বর্তমানে মামলাটি ঢাকার ৪র্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আল-মামুনের আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। সর্বশেষ গত ২৯ মে মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ধার্য ছিল। ওইদিন দুইজনের সাক্ষ্য শেষ আগামী ২৮ জুলাই পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন।

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম হেলাল বলেন, পুলিশ সাক্ষীদের আদালতে হাজির করতে না পারার কারণেই সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হচ্ছে না। আদালত থেকে সাক্ষীদের প্রতি সমন পাঠানো হয়। পুলিশের দায়িত্ব সাক্ষীদের হাজির করা। কিন্তু তারা তা করছেন না। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে প্রস্তুত রয়েছি সাক্ষ্য শেষ করার। সাক্ষীরা আদালতে হাজির হলে আশা করছি, মামলাটির বিচার দ্রুত শেষ হবে।

বিজ্ঞাপন

মামলা সম্পর্কে আসামিপক্ষের এক আইনজীবী জায়েদুর রহমান বলেন, জাপানি নাগরিক হিরোই মিয়াতা বার্ধক্যজনিত কারণে মারা গেছেন। অথচ আসামিদের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা হচ্ছে তারা হত্যা করেছেন। আসলে এখানে হত্যাকাণ্ডের কোনো ঘটনা ঘটেনি। আসামিরা উপকার করতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়েছে। হিরোই মিয়াতার বৈধ পাসপোর্ট ছিল, আসলে এখানে কোনো হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। তার স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। মামলাটির সাক্ষ্য চলছে। আশা করছি, আসামিরা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।

জানা যায়, ডা. বিমল চন্দ্র শীল ওই নারীর চিকিৎসা করছিলেন। জাপানের ওই নারী ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশে বাস করছিলেন। পোশাক ব্যবসায়ীদের গাইড হিসেবে কাজ করতেন তিনি। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও তিনি বাংলাদেশে ছিলেন। উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরের ১৩/বি নম্বর সড়কের ৮ নম্বর হোল্ডিংয়ের সিটি হোমসে থাকতেন। ওই বছরের আগস্টে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার একটি বাসায় যান তিনি। ২৬ অক্টোবর থেকে তার ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ পায় তার পরিবার। এরপর তার মা ঢাকার জাপানি দূতাবাসকে জানান। ১৯ নভেম্বর জাপানের এক কর্মকর্তা উত্তরা পূর্ব থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন।

আরও জানা যায়, ওই বছরের ২৫ অক্টোবর থেকে ওই নারী অসুস্থ ছিলেন। তাকে দোকান থেকে ওষুধপত্র এনে খাওয়ানো হয়। পরে ২৯ অক্টোবর তাকে হত্যা করা হয়। ওই দিনই আসামি মারুফুল ইসলাম হালিমা খাতুন পরিচয়ে উত্তরা ১২ নম্বর সেক্টরের খালেরপাড় কবরস্থানে হিরোই মিয়াতাকে দাফন করেন।

বিজ্ঞাপন

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৬ অক্টোবর আসামিরা কৌশলে হিরোই মিয়াতাকে অপহরণ করে আটকে রাখে। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর তাকে হত্যা করে গোপনে উত্তরার একটি কবরস্থানে দাফন করে আসামিরা। ওই ঘটনায় উত্তরা-পূর্ব থানার পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান হাওলাদার বাদী হয়ে ঘটনার প্রায় এক মাস পর ২২ নভেম্বর মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করে সংশ্লিষ্ট থানার অফিসার ইনচার্জ আবু বকর মিয়া ২০১৬ সালের ৩০ জুন ছয়জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন।

আসামিরা হলেন— এইচ এম জাকির হোসেন পাটোয়ারী ওরফে রতন, তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, মারুফুল ইসলাম, রাশিদুল ইসলাম বাপ্পি, ফখরুল ইসলাম ও ডা. বিমল চন্দ্র শীল। ওই বছরের ৩ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। এখন পর্যন্ত মামলাটিতে ২৯ জন সাক্ষীর মধ্যে ১২ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়েছে। মামলার আসামিরা সবাই জামিনে আছেন।

তদন্ত কর্মকর্তা চার্জশিটে উল্লেখ করেন, জাপানি নাগরিক হিরোই মিয়াতা ২০০৬ সালের ২৬ মে তৎকালীন জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তার পাসপোর্টে ওই বছরের ৪ মে থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত ৯০ দিনের ভিসার মেয়াদ ছিল। ধারণা করা যায় যে, ২০০৬ সালের ২৬ মে থেকে মৃত্যুকালীন সময় পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশেই ছিলেন। আসামি জাকির হোসেনের সঙ্গে পরিচয়ের আগ পর্যন্ত তিনি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময় বাস করেন। জাকির ডেভলপার ও স্টক লটের ব্যবসা করতেন। হিরোই মিয়াতার ঘটনার আনুমানিক আড়াই বছর আগে যেকোনো সময় জাকিরের অফিসে যান। সেখানে জাকিরের সঙ্গে তার আলাপচারিতা হয়। এক পর্যায়ে জাকিরের মাধ্যমে স্কট লট ব্যবসা করার জন্য আলোচনা হয়। ভিকটিম জাপানি নারী নাগরিক হওয়ার সুবাদে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুফল পাওয়া যাবে ভেবে জাকির তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলে। এরপর জাকির হিরোই মিয়াতাকে তার নিয়ন্ত্রণে এনে উত্তরা পূর্ব থানাধীন সিটি হোমস হোটেলে রাখেন। হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ভিকটিমের থাকা খাওয়ার সমুদয় বিল জাকির পরিশোধ করবে মর্মে নিশ্চয়তা প্রদান করে। জাকির ও মারুফ মাঝে মাঝে হোটেলে এসে ভিকটিমের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতেন এবং হোটেল বিলের টাকা কিছু কিছু পরিশোধ করতেন। ভিকটিমের হাত খরচ বাবদ কিছু কিছু টাকা পরিশোধের পরও প্রায় ৬ লাখ টাকা হোটেলে বকেয়া ছিল। হোটেল কর্তৃপক্ষ মাঝে মাঝে পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য জাকির ও মারুফকে চাপ দিতেন। আসামি রাশেদুলও মাঝে মাঝে ওই হোটেলে গিয়ে লবিতে বসে ভিকটিমের সঙ্গে পরিচয় থাকার কারণে গল্প করতেন। ২০১৫ সালের ২৮ আগস্ট রাশেদুল হোটেলে যায়। দীর্ঘক্ষণ কথা বলে ভিকটিমের ব্যবহার্য জিনিসপত্র ব্যাগে ভরে ভিকটিমকে একটি রিকশায় করে বের হয়ে যায়। এরপর রাশেদুলের অফিসে তাকে নিয়ে এসে খাবার খাইয়ে আজমপুর পর্যন্ত এনে ভিকটিমকে জাকির ও মারুফের ব্যবহৃত গাড়িতে তুলে দেয়। তারা ভিকটিমকে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরিয়ে অবশেষে জাকিরের পূর্ব পরিচিত ফখরুলের ভাটারা থানাধীন বসুন্ধরা এলাকায় বাসায় এনে আটকে রাখে। আসামিরা তার ব্যবহৃত ল্যাপটপ, মোবাইল ও অন্যান্য ব্যবহৃত জিসিনপত্র চুরি করে নেয়। এরপর জাকির হোসেন, তার ভাই জাহাঙ্গীর হোসেন, মারুফ, ফখরুল, রাশেদুল জাকিরের পূর্ব পরিচিত ও ঘনিষ্ট ডা. বিমল পূর্ব পরিকল্পিতভাবে ২৯ অক্টোবর রাতে ভিকটিমকে হত্যা করে।

এরপর তারা লাস গুম করার সিদ্ধান্ত নেয়। সকলের দৃষ্টি এড়িয়ে গাড়িতে করে মারুফের বাসা থেকে উত্তরা পশ্চিম থানাধীন ১২ নং সেক্টরস্থ ১২ নং রোডের ৩৩ নং বারি পার্কিং এ এনে গোছল করিয়ে কাফনের কাপড় পড়ায়। তারা লোকজনের কাছে প্রকাশ করে, লাশটি মারুফের নানী হালিমা খাতুনের। তিনি বার্ধক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর আসামিরা ভিকটিমের প্রকৃত নাম, ঠিকানা, তথ্য গোপন করে ২৯ অক্টোবর বিকেল বেলা লাশ কবর দেয়। মৃত্যুর আগে ভিকটিম প্রতি সপ্তাহে তার মায়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন। ২৬ অক্টোবরের পর মায়ের সঙ্গে কথা না বলায় এবং ফোন বন্ধ পাওয়ায় ভিকটিমের মা বিষয়টি জাপান অ্যাম্বাসিকে অবগত করে। জাপান অ্যাম্বাসি বিষয়টি থানায় অবগত করে। এরপর পুলিশ মামলাটি তদন্ত করে ঘটনা উদঘাটন করে।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/এআই/এনএস

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন