বিজ্ঞাপন

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ও মানুষের অলসতা

April 13, 2023 | 6:49 pm

তানজির ইসলাম বৃত্ত

“আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের (এআই) দ্রুত বিস্তার মানুষের জীবনের বিভিন্নদিকে গভীর প্রভাব ফেলেছে। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি থেকে এআইচালিত ভার্চুয়াল সহায়িকা পর্যন্ত, এই প্রযুক্তিগুলি আমাদের কাজ, যোগাযোগ এবং দৈনন্দিন জীবন যাতায়াতের উপায় পরিবর্তন করেছে। এআইয়ের সুবিধাগুলো অপরিসীম, তবে এই প্রযুক্তিগত বিপ্লবের ফলে মানুষের অলসতা বেড়ে যাবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। এই নিবন্ধে এআই এবং মানুষের অলসতার সম্পর্ক নিয়ে গভীর আলোচনা করা হবে, সম্ভাব্য পরিণতি পর্যবেক্ষণ করা হবে এবং নেতিবাচক প্রভাব পরিহারের জন্য সম্ভাব্য সমাধান অন্বেষণ করা হবে।

বিজ্ঞাপন

মানুষের অলসতায় এআইয়ের প্রভাব

এআইয়ের বিস্তার বাড়ার প্রধান উদ্বেগ হল মানুষের অলসতা বেড়ে যাওয়া। আমরা এআই প্রযুক্তির উপর যত্নের সাথে নির্ভর করি, আমাদের চিন্তা-কর্ম, সমস্যা সমাধান কৌশল এবং মোটামুটি কাজে আত্মসমর্পণের সম্ভাবনা হ্রাস পেতে পারে। এআইজনিত অলসতার কিছু সম্ভাব্য নেতিবাচক পরিণাম হল-

১. সমালোচনামূলক চিন্তার হ্রাস: এআই প্রণালী যখন সমালোচনামূলক চিন্তা করা কাজ নেওয়া হয়, মানুষ নিজেদের সিদ্ধান্ত নেওয়া এবং সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এআইয়ের উপর অতিরিক্ত নির্ভরতা মানবমেধার প্রয়োগ কমিয়ে দেবে।

বিজ্ঞাপন

২. সামাজিক বিচ্ছেদ: এআই প্রযুক্তির উপর বেশি নির্ভর হলে, মানুষ সামাজিক বিচ্ছেদের সম্ভাবনা বাড়াতে পারে। বন্ধুত্ব, পারিবারিক সম্পর্ক এবং সামাজিক যোগাযোগের প্রক্রিয়াগুলি কমে যেতে পারে, যা মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যে বিপরীত প্রভাব ফেলতে পারে।

৩. পেশাদার বিকাশে সীমাবদ্ধতা: এআই প্রযুক্তি বেশিরভাগকাজের সাথে মানুষের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করলে, মানুষ নিজেদের পেশাদার বিকাশে নিরাশাজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে পারে। এআই যে কাজগুলি অধিগ্রহণ করে, সেগুলির জন্য মানুষের কাজের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পাচ্ছে।

অলসতা দূর করার উপায়

বিজ্ঞাপন

১. এআই এবং মানুষের যৌথকর্ম: এআই প্রণালী এবং মানুষের যৌথকার্যাদির মাধ্যমে, মানুষ প্রযুক্তিটির সাথে সমন্বিত হলে প্রযুক্তি দ্বারা অর্জিত সুবিধাগুলো উপভোগ করতে পারে এবং একই সময়ে নিজের চিন্তা-কর্ম এবং পেশাদার বিকাশের দিকে নজর দিতে পারে।

২. প্রযুক্তিগত সামর্থ্য অর্জন: এআই প্রযুক্তির উপর নির্ভরতা হ্রাস করার জন্য, মানুষের নিজেদের প্রযুক্তিগত সামর্থ্য বাড়াতে এবং এই প্রযুক্তির সাথে সমন্বিতভাবে কাজ করার প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

৩. সময় ব্যবস্থাপনা: মানুষের অলসতা দূর করার জন্য, সময় ব্যবস্থাপনা ও কাজের পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ। এআই এবং মানুষের কাজের সময়সূচি ও পরিকল্পনা সমন্বিত হলে, এটি দ্বারা অর্জিত সুবিধাগুলোর সমর্থনে কাজে অংশগ্রহণ বাড়ানো যাবে।”

-উপরের লেখাগুলো মোটেও আমার নয়। এটা বহুল আলোচিত চ্যাটজিপিটি-৪ এর উত্তর। প্রশ্নটি ছিলো, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কি মানুষকে অলস বানিয়ে দেবে? এই বিষয়টির ওপর ৩০০০ শব্দের একটি প্রবন্ধ লিখুন। হ্যাঁ, সে লিখেছে। লেখার সময় তাকে লক্ষ্য রাখতে হয়েছে অনেকগুলো বিষয়। তার কথা যেন কোনও আইন না ভাঙে, কোন পলিটিক্যাল ইনকারেক্ট কথা যেন না বলে ফেলে, কোন ভুল তথ্য না দিয়ে ফেলে ইত্যাদি। এর ফলে যা হয়েছে, একটা ধরি মাছ না ছুঁই পানি টাইপ লেখা উৎপাদিত হয়েছে। ওদিকেও যাবেন না, এদিকেও আসবেন না।

বিজ্ঞাপন

আমার শিরোনামটা অনেক ভেবে ভেবে নেওয়া। মহীনের ঘোড়াগুলো ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নায়, অনেক বিখ্যাত লাইন জীবনানন্দ দাশের। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে যদি বলি এমন একটি কবিতা লেখো, সে কি লিখবে? সে লিখেছে-

“মহীনের ঘোড়াগুলোর পাশে যায় সবাই। হৃদয়ে একটি নতুন আশা জাগে, মহীনের ঘোড়াগুলো জীবনের সফলতা জানায়। কার্তিকের জ্যোৎস্না উজ্জ্বল হয় নির্মল আকাশে, মহীনের ঘোড়াগুলো পাঁচ মিনিট এগিয়ে যায়। ঘাস খায় ঘোড়াগুলো, সুখ পায় যাপনে…”

হ্যাঁ, সব হবে না আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে। চিন্তার ক্ষমতা, ভাববার ক্ষমতা তার আছে বটে, কিন্তু তা প্রকাশের সাহস নেই। ভবিষ্যতে হতে পারে, তাতে গণ্ডগোল বাড়বে, কমবে না। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বনলতা সেন লিখতে পারবে না, পারবে না ৭ই মার্চের ভাষণ লিখতে। কারন সে দশবার ভাববে, আমি বনলতা সেনকে কোনভাবে সেক্সুয়ালি হ্যারাস করছি না তো? বনলতা সেন বিব্রত হচ্ছেন না তো? তাকে বনলতা সেন লিখতে বললে প্রতি লাইনের আগে, যথাযথ সম্মানপূর্বক অথবা যদি ‘অনুমতি দেন, নাটোরের বনলতা সেন?’ এই টাইপ লেখা বের হবে। সে হাজার বছর ধরে হাঁটাকে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নোট দেবে কবিতার নিচে। আর স্বাধীনতার সংগ্রাম? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হলে বলতো, ‘আসুন শান্তির জন্য একটু বসি।’ এতে বরং শান্তিবাহিনী তার হাত দিয়ে তৈরি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

অংক করতে করতে যখন মাথা ঘুরাতো, সারাবছরের অংকের ফলাফল যখন হতো ৫৬ কি ৫৭ নাম্বার, বাসায় ভয়ে রিপোর্ট কার্ড লুকিয়ে যা তা অবস্থা, এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আপনাকে কোড লিখে দেবে। এর জন্য আপনাকে জাভা পাইথন এইচটিএমএল জানতে হবে না। অবশ্যই ভালো সংবাদ, কে খুঁজবে আর প্রোগ্রামার অথবা গ্রাফিক্স ডিজাইনার? এক চাপে সব চলে আসবে। ইউটিউবভর্তি ভিডিওতে, কীভাবে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তাকে পরীক্ষার আগের রাতে আসাইনমেন্ট বানিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু এই টিকটক প্রজন্ম আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স দিয়ে কি কি করবে তা চিন্তা করা যায়। অলস, মেধাহীন আরও একটি জেনারেশন পেতে যাচ্ছি কি আমরা! ভেজিটেবল কোনো এক প্রজন্ম, যারা খাবে, ঘুমাবে আর ভার্চুয়াল পৃথিবীতে সুখ খুঁজে বেড়াবে। অলরেডি আমরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই সুখী। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে যদি কমান্ডের মাধ্যমে জীবনসঙ্গীর মত আচরণ করতে শেখানো যায়, সেটা সিভিলাইজেশনের শেষ পদক্ষেপ হবে বলে মনে করি। মনে পড়ে যাচ্ছে ইংরেজি ‘Her’ মুভিটির কথা। লেখক আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একটি অপারেটিং সিস্টেম কেনে তার লেখালেখির জন্য, কিন্তু মেশিন লারনিং এবং এডাপটিভিটির জন্য অপারেটিং সিস্টেমটি আরও উন্নত হতে থাকে যা এক পর্যায়ে মানুষের মতো রেসপন্স দিতে সমর্থ হয়। ফলাফল, একাকী লেখক প্রেমে পড়ে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের।

আমরা আর ভাববো না? চিন্তা করবো না? মেশিন সব করে দেবে? তবে বেঁচে থাকাটা কেন? ফাস্টফুড খেতে এখন সামনে এনড্রয়েড ফোনে কিছু না চালিয়ে রাখলে শিশু খায় না। দুই বেলা ভাত খেতাম ডাল দিয়ে, থালার দিকে তাকিয়েই খেতাম। এখন খাবার নিয়ে যে যার রুমে চলে যায়, সিরিজ অথবা মুভি চলে সামনে। একসাথে বসে শেষ কবে খেয়েছে তা বলতেও পারবে না অনেকে।

আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মানুষকে অথর্ব করে দেবে। আজ না, অদূর ভবিষ্যতে, কারন ক্রিটিক্যাল থিংকিং একটা প্রাকটিস। কয়েক প্রজন্ম যখন তা করবে না, ভোঁতা হয়ে যাবে চিন্তাশক্তি। মানুষ এডাপ্ট করে নেবে যে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স করে দেবে, চিন্তা কি! কমে যাবে কাজের আগ্রহ, কারন আপনার কাজ যদি কেউ করে দেয়, আপনি আর মোটিভেশন পাবেন কোথা থেকে। আরও ভালো কিছু করতে হবে চিন্তা মাথায় যদি না খেলে তবে কেন করবেন ঐ কাজ। এতে মোটিভেশনাল স্পিকারদের বাজার জমতে পারে। অনুভূতিহীন করে দেবে মানুষকে। কারন সঙ্গদোষে লোহা ভাসে। আজ এই লেখা আমি লিখছি, আগামী বছর আমার রাইটিং প্যাটার্ন অনুকরণ করে হয়তো কোন রাইটিং বট লিখবে একটি প্রবন্ধ।

তাহলে আমরা কারা? হায় হায় করা সেই দল, যারা নদী পাড়ি দিয়ে বিলেত গেলে ‘জাত গেলো, জাত গেলো’ বলে আর্তনাদ করতো? প্রযুক্তিবিদ্বেষী সেই দল আমরা, যারা চাকরি যাবে তার ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছি? তবে আমাদের দলে আরও মানুষ আছে। যারা কিনা খোদ চ্যাটজিপিটির কো-ফাউন্ডার। ইলন মাস্ক ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সকে ছয় মাস বিরতি দেওয়া নিয়ে একটা সংবাদ বেশ প্রভাব ফেলেছিল চারদিকে। ইলন মাস্ক ছাড়াও ওখানে এপল কো-ফাউন্ডার স্টিভ ওয়াজনিয়াকও সহমত দিয়েছে। চিঠিটির চৌম্বক অংশ দিলাম।

“Contemporary AI systems are now becoming human-competitive at general tasks, and we must ask ourselves: Should we let machines flood our information channels with propaganda and untruth? Should we automate away all the jobs, including the fulfilling ones? Should we develop nonhuman minds that might eventually outnumber, outsmart, obsolete and replace us? Should we risk loss of control of our civilization? Such decisions must not be delegated to unelected tech leaders. Powerful AI systems should be developed only once we are confident that their effects will be positive and their risks will be manageable.”

জেটসনস ফেলাসি বলে একটা কথা আছে। জাভিক গ্রিনফিল্ড (Jabvik Greenfield) নামের এক ভদ্রলোকের প্রবক্তা। ‘জেটসন’ নামটি হান্না-বারবেরা নামের একটা কার্টুন ধারাবাহিক থেকে নেওয়া হয়, যা ১৯৬২ সালে প্রচারিত হয়। এই ধারাবাহিকে একটি ভবিষ্যতের পরিবারের জীবন চিত্রিত হয়েছিল, যাদের প্রযুক্তি দ্বারা সুখী ও সহজ জীবন প্রদান করা হয়েছিল।

জেটসনস ফ্যালাসির মূল বিষয়টি হলো ভবিষ্যতে প্রযুক্তির অগ্রগতি দ্বারা মানুষের জীবন সমস্যামুক্ত এবং সুখী হবে বলে ধারণা করা। এই ধারণাটা অতিরিক্ত আশবাদ ও অতিরিক্ত প্রযুক্তির ওপর অবলম্বনের ফলে সমাজের জন্য বিপর্যয়ের কারণ নিয়ে আলোচনা করে থিওরিটি। কারণ জেটসন ভেবেছিল, যদি টেকনোলজি সব করে দেয়, তাহলে প্রচুর সুখ হবে, অনেক ফ্রি টাইম থাকবে, কোন দুঃখ থাকবে না কারও। কিন্তু না, বিনয় মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘দৃষ্টিপাত’ বইতে ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ। তাতে আছে গতির আনন্দ, নেই যতির আয়েস। ’ তিনি এটা যখন লেখেন তখন সাল ১৯৪৭, ভুল বলেছিলেন কি? বিন্দুমাত্র না।

শেষ কবে বই পড়েছিলেন? কবে বই পড়ে কিছু শিখেছিলেন, গুগল করে নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নাকি চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে। বিষয়টা আমার বোধগম্য না, আমাদের রোগীদের ব্যথা আজ পেটে থাকলে পরেরদিন ঘাড়ে যায়। কৌষ্ঠকাঠিন্য থেকে ডায়রিয়াতে মোড় নেয় মিনিটেই। আর একজন চিকিৎসক কি শুধুই ঔষধের নাম লিখেই খালাস? মানসিকভাবে সাপোর্ট দিতে হয় রোগীকে। যদি বলেন, গবেষণাক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ভূমিকা রাখবে, তবে বলবো তাকে সে সুযোগ দেওয়া হবে না। বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলারের ফার্মা ইন্ডাস্ট্রি, তারা বসে বসে দুরারোগ্য ব্যাধির ঔষধ বানানো দেখবে?

পরিশেষে একটা কথা বলতে চাই, আমি কয়েকদিন আগে লিখতে বসে দেখলাম, ইংরেজি এবং বাংলা, দুটো ক্ষেত্রেই, আমি বানান ভুলে গেছি। বারবার আমি গুগল করে নিচ্ছিলাম শব্দগুলো। ব্যাকরণ তো চুলোয় গেছে বহুআগেই। এটা ছোট্ট একটা নমুনা, বাকিটুকু ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল। যদি ভবিষ্যৎ বলতে কিছু থাকে তবে! যে ভবিষ্যতে ‘মহীনের ঘোড়াগুলো পাঁচ মিনিট এগিয়ে যায়। ঘাস খায় ঘোড়াগুলো, সুখ পায় যাপনে’- সেই ঘোড়া, ঘাস এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি বড়ই চিন্তিত।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন