বিজ্ঞাপন

‘কর্নেল হুদা হত্যা মামলা উইথড্র করতে বলেছিলেন অলি’

January 2, 2024 | 11:22 pm

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর শহীদ কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রমকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের জন্য তাঁর মেয়েকে ফোন করেছিলেন অলি আহমেদসহ কয়েকজন বিএনপি নেতা। কিন্তু হুদার মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান তাদের অনুরোধ প্রত্যাখান করেন।

বিজ্ঞাপন

মঙ্গলবার (২ জানুয়ারি) বিকেলে নগরীর থিয়েটার ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ‘মুক্তিযোদ্ধা-সৈনিক হত্যা ও হত্যার রাজনীতি এবং ১৯৭৫ থেকে বর্তমান’ শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেছেন। বক্তব্যে নাহিদ ইজাহার খান তার বাবাকে মর্মান্তিকভাবে হত্যার পরবর্তী সময়ে তাদের বিভিন্ন প্রতিকূলতা মোকাবিলার বিষয় তুলে ধরেন। এসময় তিনি বারবার আবেগাক্রান্ত হয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

কর্নেল খন্দকার নাজমুল ‍হুদা যশোর ৮ নম্বর সেক্টরের সাব–সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ঢাকায় জাতীয় সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপথগামী ও বিশৃঙ্খল সদস্যদের হাতে কর্নেল খন্দকার নাজমুল হুদা বীরবিক্রম নিহত হন। তিনি তখনকার সেনাবাহিনীর রংপুরের ৭২ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। নাজমুল হুদার সঙ্গে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীরউত্তমও নিহত হন।

হত্যাকাণ্ডের ৪৭ বছর পর গতবছরের ১৭ মে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন ‍হুদার মেয়ে সংসদ সদস্য নাহিদ ইজাহার খান। মামলায় অবসরপ্রাপ্ত মেজর আবদুল জলিলকে প্রধান আসামি করা হয়। এছাড়া তৎকালীন সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং জাসদ নেতা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবু তাহেরকে হুকুমের আসামি করা হয়।

বিজ্ঞাপন

মামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করে নাহিদ বলেন, ‘মামলা দায়েরের পর আমাকে কর্নেল অলি আহমেদসহ অনেক বিএনপি নেতা কল দিয়ে উইথড্র করতে বলেন। আমি তাদের স্পষ্ট করে বলি- আমি কি তারেক জিয়া? তিনি তার বাবার হত্যাকারীদের বিচার না চাইতে পারেন, কিন্তু আমি আমার বাবার হত্যাকারীদের বিচার আমি চাই। খালেদা জিয়া কেন তার স্বামী হত্যার মামলা করেননি ? তারেক জিয়া কেন তার পিতা হত্যার জন্য মামলা করেননি? কেন আপনারা করেননি? আমার কথায় তারা চুপ হয়ে যায়।’

বাবা হারানোর ঘটনাক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা সেনাবাহিনীর রংপুরের ৭২ ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর বাবাকে কল রংপুর থেকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও তিনি জানতেন না, আগের রাতে জাতীয় চার নেতাকে খুন করা হয়েছে।’

‘আমার মা, আমি, আমার ভাই সেদিন রংপুরে ছিলাম। আমরা যদি বাবাকে যেতে না দিতাম, তাহলে উনাকে হারাতে হতো না। আমি ও আমার ভাই শিশু বয়সে বাবা-হারা হতাম না;- একথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাহিদ

বিজ্ঞাপন

‘৭ নভেম্বর সকালে জিয়াউর রহমানের নির্দেশে দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট অফিসে এখন যেটা জাতীয় সংসদ ভবনের এমপি হোস্টেল, সেখানে আমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ কর্নেল নাজমুল হুদার সঙ্গে অপর দুই সেক্টর কমান্ডার শহীদ মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ ও লেফটেন্যান্ট কর্নেল এ টি এম হায়দার বীর উত্তমকে গুলি করে হত্যা করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমরা তখনও জানতাম না, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। খোঁজখবর না পেয়ে আমার মা আমাকে আর ভাইকে নিয়ে ঢাকায় খালার বাসায় গিয়ে ওঠেন। খালু জানান যে, আমার বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। মা জিয়াউর রহমানকে কল দেন। বাবার লাশটা দেয়ার অনুরোধ করেন। মা জানতেন না, এই জিয়াউর রহমানই বাবার খুনি।’

‘বাবাকে দাফন করার জন্য আমার মা সামরিক কবরস্থানে এক টুকরো জায়গা চেয়েছিলেন। যেহেতু বাবা বীর ‍মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন, মা দেশের পতাকা চেয়েছিলেন। ফোনের ও-পাশে জিয়াউর রহমান তখন একদম নিশ্চুপ ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কিছুই দেওয়া হবে না শুধু লাশ ছাড়া। তা-ও মাকে নিজে গিয়ে লাশ আনতে বলেছিলেন। এরপর আমার মামারা নিজেরাই বাস চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বাবার লাশ এনেছিলেন। বাবার শরীর থেকে তখনও রক্ত ঝরছিল।’

বাবা-হারা জীবনে নানা ঝড় মোকাবেলার তথ্য তুলে ধরে নাহিদ বলেন, ‘আমি ও আমার ভাই অনেকদিন আমরা স্কুলে ভর্তি হতে পারিনি। ভারতের দালাল বলা হতো আমাদের। আমার ভাই স্কুলে যেতে চাইতো না। বাসা পরিবর্তন করতে হয়েছে অনেকবার। বলতে গেলে একপ্রকার মানসিক ও অর্থনৈতিক যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে আমাদের। প্রতিটি পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি। বাবা না থাকা যে কতটা কষ্টদায়ক সেটা প্রধানমন্ত্রী বোঝেন। আর আমার মতো সন্তানরা যাদের বাবাকে খুনি জিয়া হত্যা করেছেন, তারা বোঝেন। আমাদের এ কষ্টের জন্য দায়ি খুনি জিয়া।’

বিজ্ঞাপন

নাহিদ ইজাহার খান বলেন, ‘১৯৭৭ সালে জিয়াউর রহমান বিনাদোষে ১ হাজার ১০০ জনের বেশি নিরপরাধ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর কর্মকর্তা এবং সৈনিকদের ফাঁসি দিয়ে হত্যা করে। এখনও অনেকেই জানে না তাদের বাবা আদৌ কোথায়। ১৯৭৫ সাল থেকে থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত জিয়াউর রহমান যেভাবে মানুষ মেরেছিল, ওটা ছিল একটা পদ্ধতি। গুলি, ফাঁসি ও বেয়নেট মেরে মানুষ হত্যা করে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার করার পদ্ধতি। মানুষের রক্তে হাত রঞ্জিত করে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পদ্ধতি।’

জিয়াউর রহমান তার রক্তে রঞ্জিত হাত স্ত্রী খালেদা জিয়া, ছেলে তারেক জিয়া এবং তার দল বিএনপিকে দিয়ে গেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘খালেদা জিয়ার হাতও মানুষের রক্তে রঞ্জিত। তাদের ছেলেও একইরকম। খালেদা জিয়াও মানুষ মেরেছে, গুম করেছে। তারেক জিয়া একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা করে ২৪ জনকে খুন করেছে।’

‘জাতির পিতাকে হত্যার দিনে বেহায়ার মতো জিয়াউর রহমানের স্ত্রী খালেদা জিয়া জম্মদিন পালন করেন। তার নাকি বছরে জম্মদিন পাঁচটি। কতটুকু নির্লজ্জ হলে এরকম কাজ করা যায় ! এটাই পার্থক্য মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ও বিপক্ষের।’

বিএনপি নেতাদের চরিত্রও একই মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘ঢাকার সাবেক মেয়র সাদেক হোসেন খোকাকে আপনারা মুক্তিযোদ্ধা বলেন। তিনি মেয়র থাকার সময়ে রাস্তার নামকরণ করা হচ্ছিল। আমার মা ও ভাই গিয়েছিলেন বাবার নামে একটি রাস্তার জন্য। তিনি দরখাস্ত মাটিতে ছুড়ে ফেলে তাদের অপমান করে বের করে দেন।’

‘আমি সংসদ সদস্য হওয়ার পর যেখানে আমার বাবাকে জিয়াউর রহমান খুন করেছে, সেই জাতীয় সংসদের সামনের রাস্তা আমি আমার বাবার নামে করেছি। ২০২২ সালে বাংলাদেশ সরকার আমার বাবাকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন। আমি আমার বাবার সৌভাগ্যবান মেয়ে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ইতিহাস খুবই নির্মম। কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাসের সে নির্মম খুনি জিয়াউর রহমান বারো আউলিয়ার দেশ বলে খ্যাত এ চট্টগ্রামের মাটিতেও ঠাঁই পাইনি। তার ছেলে তারেক জিয়া দেশ থেকে টাকা চুরি করে লন্ডনে বসে আমোদ-ফূর্তি করছে আর দেশে আন্দোলনের নামে মানুষ হত্যা করছে। এছাড়া বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করে দেশের নামে অপপ্রচার চালিয়ে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। তার দলের নেতারাও কেউ তার পাশে নেই।’

সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে একুশে পদকপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী অনুপম সেন বলেন, ‘যারা ১৯৭১ সালে নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করেছে, তারাই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে। ১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত হাজারো নিরপরাধ মানুষকে গুলি করে ও ফাঁসি দিয়ে খুন করেছে। জিয়াউর রহমান একজন হৃদয়হীন ব্যক্তি। তিনি কখনও যুদ্ধ করেননি। আমি নিজে তার সাক্ষী। যখন সবাই মুক্তিযুদ্ধ করছিল তখন তিনি সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করতে গিয়েছিলেন।’

মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা পরিষদের মহাসচিব মো. ইউনুছের সভাপতিত্বে এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) কলা ও মানববিদ্যা বিভাগের সাবেক ডিন সেকান্দর চৌধুরীর সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন- চবি’র উপ-উপাচার্য বেণু কুমার দে, রাঙ্গামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সেলিনা আক্তার, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক এ এইচ এম জিয়াউদ্দিন এবং চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হক।

সারাবাংলা/আইসি/একে

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন