বিজ্ঞাপন

‘বিনামূল্যে বিদেশে উন্নত চিকিৎসা শব্দটাও তো দেশের জন্য অপমান’

April 13, 2023 | 8:50 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘দেশের সব মানুষ কী কিডনির চিকিৎসা নিতে পারে? দেশেই কিডনি প্রতিস্থাপন করার খরচ কয়টা সাধারণ মানুষ এফোর্ড করতে পারে? উন্নত চিকিৎসা বলতে কী বোঝায়? দেশের বাইরে যদি উন্নত চিকিৎসার জন্যেই যেতে হয় সেটার অর্থ কী দাঁড়ায়? সেটার অর্থ কী এমন যে আমাদের দেশে উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থা নেই? আমাদের দেশের চিকিৎসকরা সক্ষম। অন্যান্য অনেক কিছুই আছে। তাহলে উন্নত চিকিৎসার জন্য কেনো বিদেশে যেতে হবে? আমি তো আমার নিজের দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে খারাপ ভেবে ভিনদেশকে উন্নত বলতে পারি না। আর তাই আমি শেষ দিন পর্যন্ত গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রেই চিকিৎসা নেবো। আমি যদি মারাও যাই তাতেও আফসোস থাকবে না আমার। মৃত্যুর পরে আমার এই কথাগুলো মিলিয়ে নিতে পারেন।’

বিজ্ঞাপন

—২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের সঙ্গে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ।

২০২৩ সালের ১১ এপ্রিল রাত ১১ টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ৮১ বছর বয়সে মারা যাওয়ার আগে দীর্ঘদিন কিডনি জটিলতায় ভুগছিলেন।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হওয়ার পর তার কিডনি রোগ বিবেচনায় নিয়ে অনেকেই দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসার পাশাপাশি কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেন।

বিজ্ঞাপন

তবে সেই প্রস্তাবনা সরাসরি নাকচ করে দেন ডা. জাফরুল্লাহ।

বিদেশে চিকিৎসা ও কিডনি প্রতিস্থাপন বিষয়ে না যেতে চাওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি প্রতিবেদককে বলেন, ‘ওখানে যারা চিকিৎসা দেন তারা কী রক্তমাংসের মানুষ না? আমাদের এখানে যারা চিকিৎসা দেন তাদের সঙ্গে কী খুব বেশি পার্থক্য তাদের? চিকিৎসার জন্য তবে কেনো দেশের বাইরে যাবো?’

তিনি বলেন, ‘ধরেন আমি বিদেশ গিয়ে কিডনি প্রতিস্থাপন করেই ফেললাম। তাতে দেশের কী উপকার হবে? দেশের অন্যরাও তো একইভাবে পরিশ্রম করে অর্জন করা দেশের অর্থ বিদেশিদের দিয়ে আসবে। তাই না? আর সেই সামর্থ্যও কী সবার আছে? ৯৮ শতাংশ মানুষই তো সেটা করতে পারবে না।’

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে আমার বন্ধু হার্ভার্ড বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে। এরপরে আরও অনেকেই একই প্রস্তাব দেন। কিন্তু আমি সরাসরি তাদের কাছে জানতে চাই, আমার দেশের অন্যদেরও কী এভাবে বিনামূল্যে কিডনি প্রতিস্থাপন করানো সম্ভব হবে কিনা বিদেশে? উত্তর তো সবারই জানা আছে। আর তাই আমি আমার দেশেই চিকিৎসা করাতে চাই। আপনাদের বলা সো কলড উন্নত চিকিৎসাটা আমাদের দেশেই পেতে চাই। সবাই যেন সেই সুযোগটা পায় সে ব্যবস্থা দেখে যেতে চাই।’

২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল ডা. জাফরুল্লাহ শেষবারের মতো বিদেশে চিকিৎসা নিবেন না বলে সারাবাংলাকে জানান তার চিকিৎসায় গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান সমন্বয়কারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. মামুন মোস্তাফী।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থেকে অবস্থার উন্নতি না হলেও ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশের বাইরে গিয়ে চিকিৎসা নিতে চাননি। এখানে তার শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি দেখা না গেলেও তিনি দেশের বাইরে নিয়ে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজি হননি। তার ইচ্ছে তিনি শেষ দিন পর্যন্ত এই দেশেই চিকিৎসা নেবেন।’

ডা. জাফরুল্লাহ’র সহধর্মিণী শিরিন হক বলেন, ‘এর আগে একাধিকবার তার কাছে দেশের বাইরে উন্নত চিকিৎসা নিতে যাওয়ার প্রস্তাব আসে। অনেকেই বিনামূল্যে চিকিৎসা করানোর প্রস্তাবও দেয়। তবে তার কথা ছিল, দেশের মানুষ যেভাবে চিকিৎসা নেয় সেভাবেই তিনি নেবেন। আর তাই দেশেই চিকিৎসা নেবেন তিনি।’

বিজ্ঞাপন

২০২০ সালে কোভিড মহামারির করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সেই সময়ে বয়স ও স্বাস্থ্য বিবেচনায় তার অবস্থা ছিল বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তখন তাকে কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ায় কিডনি প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দেওয়া হলে তিনি এক বাক্যে নাকচ করে দিয়েছেন।

পরবর্তীতে তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই করোনা না থাকলে তো আমরাই কিডনি প্রতিস্থাপনের কাজ শুরু করতে পারতাম দেশে। সেটার জন্য কেনো বিদেশে যাবো? যেখানে দেশে অনেকেই কিডনি রোগের সেবা নিতে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে আসে, সেখানে আমি কিভাবে দেশের বাইরে যাবো উন্নত চিকিৎসার নামে? আমি আমার দেশের সাধারণ নাগরিকদের মতোই চিকিৎসা নিয়ে মারা যেতে চাই।’

জানতে চাইলে ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ মুশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিতর্ক বা সমালোচনা যাই হোক জাফরুল্লাহ চৌধুরী গণস্বাস্থ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার একটি ভিন্ন মডেল দাঁড় করিয়েছেন যা তাকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্যক্ষেত্রে তিনি চিন্তার জগতে পরিবর্তন এনেছেন। আগে চিকিৎসা, ঔষধ বা স্বাস্থ্যনীতি নিয়ে প্রশ্ন করার চিন্তা করতো না। সেটি তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। তিনি ব্যতিক্রমী ধারার সূচনা করেছেন। তার কাজের প্রতীক গনস্বাস্থ্য যেখানে মানসিক শ্রমের সাথে কায়িক শ্রমের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি।’

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার (১১ এপ্রিল) ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী দিবাগত রাত ১১টায় রাজধানীর ধানমন্ডির গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বর্তমানে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিমাগারে রয়েছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মরদেহ সর্বস্তরের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে রাখা হবে বৃহস্পতিবার (১৩ এপ্রিল)।

এদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সর্বস্তরের জনগণ। একই স্থানে রাষ্ট্রীয়ভাবে শ্রদ্ধা জানান হবে।

বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মরহুমের জানাজার নামাজ অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ১৪ এপ্রিল শুক্রবার সকাল ১০টায় সাভার গণস্বাস্থ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। বাদ জুমা সেখানে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।

সারাবাংলা/এসবি/এমও

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন