বিজ্ঞাপন

আমি আছি, ভয় কেন মা কর?

May 13, 2018 | 1:12 pm

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী।।

বিজ্ঞাপন

 

অনেক শাড়ির ভিড়ে একটা কমলা রঙা সুতির শাড়িতে সরু জরিপাড় ঝিকমিক করতে দেখেই মায়ের জন্য কিনব ঠিক করে ফেললাম। মায়ের জন্য শাড়ি কিনতে পারলে কী যে ভালো লাগে নিজের কাছে! আজকের আনন্দটা অবশ্য কয়েক মুহূর্তেই উধাও হয়ে গেল যখন সম্বিৎ ফিরে পেলাম – কার জন্য শাড়ি দেখছি আমি!

জগতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সেইসব মায়াডোরে আর তো যাবে না তাঁরে বাঁধা। বারকয়েক চিকণ জরিপাড় কমলা জমিনে হাত বুলিয়ে দিই, যেন মাকে স্পর্শ করছি। স্মৃতির আয়নায় ভিড় করে কমদামী একখানা সুতি শাড়ির বিনিময়ে পাওয়া অমূল্য সেই অনাবিল হাসিমুখ। ঝাপসা চোখে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছি। ফোনটা বেজে উঠে নিস্তব্ধতা ভাঙালো। ফোনের ওপাশ থেকে বন্ধুটি মনে করিয়ে দিলো, কাল নাকি Mother’s Day, মা দিবস!

বিজ্ঞাপন

 

 

বিজ্ঞাপন

না, মা দিবসের কথা আমার মনে ছিলো না। কেন শাড়ি দেখছিলাম তাও জানি না। নিছক মা দিবস উদযাপনের জন্য তাঁর জন্য কখনো উপহার কেনা হয়নি। কোনো বিশেষ উপলক্ষ্যে ঘটা করে বলা হয়নি, ‘মা, তোমাকে ভালোবাসি।’ এই না বলার কারণটা মায়েরই শেখানো – ‘মাকে কখনো বলে দিতে হয় না যে, ভালোবাসি।’ আমি জানি মা আর আমি অনুভবে কীভাবে এক অন্যকে ছুঁয়ে গেছি। তাই না বলা ভালোবাসার জন্য আমার কোনো আক্ষেপ নেই। চোখে এবড়োখেবড়ো কাজল আর কপাল জুড়ে ক্যানভাসে রংতুলিতে ইচ্ছেঘুড়ি উড়ানো সেই তেজস্বী মুখখানিই তো মায়ের চিরাচরিত মুখ – সারাজীবন যেভাবে দেখে এসেছি তাঁকে।

তবু কেন বারবার শেষ সময়ে দেখা শিশুর সারল্যমাখা মুখটিই মনে পড়ে! মা, আমার মা! মা, আমার মেয়ে। অসুস্থতার দিনগুলিতে মাকে নিয়ে দফায় দফায় হাসপাতালে থাকতে হয়েছে। ভোর হোক কি সকাল হোক, রাতদুপুর হোক আমি তাঁর সঙ্গী। প্রতিবার এ্যাম্বুলেন্সে ওঠার কিছুক্ষণ পরে শ্বাসকষ্টের কারণে মা উঠে বসতে চাইতো। আমি স্ট্রেচারে বসে আমার কোলের সাথে মাকে পিঠে ঠেস দিয়ে বসাতাম। ‘কতদূর আর কতদূর…’ অনন্ত সে পথ- যেন শেষই হত না।

 

বিজ্ঞাপন

 

রাত ভোর হবার অপেক্ষায় এক ঘোর অমানিশার সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের সে যাত্রাপথ খুব দীর্ঘ মনে হত। মাকে জড়িয়ে বসে থাকতে থাকতে নিজেকে শৈশবের কবিতায় পড়া বীরপুরুষ ভাবতাম অবচেতনে। মায়ের অসুখটাকে মনে হত যেন- ‘হাতে লাঠি, মাথায় ঝাঁকড়া চুল কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।’ ভেতর থেকে প্রাণপণ চিৎকার করে আমি তাদের বলতাম – আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার! এক পা আগে আসিস যদি আর – এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার, টুকরো করে দেব তোদের সেরে।’ শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হারে রে রে রে রে।’ সত্যিই সময়টা এমন ছিল যেন ছুটিয়ে ঘোড়া, ঢাল তলোয়ার ঝন্‌ঝনিয়ে আমি লড়াই করে চলেছিলাম মাকে মৃত্যুর মুখ থেকে ছিনিয়ে আনবো বলে। মনের কোণে ভয়কে প্রশ্রয় দিইনি পাছে আমার ভয় মাকেও ঘিরে ধরে! ‘আমি যেন তোমায় বলছি ডেকে, আমি আছি, ভয় কেন মা কর?’

যে মানুষটি সবাইকে সাহস যোগাতো তাঁকে সাহস দিতে গিয়ে কতবার যে চোখের জল গোপন করেছি! নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা ছিল, যুদ্ধজয়ের পর বীরবেশে ঘরে ফিরবো। আমাদের এ লড়াইয়ের শেষটুকু হবে অবিকল ‘বীরপুরুষের’ মতো – আমি তখন রক্ত মেখে ঘেমে বলছি এসে, ‘লড়াই গেছে থেমে’, তুমি শুনে পালকি থেকে নেমে চুমো খেয়ে নিচ্ছ আমায় কোলে – বলছ, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! কী দুর্দশাই হত তা না হলে।’  তুমি আমায় আদর করে, চুমু খেয়ে ঠিক এভাবেই বলে গেছো। কিন্তু আমি হেরে গেছি – তোমার ‘বীরপুরুষ’ কন্যা আমি হতে পারিনি মাগো !

 

লেখিকা – সদ্য প্রয়াত ভাস্কর ও মুক্তিযোদ্ধা ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর মেয়ে

সারাবাংলা/আরএফ

 

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন