বিজ্ঞাপন

‘উন্নত দেশগুলো বড় বড় কথা বলে, পাচার টাকা ফেরতে সহযোগিতা করে না’

October 8, 2023 | 6:22 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ‘উন্নত দেশগুলো আমাদের দেশে এসে বড় বড় কথা বলবে। অথচ আমাদের দেশের টাকা তাদের দেশে পাচার হয়ে গেলে তা ফেরত দিতে সহযোগিতা করে না। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা নেওয়া উচিত। তারা আমাদের টাকা ফেরত দেবে না কেন? হোয়াই নট?’

বিজ্ঞাপন

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থপাচারের অভিযোগে গ্লোবাল ইসলামী (সাবেক এনআরবি গ্লোবাল) ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদারসহ ১৪ আসামির রায় ঘোষণার আগে পর্যবেক্ষণে এমন মন্তব্য করেন বিচারক।

রায় পিকে হালদারকে ২২ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। অপর ১৩ আসামির প্রত্যেকের সাত বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। রোববার (৮ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-১০ এর বিচারক মোহাম্মদ নজরুল ইসলামের আদালত এ রায় ঘোষণা করেন। এছাড়াও কারাদণ্ডের অতিরিক্ত তাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন পরিমাণে অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান গ্রামের এক মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান পিকে হালদার। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার পরিবর্তে নিজের সম্পদ গড়ার নেশায় মত্ত হয়ে উঠে। অবৈধ সম্পদ অর্জনের জন্য আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার, তার মা ও আপন ভাইসহ ঘনিষ্ঠজনদের সহযোগিতায় নামে বেনামে অসংখ্য প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন ।

বিজ্ঞাপন

বিচারক আরও বলেন, একজন মেধাবী নাগরিক তার মেধাকে কাজে লাগিয়ে জাতি গঠনে যেমন ভূমিকা রাখতে পারে ঠিক অপর দিকে তারা অপরাধে জড়িয়ে পড়লে তা জাতির জন্য বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়ায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদার তার একটি দৃষ্টান্ত। মানুষ ব্যক্তি স্বার্থের জন্য অন্ধ হয়ে যায়। আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারের কাছে দেশের স্বার্থের চেয়ে নিজের স্বার্থ অনেক বড় ছিল। আমরা যেন নিজের সামান্য ব্যক্তি স্বার্থের জন্য মানিলন্ডারদের সহযোগী না হই।

রায়ে পর্যবেক্ষণে আরও উল্লেখ করেন, সরকার পাচারকৃত টাকা ফেরত আনতে পদক্ষেপ নিতে পারে। আমি মামলাটি বিচারের সময় রাষ্ট্রপক্ষকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, পাচারকৃত টাকা ফেরত পাঠাতে যে অনুরোধ করা হয়েছিল তার কোন আপডেট আছে কিনা? কিন্তু এর কোন আপডেট জানাতে পারেনি। এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর ভূমিকা নেয়া উচিত। তারা টাকা ফেরত দিবে না কেন? হোয়াই নট?

এদিকে পি কে হালদারকে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ১০ বছরের কারাদণ্ড, ৩৪৮ কোটি তিন লাখ ৬৯ হাজার ৯৩ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে। অর্থপাচারের দায়ে তাকে ১২ বছরের কারাদণ্ডের পাশাপাশি ৬৯৬ কোটি সাত লাখ ৩৮ হাজার ১৮৬ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

পি কে হালদারের মা লিলাবতী হালদার, ভাই প্রিতিশ কুমার হালদার, পূর্ণিমা রানী হালদার, উত্তম কুমার মিস্ত্রি, অমিতাভ অধিকারী, রাজিব সোম, সুব্রত দাস, অনঙ্গ মোহন রায়, স্বপন কুমার মিস্ত্রি, সুকুমার মৃধা, অনিন্দিতা মৃধা, অবন্তিকা বড়াল ও শংখ বেপারী অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে সর্বনিম্ন সাজা তিন বছর করে কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করেছেন।

অর্থপাচারের দায়ের প্রত্যেককে সর্বনিম্ন সাজা চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। প্রত্যেককে বিভিন্ন অংকের টাকা অর্থদণ্ড করেছেন।

এদের মধ্যে লিলাবতী হালদারকে ৫৪ কোটি ২০ লাখ ১৬ হাজার ৩২৪ টাকা, অবন্তিকা বড়ালকে ২০ কোটি ৮৫ লাখ ৩৫ হাজার ৪২৩ টাকা, শংখ বেপারীকে ১৫ কোটি ৫০ লাখ ৪ হাজার ৯১৪ টাকা, সুকুমার মৃধাকে ১৬ কোটি টাকা, তার মেয়ে অনিন্দিতা মৃধাকে ১০ লাখ টাকা, পূর্ণিমা রানীকে সাত কোটি ১৭ লাখ ১৪ হাজার টাকা, উত্তম কুমারকে ৮৩ কোটি ৬৪ লাখ ৪২ হাজার টাকা, অমিতাভ অধিকারীকে ৬৯ কোটি সাত লাখ ১৩ হাজার ৬১৩ টাকা, প্রিতিশ কুমারকে এক কোটি দুই লাখ ২৯ হাজার ৯৭৯ টাকা, রাজিব শর্মাকে ৫৪ কোটি ৯৭ লাখ ৮১ হাজার ৭৩০ টাকা, সুব্রত দাসকে দুই কোটি ৪৯ লাখ ২৬ হাজার, অনঙ্গ মোহনকে ১৩৯ কোটি ২৭ লাখ ৪৪ হাজার ৯৩০ টাকা এবং স্বপন কুমারকে ১৪ কোটি তিন হাজার ১৬১ টাকা অর্থদণ্ড করা হয়েছে।

এছাড়া চারটি ফ্ল্যাট, ৬ হাজার ৪১৯ দশমিক শূন্য ৫৫ ডিসিমিল জমি, ১১ টি যানবাহন, বিভিন্ন ব্যাংকের ৪১ হিসাবের এক কোটি ৮৭ লাখ ৪৭ হাজার ৮৮১ টাকা রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।

বিজ্ঞাপন

সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার। তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। আবার দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন।

পিকে হালদারের জন্ম পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বাবা প্রয়াত প্রণনেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। তার মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আর তার বাবা ছিলেন একজন দর্জি। পিকে হালদার ও তার ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার–দুজনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। পরে দুজনই ব্যবসায় প্রশাসনের আইবিএ থেকে এমবিএ করেন। পাশাপাশি চার্টার্ড ফিন্যান্সিয়াল অ্যানালিস্ট (সিএফএ) সম্পন্ন করেন পিকে হালদার।

শিক্ষাজীবন শেষে পিকে হালদার যোগ দেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে, ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফিন্যান্সের এমডি হন। এরপর ২০১৫-এর জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন। পিকে হালদারের কারণে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নাম বারবার আসায় প্রতিষ্ঠান দুটির নাম পরিবর্তন করে এখন আভিভা ফিন্যান্স ও গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। দুটি প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের এস আলম গ্রুপের।

দুই ভাই মিলে ভারতে হাল ট্রিপ টেকনোলজি নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে, যার অন্যতম পরিচালক প্রীতিশ কুমার হালদার। কলকাতার মহাজাতি সদনে তাদের কার্যালয়। আর কানাডায় পিঅ্যান্ডএল হাল হোল্ডিং ইনক নামে কোম্পানি খোলেন ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে, যার পরিচালক পিকে হালদার, প্রীতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা। কানাডা সরকারের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য অনুযায়ী, কানাডার টরন্টোর ডিনক্রেস্ট সড়কের ১৬ নম্বর বাসাটি তাদের।

২০১৯ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝিতে যখন তার দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠঅনগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হতে শুরু করে, তখন পিকে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। পরে বসবাস শুরু করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। এরপর আবার চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। পিকে হালদারের দখল করা প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। এসব প্রতিষ্ঠানের সব শেয়ার অন্যদের নামে হলেও ঘুরেফিরে আসল মালিক পিকে হালদারই। নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পিকে হালদার গড়ে তুলেছেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে।

এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রাভেল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি অন্যতম। এর বাইরে আনন কেমিক্যাল, নর্দান জুট, সুখাদা লিমিটেড, রেপটাইল ফার্মসহ অনেক প্রতিষ্ঠান।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, পিকে হালদার ও তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে জমা হয় প্রায় ১ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠানের হিসাবে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা, পিকে হালদারের হিসাবে ২৪০ কোটি টাকা এবং তার মা লীলাবতী হালদারের হিসাবে জমা হয় ১৬০ কোটি টাকা। ঋণ নিতে ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিতে কাগজে-কলমে যতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে, তার বেশির ভাগের ঠিকানা পুরানা পল্টনের ইস্টার্ন ট্রেড সেন্টারের ১০ তলা এবং কারওয়ান বাজারের ডিএইচ টাওয়ারের ৮ম ও ১৪তম তলা।

শেয়ারবাজার থেকে শেয়ার কিনে চারটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেন পিকে হালদার। এভাবে নিয়ন্ত্রণ নেয়া চারটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পিপলস লিজিং ও বিএফআইসির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের একধরনের সহায়তা ছিলো। এই দুই প্রতিষ্ঠানের আগের পরিচালনা পর্ষদের একাধিক সদস্য আইন ভেঙে নামে-বেনামে ঋণ নেয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। আর এই সুযোগে এসব কোম্পানির শেয়ার কিনে প্রতিষ্ঠান দুটির নিয়ন্ত্রণ নেন পিকে হালদার।

চাকরিজীবনের শুরু থেকে পিকে হালদার চলতেন বীরদর্পে। রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল শুরু করেন। এতে তাকে সহায়তা করেন রিলায়েন্স ফিন্যান্সের মালিকেরা। এমডি থাকা অবস্থাতেই তিনি অন্য চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন। এরপর রিলায়েন্স ফিন্যান্সের পরিস্থিতি খারাপ হলে তাকে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি করে পাঠানো হয়। তবে সেই ব্যাংকে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি তাকে।

দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দখলে পিকে হালদার ছিলেন সক্রিয় ভূমিকায়। একইভাবে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান দখলেও নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি।

সারাবাংলা/এআই/এনইউ

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন