বিজ্ঞাপন

নারী হয়রানি রোধে সিসি ক্যামেরা, মুখ থুবড়ে পড়ছে প্রকল্প

June 26, 2023 | 6:54 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: যৌন হয়রানি বন্ধে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পাইলট প্রকল্প হিসেবে একশ’ বাসে সিসি ক্যামেরা বসানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। অতিরিক্ত ব্যয়, সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতায় মুখ থুবড়ে পড়ছে অভিনব প্রকল্পটি।

বিজ্ঞাপন

গণপরিবহনে নজরদারির জন্য সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা করে নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রাথমিক অবস্থায় ৫ কোটি টাকা ব্যয়ে পাঁচশ’ বাসে সিসি ক্যামেরা বসানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। পরে পাইলট প্রকল্প হিসেবে একশ’ বাসে সিসি ক্যামেরা বসানোর সিদ্ধান্ত হয়। বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা দীপ্ত ফাউন্ডেশন। ২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর চারটি বেসরকারি কোম্পানির ১০০টি বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। কারিগরি সহায়তা দেয় জেনএক্স ইনফোসিস।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে অর্থ বিভাগ ২ কোটি ৬৩ লাখ ৯৯ হাজার টাকা থেকে অনুমোদন দেয়। বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১৯ সালের মার্চ থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত।

দীপ্ত ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক জাকিয়া কে হাসান সারাবাংলাকে জানান, বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো পাইলট প্রকল্পটি শেষ ধাপে। ২০১৯ সালের ৯ জানুয়ারি এটি শুরু হয়। শেষ হবে চলতি বছরের জুনে। দু’বছর করোনা মহামারির কারণে প্রজেক্ট কিছুটা ধীরগতিতে এগিয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

তিনি আরও জানান, পাইলট প্রকল্পটি সফল হবে এবং আরও বেশি সংখ্যক গাড়িকে সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আনা যাবে।

জানা গেছে, এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়, বাস মালিকসহ সব স্টেক হোল্ডারদের সঙ্গে দীপ্ত ফাউন্ডেশনের কথা হচ্ছে। অনেক বাস মালিকই আরও বেশি সংখ্যক বাসে ক্যামেরা চাচ্ছেন।

প্রকল্পের শেষ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন উঠেছে কতটা কার্যকরী হয়েছে এই উদ্যোগ। সারাবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সিসি ক্যামেরা কেনায় অতিরিক্ত ব্যয়, সঠিক পরিকল্পনার অভাব ও সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে মুখ থুবড়ে পড়ছে অভিনব এই প্রকল্প। নারী ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সঠিক পরিকল্পনা ও তদারকির অভাব এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থার অনভিজ্ঞতা, কারিগরি সহায়তা প্রতিষ্ঠানের অতিরিক্ত খরচের কারণে পাইলট প্রকল্প আর বাড়বে কিনা তা নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

বিজ্ঞাপন

পড়ুন পর্ব ১: বাসে সিসি ক্যামেরা, সমন্বয়হীন অপরিকল্পিত প্রকল্প

মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা, বাস মালিক, সড়ক পরিবহন, যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন ও তদারকির পুরো দায়িত্ব তাদের। দীপ্ত ফাউন্ডেশনের মিরপুর অফিসে বসানো হয়েছে সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেম (সিএমএস)। সেখানে তিনজন সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করেন। যদি কোথাও কোনো সমস্যা হয় সেটি সমাধানের জন্য ফিল্ড কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

অন্যদিকে, মন্ত্রণালয় টেন্ডার দিয়ে সিসি ক্যামেরা ও এর জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য কেনাকাটার দায়িত্ব দেয় তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান জেনএক্স ইনফোসিসকে। প্রকল্প পরিচালক পদে রয়েছেন উপ-সচিব মর্যাদার একজন কর্মকর্তা। এই প্রকল্প চলাকালে প্রকল্প পরিচালক বদলেছে তিন বার।

প্রকল্পটি কতটুকু কার্যকর

বিজ্ঞাপন

বাস মালিক, ড্রাইভার, যাত্রী কল্যাণ সমিতি বা মন্ত্রণালয়- কেউই প্রকল্পটিকে গুরুত্বে সঙ্গে নেয়নি। প্রকল্প পরিচালক দীপক কুমার রায় প্রায় ছয় মাস আগে প্রকল্পের দায়িত্ব পেয়েছেন। লোকবল কম থাকায় সার্বক্ষণিক নজরদারি করা যাচ্ছে না বলে তিনি সারাবাংলাকে জানান।

বাসগুলোতে লাগানো সিসিক্যামেরার অবস্থান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ইঞ্জিনের পাশে ও ড্রাইভারের ঠিক পিছনের নারী সিটে বসা যাত্রীদের হয়রানির চিত্র এতে স্পষ্ট হয় না। এ বিষয়ে বাস্তবায়নকারী সংস্থা দীপ্ত ফাউন্ডেশন জানায়, পাইলট প্রকল্প হিসেবে সাধারণ বাসে সিসিক্যামেরা লাগানো হয়েছে। এসব ‘লোকাল বাস’-এর অবস্থা সবসময় ভালো থাকে না। আবার একেক বাসের সিট বিন্যাস একেক রকম। ফলে সব বাসে একই জায়গায় বসানো যায়নি।

পেছনে বসালে ব্যাটারি সংযোগে সমস্যা হতে পারতো মন্তব্য করে দীপ্ত ফাউন্ডেশন জানায়, সবদিক বিবেচনা করে এবং বাস মালিকদের সঙ্গে কথা বলেই তারা ড্রাউভারের সিটের পেছনে এটি লাগিয়েছেন।

এ বিষয়ে গাবতলী এক্সপ্রেসের মালিক রুবেল মিয়ার প্রশ্ন, বাসের পেছনে লাইট, ফ্যান চলতে পারলে ক্যামেরা কেন চলবে না? বাস্তবতা হচ্ছে পরিকল্পনা গ্রহণের সময় তাদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।

বাসপ্রতি খরচ প্রায় দেড় লাখ টাকা

২০২২ সালের ১৬ অক্টোবর প্রকল্প উদ্বোধনের সময় গণমাধ্যমকে জাকিয়া কে হাসান জানিয়েছিলেন, প্রকল্প ব্যয় ২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৫০ লাখ টাকা রাখা হয়েছে সচেতনতা মূলক কার্যক্রমের জন্য। তবে কোথায় কত টাকা ব্যয় হয়েছে তা তিনি সেসময় জানাননি। মূলত কেনাকাটা করেছে জেনএক্স ইনফোসিস। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় টেন্ডারের মাধ্যমে তাদের কাজ দিয়েছে।

সিসিক্যামেরা চলছে এমন বাসের ড্রাইভার, হেল্পার ও মালিকরা জানান, এসব ক্যামেরা অত্যন্ত দামি বলে তাদের বলা হয়েছে। প্রতিটি বাসের পেছনে নাকি মন্ত্রণালয়ের ব্যয় এক লাখ চল্লিশ হাজার টাকা। কেউ কেউ শুনেছেন ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেনএক্স ইনফোসিস নির্দিষ্ট তথ্য জানাতে অস্বীকৃতি জানায়।

সারাবাংলার অনুসন্ধানে জানা যায়, দরপত্রে উল্লিখিত স্পেসিফিকেশন অনুযায়ী গণপরিবহনের জন্য আইপি ক্যামেরা এবং মনিটরিং অফিসে সার্ভারসহ আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ এবং স্থাপনে জেনএক্স ইনফোসিস ১ কোটি ৪২ লাখ ৪২ হাজার ৭৫৩ টাকার কার্যাদেশ পায়। এ হিসেবে প্রতিটি বাসে জেনএক্স ইনফোসিসের খরচ হয়েছে এক লাখ বিয়াল্লিশ হাজার ৪২৭ টাকা ৫৩ পয়সা।

এ সব ক্যামেরা কত টাকা দিয়ে কিনেছেন জানতে চাইলে তারা জানাতে অস্বীকৃতি জানান। তবে প্রজেক্ট প্রপোজালে ক্যামেরা প্রতি দাম ছিল ৪ হাজার তিনশ টাকা। সেক্ষেত্রে একশটি ক্যামেরার দাম আসার কথা ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। তাহলে বাকি টাকা কিসে খরচ হল সেই প্রশ্ন করলে সাইফুল ইসলাম জানান, ক্যামেরার সঙ্গে মেমোরি কার্ড (৬৪ জিবির মেমোরি কার্ড মাসে দুইবার রিনিউ), এমডিভিআর (মোবাইল ভিডিও রেকর্ডার), ডাটা ট্রান্সমিশন, সার্ভার, স্টোরেজ, স্যান, অ্যাপলিকেশন, লাইসেন্স, টিভি ওয়াল, সার্ভার রুম, পারসোনাল কম্পিউটার, সার্ভার র‍্যাক, ইউপিএস, ক্যামেরার খাঁচা, তার, অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও লোকবলের যুক্ত হবে।

এসব মিলিয়ে গাড়ি প্রতি তাদের খরচ কত হয়েছে তা বলতে অস্বীকৃতি জানান তিনি। এর চেয়ে কম খরচে কাজটা করা যেত কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলেন, তা তো যেতই না উলটো আমাদের খরচ বেশি হচ্ছে। কোন কোন খাতে খরচ বেশি হচ্ছে এবং কেন বাড়তি খরচ করছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের চারজন ব্যক্তি সিএমএস-এ যুক্ত আছেন আর চারজন ফিল্ডে। তাদের মাসিক বেতন দেওয়া হলেও ফিল্ডে যাওয়া, মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারসহ এমন অনেক খরচ আছে যা আমরা ধরিনি।

তবে অর্ধেকের বেশি খরচ লোকবল, ডাটা ও কারিগরি কাজেই ব্যয় হচ্ছে বলে স্বীকার করেন তিনি। জানান, করোনা মহামারির কারণে চীন থেকে জিনিসপত্র আনার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায়ও বেশি টাকা খরচ হয়েছে।

প্রশিক্ষণেই ব্যয় অর্ধকোটি

গণপরিবহনে নারীযাত্রীরা পরিবহণ শ্রমিকদের দ্বারাও নির্যাতনের শিকার হন। তাই এটি দূর করতে লোকাল বাস সিসি ক্যামেরার আওতায় আনা দূরদর্শী ও চমৎকার উদ্যোগ বলে মনে করছেন অনেকে। কিন্তু সিসি ক্যামেরা লাগোনো বাসের সংখ্যা না বাড়িয়ে প্রশিক্ষণকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। আড়াই কোটি টাকার প্রকল্পের অর্ধকোটি টাকা শুধুমাত্র প্রশিক্ষণ খাতেই ধরা হয়েছে।

কর্মসূচিটি অর্থ বিভাগ থেকে অনুমোদন পাওয়ার পর (মার্চ ২০১৯ থেকে জুন ২০২০ তারিখ পর্যন্ত) পরবর্তী সময়ে ২ বার ‘নো কস্ট’ এক্সটেনশন করা হয়েছে। ৬ অক্টোবর ২০২২ তারিখ পাপিয়া ঘোষের সই করা এক বার্তায় দেখা যায়, গণপরিবহনে নারীর নিরাপদ যাতায়াত ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ শীর্ষক কর্মসূচি’র ব্যয় না হওয়া ৫০ লাখ ৪১ হাজার টাকা ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংশোধিত বাজেটে বরাদ্দসহ এক বছরের (নো কস্ট এক্সটেনশন) বাড়ানোর অনুমোদন চাওয়া হয়।

চিঠিতে অব্যয়িত ৫০ লাখ ৪১ হাজার টাকা সংশোধিত বাজেটে অন্তর্ভুক্তিসহ তিন বারের মতো নো কস্ট এক্সটেনশন করা প্রয়োজন এবং কর্মসূচির যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। কিন্তু মনিটরিং করা প্রয়োজন বিধায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে ০১ (এক) বছরের নো কস্ট এক্সটেনশনের প্রয়োজন হবে বলে উল্লেখ করা হয়। এতে প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৩ লাখ টাকা, সম্মানী ভাতা ৫ লাখ, প্রচার ও বিজ্ঞাপন বাবদ ২ লাখ, প্রশিক্ষণ ভাতা ২৫ হাজার টাকাসহ অন্যান্য খাতে।

এ বিষয়ে পরিবহন মালিকদের নেতা খন্দকার এনায়েত উল্যাহ সরাবাংলাকে বলেন, ‘বাস মালিকদের তো ট্রেনিং দেওয়ার কিছু নেই। কে কাকে কোথায় প্রশিক্ষণ দিয়েছে তা আমি জানি না। ব্যক্তিগতভাবে কোনো বাস মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকতে পারে। এ বিষয়ে আমার সঙ্গে বা সংগঠনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করেনি।’

গাবতলী এক্সপ্রেসের মালিক রুবেল মিয়া সারাবাংলাকে জানান, তিনি বা তার কোন ড্রাইভারকে কেউ প্রশিক্ষণ দেয়নি। তবে বসুমতি পরিবহনের কয়েকজন ড্রাইভারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তারা বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণে অংশ নিয়েছেন। একই কথা জানান অপর চারটি বাস কোম্পানির প্রতিনিধি সুজন মীর।

এ বিষয়ে জাকিয়া কে হাসান বলেন, ‘প্রকল্প শুরুর আগে অনেক মিটিং করতে হয়েছে। বাস মালিক, চালক ও অন্যান্য পরিবহন শ্রমিকদের বোঝাতে হয়েছে কেন এই ক্যামেরা লাগানো হচ্ছে এবং এটি লাগালে তারা কীভাবে উপকৃত হবে। তাছাড়া নারী যাত্রীদের পিঠে হাত দিয়ে ওঠানো, নারীদের বাসে তুলতে না চাওয়া, মহিলা সিটে বসতে না দেওয়ার মত ঘটনা ঘটে। তাদের সেসবও শেখাতে হয়েছে কীভাবে একজন নারী যাত্রীর সঙ্গে ব্যবহার করতে হয়।’

বাস সংখ্যায় গড়মিল

গেল বছরের ১৭ অক্টোবর আড়ম্বরের সঙ্গে রাজধানীর ১০০ বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন উদ্বোধন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী পাঁচ পরিবহনের ১০৮টি বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে।

এ বিষয়ে দীপ্ত ফাউন্ডেশনের জাকিয়া কে হাসান বলেন, ‘১০০টি বাসেই সিসি ক্যামেরা লাগানোর প্রকল্প এটি। গাবতলী-গাজীপুর রুটের বসুমতি পরিবহনের ২৫টি বাস তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু কিন্তু শেষ মুহূর্তে তারা বাস দেয় ১৭টি। এই ঘাটতি পূরণে নেওয়া হয় গাবতলী- সায়েদাবাদ রুটের গাবতলী এক্সপ্রেস-এর ৮টি বাস। মন্ত্রণালয়ের তালিকায় বসুমতির না দেওয়া আটটি বাসের হিসাব বাদ না দেওয়ায় এই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়।’

সরেজমিনে

চার বছর আগে নেওয়া প্রকল্পটির মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি জুন মাসে। মেয়াদ শেষের মাত্র আট মাস আগে ১০০টি বাসে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়। এ বিষয়ে যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকদের অবহিতকরণের জন্য বরাদ্দ ছিল প্রায় দুই লাখ টাকা। এর প্রায় পুরোটাই লুটে নিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে এই প্রকল্প সম্পর্কে জনগণ কতটা জানেন তার খোঁজ নেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতায় থাকা বাসে নিয়মিত যাতায়াত করেন এমন অনেকেই জানান, তারা কখনোই সিসি ক্যামেরা দেখেননি। রাজধানীর বিভিন্ন বাসে চলাচলের সময় নারী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেও জানা গেছে, তারা এ বিষয়ে জানেন না।

রাজধানীর মিরপুর টেকনিক্যাল এলাকায় বসুমতি বাসের কয়েকজন ড্রাইভার ও হেলপার সারাবাংলাকে জানান, তাদের বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সিসি ক্যামেরা লাগানোয় যারা শিক্ষিত তারা পোস্টার পড়লে একটু সতর্ক হয়ে যায়, বাকি যা ছিল তাই।

ক্যামেরা লাগানোর পর যাত্রীদের বিশৃঙ্খলা একটু কমেছে বলে মনে করেন বাস চালক মোহাম্মদ এরশাদ। তিনি পুরুষ যাত্রীরা সতর্কতার ধরণ সম্পর্কে জানান, এখন তারা (পুরুষ যাত্রী) মেয়েদের সিটে বসেন না। আবার লেখা পড়ে অনেকে ভিড়ের মধ্যে ধাক্কাধাক্কি না করে সোজা হয়ে যান।

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক দীপক কুমার রায় সারাবাংলা জানান, বাসে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যবেক্ষণে বেগ পেতে হয়। সচিবালয়ের সামনে দিয়ে যায় এমন বাসে ক্যামেরা থাকলে সুবিধা হতো। সবচেয়ে ভালো হতো একটি কোম্পানির সবগুলো বাসে সিসি ক্যামেরা বসালে। এক্ষেত্রে সঠিক চিত্র পাওয়া যেত। আবার একটি কোম্পানির বাস হলে প্রচারণা চালাতেও সুবিধা হত। সবাই জানত ওমুক বাসে ক্যামেরা আছে, তাতে কত যাত্রী বাড়লো বা নারীরা আসলেই নিরাপদ বোধ করছেন কিনা তা জানা যেত।

এদিকে, বাস্তবায়নকারী সংস্থা দীপ্ত ফাউন্ডেশনের অফিসে সার্বক্ষণিক চলাচলকারী বাসগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। দীপ্ত ফাউন্ডেশনের মিরপুর অফিসে স্থাপিত সিএমএস (সেন্ট্রাল মনিটরিং সিস্টেম)-এর মাধ্যমে সার্বক্ষণিক নজরদারি করে। তাদের নিজস্ব জরিপ অনুযায়ী, ক্যামেরা লাগানো বাসগুলোতে প্রথম তিন মাসে নারী যাত্রী ছিলেন ১৫ শতাংশ (৪ লাখ ৪৫ হাজার ৫০০ জন); এর পরের তিন মাসে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩০ শতাংশ (৮ লাখ ৯১ হাজার)। প্রতি মাসে ৩৩ হাজার নারী এসব বাসে চলাচল করেছেন।

এ ছাড়া পঞ্চান্ন সিটের বাসে প্রতি ট্রিপে ৫৫ জন যাত্রী যাওয়া-আসা করছেন ধরে ছয় মাসে প্রায় ৬০ লাখ মানুষ সিসি ক্যামেরা বসানো বাসে নিরাপদে চলাচল করেছেন বলে জানান তারা। ১৬ অক্টোবর থেকে একটি বাসে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার যাত্রী নিরাপদে চলাচল করলে ১০০ বাসে যাত্রী উঠেছেন ৫৯ লাখ ৪৯ হাজার জন, হিসাব তাদের।

তবে এ হিসাবের সঙ্গে একমত নন বাসের ড্রাইভার, মালিক ও বাস মালিকদের সংগঠন। গাবতলী এক্সপ্রেসের রুবেল মিয়া সারাবাংলার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘যাত্রী আগে যা ছিল তা-ই আছে। মানুষ তো আর জানে না যে, আমার বাসে সিসি ক্যামেরা আছে। ওঠার পরে তারা দেখে। এতে করে যাত্রী বাড়ে না। যারা ওঠার তারা ওঠে।’ পরিস্থান পরিবহন, রাজধানী সুপার সার্ভিস, প্রজাপতি পরিবহন লিমিটেড ও বসুমতি ট্রান্সপোর্টের কন্টাক্ট পারসন সুজন মীর বলেন, ‘নারী যাত্রী বেড়েছে এমন কিছু তারা জানেন না বা এমন কিছু লক্ষ করেননি।’

বাস মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত জানান, এমন কিছু তিনি শোনেননি। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমার কাছে বাস চেয়েছিল, আমি ব্যবস্থা করে দিই। তারপর থেকে আর কোন খোঁজখবর নাই। কারা কোথায় কীভাবে দেখাশোনা করে তা আমি জানি না। আমার সঙ্গে কেউ কোন যোগাযোগ করে না। এসব বাসে নারী যাত্রী বেড়েছে এমন তথ্য আমার কাছে নেই।’

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘বাসে সিসি ক্যামেরা বসানো বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলেনি। পত্রিকা পড়ে জেনেছি। কোনো বাসে দেখিওনি। এসব বাসে চলাচল করে নারী যাত্রীরা নিরাপদ বোধ করছেন কি-না এমন কিছু আমি জানি না। আমাদের কাছে কোনো জরিপ নেই।’

ব্যবহৃত ক্যামেরা ও ইউপিএস যখন আলোচনায়

জেনএক্স ইনফোসিস’র দাবি, তারা অনেক ভালোমানের ক্যামেরা লাগিয়েছে। সরাসরি চীন থেকে আনায় এসব ক্যামেরার ব্যয়ও অনেক কম পড়েছে।

কয়েকটি বাস পরিদর্শন করে দেখা গেছে, ইউপিএসগুলো কাজ করছে না। গাবতলী এক্সপ্রেসের ছয়টি বাসে ইউপিএস স্থাপনের এক মাস পর থেকেই আর কাজ করছে না। সরাসরি ব্যাটারির সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। কারিগরি সাপোর্ট জেনএক্স ইনফোসিসের দেওয়ার কথা থাকলেও নিজের মিস্ত্রি দিয়ে কাজ করাতে হয়েছে বলে জানান মালিক মো. রুবেল মিয়া। এর জন্য মিস্ত্রিকে কোনো টাকাও দেওয়া হয়নি। এদিকে, বাসে ক্যামেরা স্থাপনের জন্য ছিদ্র করা হয় যা দিয়ে পানি পড়ে। এসব ছিদ্রও নিজ উদ্যোগে ও নিজ খরচেই বন্ধ করতে হয়েছে বলে জানান তিনি।

মালামাল রিসিভ এবং আইপি ক্যামেরাসমূহ বাদে স্থাপনের পর চুক্তি মোতাবেক তারা এক বছর মেইনটেনেন্স সাপোর্ট দেবে। এক্ষেত্রে দীপ্ত ফাউন্ডেশন পুরো কার্যক্রমটি মনিটরিং করবে।

বাসে লাগানোর জন্য মন্ত্রণালয়ের চাহিদা ছিল আইপি ক্যামেরা, যা ঝাঁকুনি ও তাপের মধ্যেও নষ্ট হবে না। একদিকে এটি যেমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ঠিকঠাকভাবে চলবে, অন্যদিকে দামেও হতে হবে সাশ্রয়ী। এ সব চাহিদা অনুযায়ী জেনএক্স ইনফোসিস চীন থেকে তাদের পার্টনার প্রতিষ্ঠান হিকভিশন থেকে একশ ক্যামেরা ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনে। জেনএক্স ইনফোসিস এর প্রজেক্ট ম্যানেজার সাইফুল ইসলাম জানান, তারা হিকভিশন ব্র্যান্ডের তিন বছরের ওয়ারেন্টিসমৃদ্ধ ৭ রেটিংয়ের আইপি ডোম ক্যামেরা কিনেছেন।

এদিকে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সবাই করোনার দোহাই দিচ্ছেন। কিন্তু মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়য়ের ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২৯ মার্চ প্রকাশিত হয় ‘গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা কর্মসূচি’র ক্রয় সংক্রান্ত টেন্ডার। তাতে বলা হয়, টেন্ডারের শিডিউল বিক্রির শেষ সময় ২০২২ সালের ১২ এপ্রিল বিকেল ৩টা। পরদিন দুপুর সাড়ে ১২টায় দরপত্র বাক্স খোলা হবে।

টেন্ডার প্যাকেজে ছিল- সাপ্লাই, ইনস্টলেশন, টেস্টিং অ্যান্ড কমিশনিং অব আইপি ক্যামেরা ইন বাস অ্যালং উইথ রিলেটেড সার্ভার অ্যান্ড আদার সেটআপ ইন মনিটরিং অফিস। চাহিদা ছিল ওয়াটারপ্রুফ ক্যামেরা ১০০ টি, এমভিআর (মোবাইল ভিডিও রেকর্ডার) ১০০ টি, এভিয়েশন কেবল ১০০ টি, সার্ভার একটি, স্টোরেজ একটি, ডিকোডার একটি ও এইচডিডি ৬টি।

অন্যদিকে, মিরপুরে দীপ্ত ফাউন্ডেশনের মনিটরিং অফিসে দেওয়া হয়েছে সনি ব্র্যান্ডের ৫৫ ইঞ্চির স্মার্ট টিভি একটি, ‍র‍্যাংগস ব্র্যান্ডের ২৪ ইঞ্চির বেসিক টিভি ৬ টিসহ অন্যান্য আনুষাঙ্গিক। এছাড়াও তাদের কেনাকাটার তালিকায় রয়েছে লোকাল ব্র্যান্ডের ক্যামেরার খাঁচা ১০০টি, ফোর জি ডাটাসহ সিম কার্ড ১০০ টি, ইগল ব্র্যান্ডের ডিসি ইউপিএস ১০০ টি, অনলাইন ইউপিএস একটি, রাউটার, একটি, ওয়ার্ক স্টেশন একটি, অফলাইন ইউপিএস একটি ও অন্যান্য।

রাজধানীর মোতালেব প্লাজা, বায়তুল মোকাররম মার্কেট ও মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ক্যামেরার ছবি দেখিয়ে এগুলোর বর্তমানে বাজার মূল্য সম্পর্কে খোঁজ করা হয়। মোতালেব প্লাজার একাধিক সিসি ক্যামেরার দোকানদার ছবি দেখে একে নকল ক্যামেরা বলে দাবি করলেও বায়তুল মোকাররম মার্কেট ও মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারে ঘুরে জানা গেল, এটি নকল নয় তবে পুরনো মডেল, যা এখন আর বাংলাদেশের বাজারে আসে না। হিকভিশন ডটকম ডটবিডির ওয়েবসাইটে যোগাযোগ করে জানা গেল এটি ‘ডিসকন্টিনিউড মডেল’। একই কথা বলেন, মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের হিকভিশন আউটলেট ও ডিস্ট্রিবিউটর শপ, বায়তুল মোকাররমের ক্যামেরা ভিশনসহ এসব মার্কেটের কয়েকজন খুচরা সিসি ক্যামেরা বিক্রেতা। তবে ঠিক কবে থেকে এটি নাই তা জানা যায়নি। বাজার ঘুরে এক থেকে তিন বছর আগে পর্যন্ত বাজারে ছিল বলে জানা যায়। এই বিষয়ে হিকভিশনের চায়না অফিসে ই-মেইল করলে তারা কোনো উত্তর দেয়নি।

এদিকে, ইন্টারনেটে হিকভিশনের ফিক্সড ডোম আইপি ক্যামেরার সঙ্গে বাসে বসানো ক্যামেরার ছবির কোনো মিল পাওয়া যায়নি। হিকভিশনের ওয়েবসাইটেও এ ধরনের ক্যামেরার কোনো ছবি পাওয়া যায়নি।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে বর্তমানে হিকভিশনের ডিএস-২সিই৫৬সি০টি-আইআরপিএফ মডেলের ক্যামেরা, ডিভিআর (ডিজিটাল ভিডিও রেকর্ডার), হার্ডডিস্ক (১৬৪ জিবি), অ্যাডাপ্টর, ক্যাবল কানেক্টর, কেবল ও মনিটরসহ হিকভিশনের বর্তমান বাজার চলতি যেকোনো একটি ক্যামেরা ইনস্টলেশনের খরচ পড়বে দোকান থেকে দূরত্ব ভেদে সাত থেকে দশ হাজার টাকা। এর চেয়ে কম দামি ক্যামেরাও রয়েছে।

যা চাচ্ছেন যাত্রী, বাস ড্রাইভার ও মালিকরা

বাসে চলাচলকারী নারী যাত্রী, বাসচালক ও মালিকদের অনেকেই এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে আরও বাসে ক্যামেরা চান।

গাবতলী এক্সপ্রেসের মো. রুবেল মিয়া বলেন, ‘এই বাসে সিসি ক্যামেরা লাগানো আছে- পোস্টারটি বাইরে বাসের গায়ে লাগানো যেতে পারে। তাতে মানুষ বুঝত। এখন যেভাবে লাগানো তাতে কেউ বাসে ওঠার পরেই দেখতে পায়। তাতে সে বাসের মধ্যে হয়ত সতর্ক হয়, কিন্তু সিসি ক্যামেরা দেখে বাসে ওঠার সুযোগ তাতে থাকে না। এ ছাড়া বাসের সামনের দিকে একটি পোস্টার লাগানো হয়েছিল; কিন্তু কয়েকবার বাস ধুলেই তার লেখা উঠে গেছে। এটি প্লাস্টিকে মোড়ানো হলে ভালো হতো। পোস্টার বাইরে লাগালে উপকার বেশি হতো।’

সারাবাংলা/আরএফ/রমু

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন