বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা বাড়াচ্ছে বিপদ

October 3, 2023 | 8:17 am

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: উত্তরা ১১ নম্বর সেক্টরের ১৪ নম্বর রোডে থাকেন সাইফুল ইসলাম। জ্বরে আক্রান্ত হলে ৪৮ ঘণ্টা পরে নিজ উদ্যোগেই একটি বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা করান। পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। ডেঙ্গু আক্রান্ত নয় ভেবে আশ্বস্ত হন সাইফুল। তবে বিপত্তি বাঁধে পঞ্চম দিন থেকে। আরও বেশি কাবু হয়ে যেতে থাকেন।

বিজ্ঞাপন

পরে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে সম্পূর্ণ রক্তের গণনা বা কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি) পরীক্ষার পাশাপাশি এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা করান। এবারও এনএস-১ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ডেঙ্গু নেগেটিভ আসে। তবে সিবিসি পরীক্ষার রিপোর্টে আসে নানা অসঙ্গতি। চিকিৎসক জানান, সাইফুল ডেঙ্গুতেই আক্রান্ত ছিলেন।

বেসরকারি চাকরিজীবী জাভেদ চৌধুরীর সাত বছর বয়সী সন্তান মুনতাহার ক্ষেত্রেও ঘটেছে একই রকমের ঘটনা। মুনতাহার জ্বর এলে চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা করান জাভেদ। রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। জ্বর আসার ষষ্ঠ দিনে মুনতাহার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। চিকিৎসকের পরামর্শে রক্তের নমুনা পরীক্ষা করিয়ে জানতে পারেন, তার মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত।

আরও পড়ুন- টানা বৃষ্টিতে ফের এডিসের প্রকোপ বাড়ার আশঙ্কা, গা করছে না ২ সিটি

বিজ্ঞাপন

চিকিৎসকরা বলছেন, জ্বর এলেই রোগীরা নিজেদের উদ্যোগে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য এনএস-১ পরীক্ষা করাচ্ছেন যা জটিলতা তৈরি করছে। কেননা সাধারণত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তের নমুনা নিয়ে এনএস-১ পরীক্ষা করলে তা পজিটিভ আসার কথা হলেও এ বছর তার ব্যত্যয় ঘটছে।

চিকিৎসকদের বক্তব্য, এ বছর এনএস-১ নেগেটিভ হলেও অনেককে পাওয়া যাচ্ছে যারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে নিজ উদ্যোগে রক্ত পরীক্ষা করানোর এসব ডেঙ্গু রোগীর ডেঙ্গু ধরা পড়ছে দেরিতে। তাদের হাসপাতালে নিতেও দেরি হচ্ছে। এতে বাড়ছে ঝুঁকি।

এনএস-১ পরীক্ষাটি ডেঙ্গু শনাক্তের প্রাথমিক পরীক্ষা হলেও এটি একমাত্র পরীক্ষা নয়। এনএস-১ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ এলেও রোগীর উপসর্গ বিবেচনায় নিয়ে চিকিৎসকরা ডেঙ্গু শনাক্তে আইজিএম ও আইজিজি নামের আরও দুটি পরীক্ষা করিয়ে থাকেন। এ ছাড়া সিবিসি পরীক্ষার ফলাফলে রক্তের বিভিন্ন উপাদানের পরিমাণ বিশ্লেষণ করেও ডেঙ্গুর উপস্থিতি শনাক্ত করেন তারা।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা হাজার ছাড়াল

ভাইরোলজিস্টরা বলছে, রোগীরা নিজ দায়িত্বে এনএস-১ পরীক্ষা করে নেগেটিভ হলে নিজেদের ডেঙ্গুমুক্ত ভেবে নিয়ে বাড়াচ্ছেন জটিলতা। এক গবেষণাতেও উঠে এসেছে, এ বছরে ডেঙ্গু শনাক্তে এনএস-১ পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করার সুযোগ নেই।

ওই গবেষণার ফলাফলে দেখা গেছে, এক থেকে সাত দিনের জ্বরে ভোগা ১৯৭ জন রোগীর রক্তের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষায় এর মধ্যে ৬৮ জনের রিপোর্ট আসে ডেঙ্গু পজিটিভ। তবে এর মধ্যে ২৮ জনের এনএস-১ নমুনা পরীক্ষার রিপোর্ট আসে নেগেটিভ। অর্থাৎ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৪১ শতাংশ রোগী এনএস-১ পরীক্ষায় নেগেটিভ এসেছেন।

এই গবেষণায় মূল গবেষক ছিলেন ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রুখসানা রায়হান। গবেষণায় আরও যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর মেডিক্যাল ভাইরোলজিস্টের সভাপতি অধ্যাপক ডা. জুলফিকার মামুন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. সাঈফ উল্লাহ মুন্সী ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. জাহিদুর রহমান।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- দেশের ইতিহাসে ডেঙ্গুর সর্বোচ্চ সংক্রমণ ও মৃত্যু সেপ্টেম্বরে

গবেষণায় যে ৬৮ জন রোগী ডেঙ্গু আক্রান্ত পাওয়া গেছে, তাদের ৬৩ জনের শরীরেই ছিল সেরোটাইপ-২ টাইপ ডেঙ্গু। চারজনের নমুনায় সেরোটাইপ-৩ ও একজনের নমুনায় সেরোটাইপ-১ পাওয়া গেছে। দেশে আগের বছরগুলোতে সেরোটাইপ-৩ আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ছিল বেশি। সে তুলনায় এবার এই গবেষণার মতো আরও কয়েকটি গবেষণাতেও সেরোটাইপ-২ আক্রান্ত ডেঙ্গু রোগী বেশি পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন ডা. রুখসানা। বলছেন, এই সেরোটাইপের আধিক্যেরে কারণেই এনএস-১ পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসছে বেশি।

ডা. রুখসানা রায়হান সারাবাংলাকে বলেন, মানুষের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্তের জন্য পিসিআর পদ্ধতিতে নমুনা পরীক্ষা একটি সর্বজনস্বীকৃত পদ্ধতি। তবে চিকিৎসকরা শুধুমাত্র সন্দেহ করে লক্ষণ বিবেচনায় নিয়ে এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। আবার সবার এনএস-১ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে ডেঙ্গু শনাক্ত নাও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিপদে পড়েন এমন মানুষরা যারা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজ উদ্যোগে এনএস-১ নমুনা পরীক্ষা করিয়ে নেন। ডেঙ্গু নেগেটিভ দেখে তারা নিশ্চিন্ত মনে দিন কাটান। আর তখনই মূল ঝুঁকি শুরু হয়।

ডা. রুখসানা আরও বলেন, এনএস-১ নমুনা পরীক্ষার ফলাফল নেগেটিভ দেখে অনেকেই ডেঙ্গুকে অবহেলা করতে শুরু করেন। চিকিৎসকের কাছে যাওয়াটাও জরুরি মনে করেন না। শুরু হয় জটিলতা। অনেকে শেষ মুহূর্তে হাসপাতালে গেলেও রোগীর অবস্থা জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন- দেশে প্রথমবারের মতো ডেঙ্গু টিকার ‘সফল’ গবেষণা

জ্বর এলেই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে— এমনটিই বলছেন ডা. রুখসানা। তিনি বলেন, নিজের উদ্যোগে এনএস-১ পরীক্ষা করিয়ে নেগেটিভ এলে বিপদের মাত্রা বেশি। কারণ চিকিৎসকরা লক্ষণ দেখে চাইলে এনএস-১ নেগেটিভ রোগীকে পিসিআরে নমুনা পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিতে পারেন। আইজিজি, আইজিএম পরীক্ষা করাতে বলতে পারেন। আবার সিবিসি পরীক্ষা করিয়ে অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। তখন রোগীর শারীরিক অবস্থা জেনে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারেন। রোগী নিজে টেস্ট করালে এর কিছু সম্ভব হয় না। পরে যখন রোগীর অবস্থা গুরুতর হয়, তখন তারা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়, যেটি ভালো চর্চা নয়।

গবেষণা বিষয়ে ডা. জাহিদুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, নিজের ইচ্ছায় কোনো রোগেরই পরীক্ষা করানোটা আত্মঘাতী হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া জরুরি। কারণ একজন চিকিৎসকই একজন রোগীর প্রকৃত শারীরিক অবস্থার তথ্য জানতে পারবেন।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন