বিজ্ঞাপন

যে কারণে রাঙ্গাঁ ও আসিফের পরাজয়

January 8, 2024 | 6:14 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রংপুর: রংপুর-১ আসনে জাতীয় পার্টির সাবেক মহাসচিব ও জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গাঁকে ব্যাপক ভোটে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান বাবলু। এর মধ্য দিয়ে রংপুর-১ আসনে দীর্ঘ ৫২ বছরের জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক দৃশ্যপটের পরিবর্তন ঘটেছে। রাঙ্গাঁ ভোটের ফলাফলে দ্বিতীয় হয়েছেন। আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের ভাতিজা হোসেন মকবুল শাহরিয়ার আসিফ হয়েছেন তৃতীয়।

বিজ্ঞাপন

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে এ আসনে মনোনয়ন পান রংপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু। কিন্তু আসন সমঝোতার কারণে লাঙ্গলের প্রার্থী হোসেন মকবুল শাহরিয়ারকে আসিফকে আসনটি ছেড়ে দিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাহার করেন রাজু। তবে গঙ্গাচড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেন। আর এই আসনে জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন না পেয়ে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়াই করেন। আসনটিতে হেভিওয়েট স্বতন্ত্র প্রার্থী বাবলু থাকায় শুরু থেকেই অস্বস্থিতে ছিলেন জাপা প্রার্থী আসিফ এবং রাঙ্গাঁ।

এই আসনটি নিয়ে কথা উঠলে সবার আগে আসতো জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নাম। দ্বিতীয় যদি কারও নাম আসত তাহলে মসিউর রহমান রাঙ্গাঁর নাম। তবে রাঙ্গাঁ এবং জাতীয় পার্টির প্রার্থীর শোচনীয় পরাজয়ের মাধ্যমে আসনটিতে লাঙলের দুর্গ ভেঙে গেলো গতকালের ফলাফলের পর। স্বাধীনতার পর থেকেই এই আসনটি বহিরাগতপ্রার্থী নির্বাচিত হয়ে আসছিলেন। ১৯৮৬ সাল থেকেই জাতীয় পার্টি এ আসনটি এক অর্থে শাসন করে আসছিল। তাই প্রতিবারের নির্বাচনের মতো এবারও আসনটি ধরে রাখতে জাপা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও পারেনি। শেষ পর্যন্ত অঘোষিতভাবে আওয়ামী লীগের ঘরে হস্তান্তর হলো আসনটি। অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে প্রথম সংসদ সদস্য পেলো এ আসনের ভোটাররা।

তবে সাধারণ ভোটার ও জাতীয় পার্টি ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাঁচটি কারণে ব্যাপকভাবে পরাজিত হয়েছেন রাঙ্গাঁ ও আসিফ। ২০০১ সালে জাতীয় পার্টি থেকে এ আসনে সংসদ সদস্য হন রাঙ্গাঁ। আর ২০০৮ সালে এ আসনে সংসদ সদস্য হন আসিফ। আবার ২০১৪ সালে রাঙ্গাঁ আবার এ আসনে জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য হয়ে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী হন। এছাড়া ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি থেকে জয়ী হয়ে তিনি জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ হন। রাঙ্গাঁ ২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বর থেকে ২০২০ সালের ২৬ জুলাই পর্যন্ত জাতীয় পার্টির মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করেন। তবে গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর রওশন এরশাদ ইস্যুতে পক্ষ নেওয়ায় জাতীয় পার্টির (জাপা) প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ দলের সব পদ-পদবি থেকে মসিউর রহমানকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বিজ্ঞাপন

তবে রাঙ্গাঁ জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও রওশন এরশাদের পক্ষ নিয়ে এবারের নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন নেওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টার পরও ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। তবে রাঙ্গাঁর নিশ্চিন্ত ছিলেন যে আসনটিতে তিন বার নির্বাচিত হয়ে ১৫ বছরে যেসব উন্নয়ন করেছেন সেদিক বিবেচনায় তিনি উতরে যাবেন। যদিও রাঙ্গাঁ গঙ্গাচড়ার বাসিন্দা না হওয়ায় দীর্ঘদিন থেকেই ভোটাররা মানতে পারছিলেন না। অভিযোগ আছে, রাঙ্গাঁ ২০১৪ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে জাপার ত্যাগী নেতাকর্মীদের অবমূল্যায়ন করতে করতে থাকেন। এতে করে রাঙ্গাঁর সঙ্গে দূরত্ব বাড়ে নেতাকর্মীদের।

জাতীয় পার্টির তৃণমূলের নেতাকর্মী স্থানীয় জনগণের অভিযোগ, রাঙ্গাঁ দলে হাইব্রিড নেতাকর্মী সব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করেন। এতে করে জাপার ত্যাগী কর্মীরা অবমূল্যায়নের ফলে রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়েন। আর রাঙ্গাঁর ঘনিষ্ট নেতাকর্মীরা এমপির নামে বিভিন্ন বরাদ্দের চালসহ বিভিন্ন প্রকল্পে কমিশন বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। সেই চক্রটি রাঙ্গাঁকে সাধারণ মানুষের থেকে জনবিচ্ছিন্ন করে দেয়। চক্রটি চাকরি দেওয়ার নামে শতশত মানুষের কাছে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়। বরাবরের মতো এবারের নির্বাচনেও প্রচারণায় রাঙ্গাঁর সঙ্গেই ছিল চক্রটি। তবে ভোটের মাঠে রাঙ্গাঁর সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা হয়নি।

অভিযোগ রয়েছে এলাকার কোন সমস্যা নিয়ে রাঙ্গাঁর কাছে গেলে কেউ দেখা করার সুযোগ পায় না। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গেলেই শুধুমাত্র দেখা করার সুযোগ পায়। যার বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে নির্বাচনে। ক্ষুব্ধ ভোটারটা ভোট দেওয়ার বেলায় রাঙ্গাঁকে এড়িয়ে গেছেন। অন্যদিকে গঙ্গাচড়া উপজেলার বেশিরভাগ কেন্দ্রেই তার এজেন্ট ছিল না বলে জানা গেছে। পোলিং এজেন্ট হিসেবে যাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের খাদ্য ও অন্যান্য ব্যয়ের যে অর্থ বরাদ্দ ছিলো সে সিন্ডিকেট চক্র হাতিয়ে নেওয়ায় এজেন্টরা কেন্দ্র ছেড়ে চলে যায়। এতে করে বেকায়দায় পড়ে যান রাঙ্গাঁ।

বিজ্ঞাপন

একসময়ের রাঙ্গাঁ ভোটব্যাংক তিস্তা নদী বেষ্টিত গঙ্গাচড়া উপজেলার দুর্গম চরাঞ্চল ও রংপুর সিটি করপোরেশনের ১ থেকে ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ভোটার হলেও এবার তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। বেশিরভাগ ভোট গেছে স্বতন্ত্র প্রার্থী বাবলুর পক্ষে। ভোটাররা বলেছেন, যে সিন্ডিকেটটি রাঙ্গাঁকে সবসময় ঘিরে রাখতেন গত ১০ বছরে তাদের পকেট ভারী হলেও রাঙ্গাঁর বিপদে কাজ করেননি। সিন্ডিকেটটি কমিশন বাণিজ্য করে বিপুল টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। বঞ্চিত করেছেন প্রাপ্য উপকারভোগীদের।

আর স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান গঙ্গাচড়ার বাসিন্দা হওয়ায় দীর্ঘ ৫২ বছরের রীতি ভাঙতে সক্ষম হয়েছেন ভোটাররা। ভোটের মাঠে প্রকাশ্যে স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত ছিলো ‘বহিরাগত হঠাও এলাকাবাসীকে ভোট দাও।’ এসব স্লোগান সাধারণ মানুষের মধ্যে আবেদন তৈরি করতে সক্ষম হন বাবলু। তাছাড়া রংপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী আসাদুজ্জামান দলীয় নেতা হিসেবে পুরো আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা তার পক্ষে কাজ করেছেন। আর আওয়ামী লীগের যেসব নেতাকর্মী রাঙ্গার পক্ষে ছিলেন সেই নেতারা বাবলুকে সমর্থন করেন। ফলে একদিকে জাতীয় পার্টির ভোট এবং বিক্ষুব্ধ ভোটারদের কারণে রাঙ্গা ৫০ হাজার ভোটের ব্যবধানে স্বতন্ত্র প্রার্থীর কাছে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হন।

জাতীয় পার্টির জেলা ও মহানগরের নেতাকর্মীরা জানান, গঙ্গাচড়ায় জাতীয় পার্টি সাংগঠনিকভাবে একেবারে দুর্বল। বেশিরভাগ নেতাকর্মী রাঙ্গাঁকে সমর্থন করায় নির্বাচনি প্রচারণায় ভোটারদের আবেদন সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়েছে আসিফ। অপরদিকে আসিফ বহিরাগত হওয়ায় ভোটাররা এক অর্থে লাল কার্ড দেখিয়েছেন। রংপুর নগরীর পৈতৃক বাসা স্কাই ভিউ থেকে দুপুরের পর নির্বাচনি এলাকায় গিয়ে প্রচার চালানোটাও সাধারণ ভোটাররা ভালোভাবে নেননি। কোনো কেন্দ্রেই জাপার পোলিং এজেন্ট ছিল না। ফলে আসিফ রংপুর-১ আসনের প্রার্থী হিসেবে ভোটারদের মাঝে কোনো স্থান করতে না পারায় মাত্র ১০ হাজার ৮৯২ ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান লাভ করে শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছেন।

বিজ্ঞাপন

সারাবাংলা/একে

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন