বিজ্ঞাপন

অবরোধে ক্রেতা নেই খাতুনগঞ্জে, শ্রমিকদের আয়ে টান

November 6, 2023 | 11:58 am

ইমরান চৌধুরী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: বিএনপি-জামায়াতের ডাকা অবরোধ-হরতালের প্রভাব পড়েছে দেশের বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের ব্যবসা-বাণিজ্যে। দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা বাজারে আসতে পারছেন না। দূরপাল্লার পণ্য পরিবহনকারী গাড়ি চলাচল সীমিত হয়ে গেছে। ক্রেতা কমে যাওয়ায় প্রায় অলস সময় কাটছে আড়তদারদের। বিক্রি ও সরবরাহ কমে যাওয়ায় অলস সময় কাটছে শ্রমিকদেরও, প্রভাব পড়েছে তাদের দৈনন্দিন আয়ে।

বিজ্ঞাপন

বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে বেচাকেনা, লেনদেন অনেক কম। সরবরাহ কমায় গুদামে জমছে ভোগ্যপণ্যের স্তূপ। আড়তে সারি সারি বস্তায় মজুত করা পণ্য, কিন্তু ক্রেতা নেই।

খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই থেকে তিন পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান ও পর্যটন নগরী কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামে বিভাগের ১১টি জেলায় পণ্যের জোগান দেওয়া হয়। এর বাইরে সারাদেশেও অনেক পণ্য সরবরাহ করা হয় খাতুনগঞ্জ থেকে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, টানা অবরোধে নাশকতার আশঙ্কায় দেশের জেলা-উপজেলা ও মোকামগুলো থেকে পণ্য নিতে ট্রাক বাজারে আসতে পারছে না। এর মধ্যেও যেসব ট্রাক ঝুঁকি নিয়ে বের হতে রাজি হচ্ছে, তাদের ভাড়াও হাঁকা হচ্ছে স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। মাল নিতে আসা ট্রাকের সংখ্যা তাই কমে গেছে। ফলে আড়তে পণ্যের কোনো সংকট না থাকলেও পরিবহনের সংকটে পণ্য বিক্রি কমে গেছে উদ্বেগজনক হারে। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে প্রান্তিক পর্যায়ে সরবরাহ কমে পণ্যের দাম বেড়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

বিজ্ঞাপন

সরকারবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর ঢাকার নয়াপল্টনে বিএনপির সমাবেশের দিন বাসে আগুন, পুলিশ বক্স ভাঙচুর, এক পুলিশকে পিটিয়ে হত্যা থেকে শুরু করে প্রধান বিচারপতির বাসভবনে হামলার ঘটনা পর্যন্ত ঘটে। ওই দিন পুলিশের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় বিএনপির নেতাকর্মীদের।

এর জের ধরে ২৯ অক্টোবর হরতাল আহ্বান করে বিএনপি। একই দিন ঢাকায় প্রায় নির্বিঘ্নে সমাবেশ করলেও জামায়াতও যুগপৎভাবে হরতাল আহ্বান করে। ২৯ অক্টোবরের হরতাল শেষে ওই সপ্তাহে বিএনপি-জামায়াত টানা তিন দিন সর্বাত্মক অবরোধের ডাক দেয়। সে কর্মসূচি শেষ হওয়ার মুহূর্তে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ফের এ সপ্তাহের প্রথম দুই কর্মদিবসে অবরোধ ঘোষণা করে বিএনেপি-জামায়াত। এ ছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরীকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে রোববার সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করেছে বিএনপি।

কাজ না পেয়ে অলস সময় কাটাচ্ছেন শ্রমিকরা, হয়ে পড়েছেন উপার্জনহীন। ছবি: শ্যামল নন্দী

দ্বিতীয় দফা অবরোধের প্রথম দিন রোববার (৫ নভেম্বর) সকালে বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে কিছু ট্রাক এলেও খাতুনগঞ্জে নেই চিরচেনা ব্যস্ততা। নেই শ্রমিকদের হাঁকডাক। আড়তদাররা দোকান খুলে বসে থাকলেও ক্রেতাদের উপস্থিতি দেখা গেছে সামান্য। অথচ পণ্য ওঠানামার কাজে প্রতিদিন খাতুনগঞ্জের সড়কেই অপেক্ষারত থাকতে হতো অসংখ্য ট্রাককে। এখন রাতে অল্প কিছু ট্রাক বাজারে ঢুকলেও বেচাকেনায় চলছে ভাটা।

বিজ্ঞাপন

এদিকে ক্রেতা কমে যাওয়ায় গত তিন দিনের ব্যবধানে পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, পেঁয়াজ কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা পর্যন্ত কমেছে। বর্তমানে খাতুনগঞ্জে পাইকারিতে ভারতের নাসিক অঞ্চলের পেঁয়াজ প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৮৫ টাকায়, দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮০ টাকায়। প্রতিকেজি আদা পাইকারিতে বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। প্রতিকেজি দেশি রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়, চায়না রসুন বিক্রি হচ্ছে ১৫০ থেকে ১৬০ টাকায়।

চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ আড়তদার সাধারণ ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. মহিউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধের কারণে পরিবহন সংকট দেখা দিয়েছে। গাড়ি ভাড়া বেশি চাওয়া হচ্ছে। চট্টগ্রামের বাইরের ব্যবসায়ীরা ভোগ্যপণ্য কিনতে আসতে পারছে না। এতে ব্যবসা-বাণিজ্যে ধস নেমে এসেছে। আমরা ক্ষতির মুখে পড়েছি। ক্রেতা নেই, বেচাকেনা কম। আমার এখানে ১৫ জন স্টাফ। তাদের বেতন দিতে হিমশিম খাচ্ছি। তবে বাজারে কোনো পণ্যের সংকট নেই। অবরোধ থাকলেও এখানে সব খোলা। ব্যাংক থেকে শুরু করে সব।’

খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ মো. ছগীর আহম্মদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘অবরোধ ও হরতাল দিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো আদৌ কিছু পায় কি না, আমি জানি না। গাড়ি পোড়ানো রাজনীতি না, এটা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। অবরোধ-হরতাল দিয়ে গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করলে কোন মালিক তার গাড়ি রাস্তায় বের করতে দেবে? আমরা ব্যবসায়ীরাই তো দেশের চালিকাশক্তি। কিন্তু বারবার আমাদের টার্গেট করা হয়। বোমা ও আগুনের ভয়ে কেউ গাড়ি বের করছে না। ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে ভয় পাচ্ছে।’

তিন দিন ধরে উপার্জনহীন বক্কর

কুমিল্লার বাসিন্দা আবু বক্কর পরিবার নিয়ে থাকেন চট্টগ্রাম নগরীতে। কাজ করেন খাতুনগঞ্জের একটি মসলার আড়তের খালাসি শ্রমিক হিসেবে। এমনিতেই বছরের ১২ মাসে মসলার বেচাকেনা কম থাকে। গত এক সপ্তাহ ধরে বিএনপি-জামায়াতের টানা অবরোধে খাতুনগঞ্জে গাড়ি আসতে না পারায় আড়ত থেকে পণ্য বিক্রি আরও কমে গেছে।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় বক্করের গত তিনদিন ধরে কোনো আয় হয়নি। ছয় সদস্যের পরিবারের ভরণপোষণ নিয়ে এখন দুশ্চিন্তা বক্করের।

আবু বক্কর সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা শ্রমিক মানুষ। দিন এনে দিন খাই। একদিন রোজগার না থাকলে বউ-ছেলে-মেয়ে নিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। আমাদের কথা সরকার ভাবে না। রাজনীতি তো করি না, তবে একটু একটু বুঝি। আমরা শ্রমিকরা যে না খেয়ে আছি, এগুলো কি রাজনীতিবিদরা ভাবেন? হরতাল করে গাড়ি পুড়ানো আমরা কেউ সমর্থন করি না।’

মো. কাওছার নামে এক শ্রমিক সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ বস্তার কাজ থাকে। অথচ গত এক সপ্তাহে ১০০ বস্তাও মাল ট্রাকে উঠাতে পারিনি। গতকাল (শনিবার) ১৮ বস্তা মাল উঠিয়ে ২১০ টাকা পেয়েছি। দুপুর ও রাতের খাবারেই ১৫০ টাকা চলে গেছে। বাকি টাকা দিয়ে আজ (রোববার) সকালের নাস্তা করেছি। টাকা তো আর থাকল না। আমাদের গুদামে আগে ২২ জন জন শ্রমিক কাজ করত। কাজ নেই দেখে এখন আমরা আছি মাত্র তিনজন।’

বৃহত্তর খাতুনগঞ্জ লোডিং-আনলোডিং শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মো. ইব্রাহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে মোট শ্রমিক পাঁচ হাজারের মতো। এর মধ্যে তিন হাজার শ্রমিক তালিকাভুক্ত। অবরোধে খাতুনগঞ্জে সব কিছু স্বাভাবিক থাকলেও ক্রেতা নেই বললেই চলে। তাই অনেক শ্রমিক কাজ না পেয়ে বসে আছে। অনেকেই বাড়ি চলে গেছে। অনেক গুদামে পণ্য রাখার জায়গা নেই।’

ছবি: শ্যামল নন্দী, ফটো করেসপন্ডেন্ট

সারাবাংলা/আইসি/আরডি/টিআর

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন