বিজ্ঞাপন

সড়কে অনিয়ন্ত্রিত রিকশা, রোজায় ভয়াবহ যানজটের শঙ্কা

March 24, 2023 | 11:17 am

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সরকারি হিসেবে ৩০৫.৪৭১ বর্গ কিলোমিটারের রাজধানী ঢাকার মোট বাসিন্দা ১ কোটি ২ লাখ ৭৮ হাজার ৮৮২ জন। বিপুল সংখ্যক এই জনগণের চলাচলের জন্য এখনও গড়ে ওঠেনি টেকসই গণপরিবহন ব্যবস্থা। ব্যক্তিগত গাড়ি, সিএনজি, ট্যাক্সিক্যাব, হিউম্যান হলারের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মানুষকেই তাই রিকশার মত অযান্ত্রিক যানবাহনের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে এই রিকশাই হয়ে উঠেছে গলার কাঁটা।

বিজ্ঞাপন

রাজধানী ঢাকার দুয়েকটি ভিআইপি সড়ক বাদে পুরো শহরজুড়েই রিকশা, যার অধিকাংশ চালকই ট্রাফিক আইন জানেন না ও মানেন না। ফলে ভোগান্তিতে পড়েন অন্য গাড়ির চালক ও সাধারণ মানুষ। রোজায় এই যানজট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

নগরবিদরা জানান, ঢাকায় রিকশার কারণে সৃষ্ট চলাচলে অসুবিধার জন্য রিকশাচালকদের আইন না মানা, শহরে নতুন এসেই রিকশা নিয়ে নেমে পড়া, রিকশা নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের অবহেলাও দায়ী।

অন্য যানবাহনের চালকরা যা বলছেন
রাজধানীর শিকড় বাসের চালক মো. হারুন বলেন, ‘রিকশার কারণে গাড়িই চালানো যায় না। একে তো গতি কম, তার ওপর আবার উল্টাপাল্টা চলে। যার কারণে যানজট সৃষ্টি হয়, দুর্ঘটনা ঘটে।’

বিজ্ঞাপন

আজমেরী গ্লোরী বাসের চালক মো. সালাম বলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যানজটের মূল কারণ রিকশা। মেইন রাস্তা থেকে রিকশা উঠায়া না দিলে, সরকার যত কিছুই করুক যানজট কমবে না।’

নিজের প্রাইভেট কার নিজেই চালান উন্নয়নকর্মী ও লেখক সাদিয়া নাসরীন। ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে থাকেন তিনি। নিজ অফিস, সন্তানদের স্কুল ও অন্যান্য জায়গায় আনা-নেওয়ার কাজ নিজেই করেন। ফলে রাজধানী ঢাকার বড় একটি এলাকায় তাকে প্রতিদিন চলাচল করতে হয়। ক্যান্টনমেন্ট এলাকার মধ্যে যতটা স্বস্তিতে চলাচল করেন, বের হলেই ভোগান্তিতে পড়েন বলে জানান তিনি। বলেন, ‘আমার গাড়িতে যত ডেন্ট তার প্রায় সবটাই রিকশার থেকে পাওয়া। তারা কোনো ট্রাফিক আইন মানে না। হুট করে কোথা থেকে সামনের ওপর চলে আসে যার ফলে সারাক্ষণ দুর্ঘটনার আতঙ্কে থাকতে হয়। এছাড়াও রিকশার কারণে দুর্ঘটনা এড়াতে গতিও সবসময় কম রাখতে হয়। এর ফলে অনেক সময় নষ্ট হয়।’

মোটরসাইকেল চালক আশরাফুল আলম বলেন, ‘ঢাকায় রিকশার জন্য ঠিকভাবে চলাই যায় না। বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বেশি আতঙ্কের। কোনো রিকশা চালকই ডান-বাম দেখে না। হুটহাট করে এদিক-ওদিক থেকে সামনে এসে যায়। তাছাড়া প্রচুর ওভারটেক করতে চায়।’

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনেও দেখা যায়, রিকশাচালকদের মধ্যে লেন না মেনে রাস্তার মাঝ বরাবর দিয়ে চলার প্রবণতা বেশি। যেসব রাস্তায় রিকশার জন্য আলাদা লেন করা আছে, সেসব জায়গাতেও রিকশা লেনে না চলে মূল রাস্তা দিয়ে চলে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন সাইন্সল্যাব এলাকায় মিরপুর রোডে সাইন্সল্যাব থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত রিকশা চালাচলের জন্য আলাদা লেন করে দেওয়া থাকলেও সেসব জায়গায় রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়নি।

সাইন্সল্যাব এলাকায় লেন ও লেনের বাইরে রিকশা চলতে দেখা গেলেও তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড অর্থাৎ আনিসুল হক সড়কে লেনে একটিও রিকশা চলে না। কয়েকজন রিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা আলাদা লেনের বিষয়টি জানে না।

এদিকে ঢাকায় কত রিকশা চলে সেটি নিশ্চিতভাবে জানাতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহীকে ফোন করে ও মেসেজ পাঠিয়েও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।

আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে জানা যায়, অবিভক্ত সিটি করপোরেশন থেকে ১৯৮২ সালে সর্বশেষ ৩০ হাজার ১৫২টি রিকশার লাইসেন্স ইস্যু করা হয়েছিল। ডিএনসিসির বর্তমান মেয়র নতুন করে দুই লাখ রিকশার লাইসেন্স দেওয়ার ব্যপারে বলেছেন। এ ব্যপারে মন্ত্রণালয়ে চিঠি গিয়েছে। তাছাড়া নগরীর বিভিন্ন সড়কে রিকশা চলাচলের জন্য আলাদা লেন প্রস্তাবিত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান বলেন, ‘মিরপুর রোড ও মহাখালী হয়ে এয়ারপোর্ট রোড পর্যন্ত রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ কিন্তু অনেকসময় ক্রসিংয়ের নাম করে রিকশা এসব রাস্তায় চলে আসে। আবার বড় বড় মার্কেটেও রিকশা আসার প্রবণতা বেশি। আমরা অন্তত এক মাস রিকশা চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে চাই যেন এটি পরবর্তীতে অভ্যাসে পরিণত হয়।’

এদিকে, ঢাকার বিভিন্ন ফ্লাইওভারে রিকশা চলাচল নিষিদ্ধ থাকলেও অনেকগুলোতেই রিকশা উঠতে দেখা যায়। মৌচাক-মালিবাগ, খিলগাঁও এবং সদ্য উদ্বোধন হওয়া কালসী ফ্লাইওভারে বিশেষ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল করতে দেখা যায়। এ বিষয়ে মুনিবুর রহমান বলেন, ‘এটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করি। দেখা যায় একটা-দুটি থামাতে থামাতে আরেকটা উঠে পড়ছে যা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না অনেকসময়। এছাড়া লেন মেনে রিকশা চলাচল না করলেও তা নিয়ন্ত্রণ করা হবে।’

বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব প্ল‍্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক শেখ মুহম্মদ মেহেদী আহসান বলেন, ‘রিকশা আমাদের ঐতিহ্যের অংশ, তাই এটিকে বাদ দিয়ে নগর পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত হবে না। তাছাড়া আমাদের শহরে অল্প দূরত্বে যাওয়ার বাহন হিসেবেও রিকশার প্রয়োজন রয়েছে। আবার ঢাকায় রিকশা দরকার বলেই সব রাস্তা দিয়ে রিকশা চলবে সেটিও ঠিক নয়। যেসব রাস্তায় (ভিআইপি) সড়কে দ্রুত যান চলাচল করে তাই এসব জায়গায় রিকশা চলাচল বন্ধ আছে।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ঢাকায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত রিকশা। ঢাকায় রিকশা চালানোর ক্ষেত্রে একটি বিরাট বাণিজ্য আছে। সে কারণেই এখানে আসলেই রিকশা চালানো যায়। গ্রামে-গঞ্জে কৃষিসহ অন্য কাজে শ্রমিক পাওয়া যায় না। শ্রমজীবী মানুষ ঢাকায় চলে আসে রিকশা চালানোর জন্য, নগদ টাকার জন্য। সব সুযোগ-সুবিধা ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় মানুষ সারা দেশ থেকে পড়াশোনা, চিকিৎসা, সরকারি কাজের জন্য ঢাকায় চলে আসে। তাই এখানে জনসংখ্যার চাপও বেশি। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরেও সুযোগ-সুবিধা বাড়ালে ঢাকায় রিকশার সংখ্যাও কমে যাবে।’

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘ঢাকায় আনুমানিক সাড়ে তিন লাখ থেকে চার লাখ রিকশা চলে। আমাদের পরিবহন খাতে রিকশার অবদান কম না। কিন্তু রিকশা নিয়ে যে অব্যাবস্থাপনা তা একমাত্র সিটি করপোরেশনই দূর করতে পারে। মানুষের নিরাপত্তার দিকটি সবার আগে মাথায় রাখতে হবে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব মানুষের অবাধ চলাচল নিশ্চিত করা। এর পথে কেউ বাধা হয়ে দাঁড়ালে তা ঠিক করা রাষ্ট্রেরই দায়িত্ব। ক্যান্টনমেন্ট বা ডিওএইচএস এলাকায় যেভাবে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনায় রিকশা চলে, সেভাবে পুরো ঢাকা শহরেই রিকশাকে একটি সঠিক ব্যবস্থাপনায় আনতে হবে।’

রোজার সময় সমাধান কী হতে পারে
এদিকে রোজা আসতে না আসতেই যানজট আতঙ্কে রাজধানীবাসী। গতকাল বৃহস্পতিবার (২৩ মার্চ) রাজধানীর বাসাবো সবুজবাগ এলাকায় একটি তেমাথায় নিজ উদ্যোগে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছিলেন মোহাম্মদ আমিন। এদিক থেকে ওদিক থেকে রিকশা এসে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া ও একাধিক লাইন করা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন তিনি। বললেন, ‘আজই (রোজার আগেরদিন) এই অবস্থা, কাল থেকে কী ভয়ংকর অবস্থা হবে বুঝতেছেন!’

রোজার মাসে রিকশা চলাচল একটি শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসতে ট্রাফিক পুলিশ ইতোমধ্যে পরিকল্পনা করেছে বলে জানান অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে এটি নিয়ে কাজ করছি। আগামী এক মাস আমাদের সবার দায়িত্ব হবে রাস্তায় ট্রাফিক আইন মেনে চলা, যেন সবাই সময়মতো ইফতার করতে পৌঁছাতে পারে।’

এছাড়া রোজার মাসে স্কুল-কলেজ বন্ধ করলে রাস্তায় রিকশার চাপ অনেকটা কম হবে যা তাদের জন্য একটি বাড়তি সুবিধা দেবে বলে মনে করছেন তিনি।

সারাবাংলা/আরএফ/এমও

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন