বিজ্ঞাপন

ফার্স্টবয়ের আত্মহত্যার দেশে

May 22, 2018 | 4:08 pm

। মেহেদী উল্লাহ ।

বিজ্ঞাপন

মেধাবী ছাত্র দেবাশীষ মণ্ডলের আত্মহত্যার ঘটনায় আমি শোকাহত, মর্মাহত, বিস্মিত ও হতাশ। কেন বিস্মিত ও হতাশ সেই প্রসঙ্গে যাবার আগে দেবাশীষ মণ্ডলের আত্মহত্যার কারণটি জানানো দরকার। খবরে প্রকাশ: ‘কুষ্টিয়া শহরে রবীন্দ্র মৈত্রী বিশ্ববিদ্যালয় নামের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের একজন শিক্ষকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর গুরুতর অভিযোগ তুলেছে পরিবার। শিক্ষক দেবাশীষ মণ্ডলের বাবা ও ভাই ঘটনার জন্য পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্যকে দায়ী করছেন। তাদের ভাষ্য, ভিসি ১০ লাখ টাকায় দেবাশীষকে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার আশ্বাস দেন। পরে তিনি টাকার অঙ্ক ১৫ লাখ করলে সে চাপ সইতে না পেরে দেবাশীষ গত ১৪ মে আত্মহত্যা করেন। (চাকরিপ্রার্থীর আত্মহত্যা নানা প্রশ্ন, কালের কণ্ঠ, ১৭ মে ২০১৮)

আমি বিস্মিত এই কারণে, জানা গেছে, দেবাশীষ মণ্ডল বিভাগে তার ব্যাচের ফার্স্টবয় ছিলেন। কিন্তু এই মেধাবী শিক্ষার্থী কী করে রাজি হলেন ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার জন্য! পরিবারের অভিযোগ যদি সত্য হয়, তবে দেশের উচ্চশিক্ষার জন্য তা খুবই আশঙ্কার। আরো একটি কারণে বিস্মিত হয়েছি, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘শিক্ষক’ হতেই হবে এই স্বপ্নে বিভোর ছিলেন দেবাশীষ। ফলে স্বপ্নভঙ্গের বেদনা সইতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। তিনি যদি সত্যিই মেধাবী হবেন, তার সামনে কি অন্য কোনো পথ খোলা ছিল না? দুঃখজনক হলেও সত্য, দেবাশীষ তার উত্তরসূরি মেধাবীদের জন্য দৃষ্টান্ত তো রেখে গেলেনই না, উল্টো মৃত্যুর আগে বড় দুটি ভুল করে গেলেন। ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়ার আগ্রহটি ভুল তো বটেই, অপরাধ ছিল। দেবাশীষের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর ভাষা আমার জানা নেই।

দেবাশীষের আত্মহত্যা সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার অসম্পূর্ণতার দিকটিকে হাজির করে। যেটি ভেবে হতাশ হই। যেখানে মেধা কোনো বিষয় নয়, কর্তৃপক্ষের হাতেই নিয়োগের সব ক্ষমতা ন্যস্ত। ফলে মেধার চেয়ে ঘুষের টাকাই মূখ্য হয়ে উঠেছে। ঘুষের টাকা নিয়ে দরাদরি প্রমাণ করে একমাত্র যোগ্যতা এটিই। এবং এই কর্মকাণ্ডে বোঝা যায়, নিয়োগের জন্য যে মৌখিক পরীক্ষার আয়োজন সেটিও সাজানো। নামকাওয়াস্তে মৌখিক পরীক্ষার নম্বর বিবেচ্য নয়, বিবেচনা কাকে নেওয়া হবে সেটি ঠিক করবে কর্তৃপক্ষ, আর সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সাহায্য করবে আর্থিক লেনদেন।

বিজ্ঞাপন

পরিবারের অভিযোগ অনুসারে, এই ঘটনায় প্রার্থী বাছাইয়ের মানদণ্ড ঘুষ হলেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আরো যেসব অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পাওয়া যায় তার মধ্যে অন্যতম হলো, ‘পছন্দের প্রার্থী’। গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে জানতে পারি, পছন্দের প্রার্থী হয়ে উঠার যোগ্যতা নানা রকম। যেমন, ক্ষমতা, নিয়োগ বোর্ডের পরীক্ষকদের পছন্দের ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে, পছন্দের প্রার্থী যদি সত্যিই যোগ্য হয় তবে বিশ্ববিদ্যালয় বেঁচে গেল, কিন্তু পছন্দের প্রার্থীর চেয়েও যদি যোগ্য প্রার্থী নিয়োগ বোর্ডে থাকা সত্ত্বেও বাদ পড়ে শুধু কারো পছন্দের হয়ে উঠতে পারল না বলে, তবে এক্ষেত্রে বলব বিশ্ববিদ্যালয় নিজেই আত্মহত্যার পথ বেছে নিল। নিচ্ছেও। কিন্তু তাতে কী! দেবাশীষরা আত্মহত্যা করছে! বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আত্মহত্যা করছে কি না -এ নিয়ে কারো ভাবান্তর নেই। দেশের উচ্চশিক্ষা এভাবে ধ্বংস হচ্ছে কি? এই প্রশ্ন করতেও ভয় পাচ্ছি। কারণ, কর্তৃপক্ষ যদি মনে করেন, ‘নাহ! মোটেও হচ্ছে না!’ তবে তাই। ভিন্ন ও আলাদা কিছু ভাবতে ভয় লাগে এখন!

কেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘পছন্দের প্রার্থী’ নিয়োগ দেওয়া পানির মতো সোজা? নানা সময়ে বঞ্চিত মেধাবীদের সাথে কথা বলে জেনেছি, শুধু মাত্র একটি মৌখিক পরীক্ষা নেওয়াই এর কারণ। অনেক মেধাবী ভাইভা বোর্ডে অংশ নেওয়ার আগেই বলে ফেলেন অকপটে, ‘আমাকে নেবে না।’ ‘পরীক্ষাই হলো না, কীভাবে জানলেন!’ পাল্টা প্রশ্ন করলে তখন তাদের অস্ফুটে উত্তর, ‘পরে মিলিয়ে নিস।’ অধিকাংশ ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখেছি, মিলে গেছে। মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও তাদের চাকরি হয়নি। ধারণারও বাইরে এমন সব প্রার্থী শিক্ষক হয়েছেন। এই চিত্র পুরনো-নতুন বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়েরই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মৌখিক পরীক্ষার সমস্যাটা কী? আর ভাইভার জন্য যাদের ডাকা হয় সবাই তো মেধাবী, নিয়োগ-বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশিত সব শর্ত পূরণ করলেই তো ভাইভার জন্য ডাক পান। উত্তর হচ্ছে, শুধু মৌখিক পরীক্ষা সমস্যা নয়, অসম্পূর্ণতা। মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পাওয়া প্রার্থীদের রেজাল্ট যেহেতু কম বেশি সমানই থাকে তাই এই সামান্য সময়ের মধ্যে প্রার্থী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। এ যেন প্রার্থী বাছাই নয়, পছন্দের প্রার্থীর কথা মাথায় রেখে প্রার্থী বিসর্জন! খোদ মৌখিক পরীক্ষায় যারা অংশ নেন তাদের কাছেই এই নির্বাচন প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারছে না। ফলে অনাস্থা তৈরি হচ্ছে নিয়োগ বোর্ডে থাকা সদস্যদের প্রতি। এক্ষেত্রে উপাচার্যের পছন্দের প্রার্থী থাকলে এবং তাকে নেওয়ার আয়োজন চলতে থাকলে সেই সব বহিঃস্থ সদস্যরাও মাঝেমধ্যে বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে যান। সাক্ষী গোপাল হয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায়ান্তর থাকে না।

তাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়ার পরিবর্তন জরুরি। এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও পরিপূর্ণতা আনতে যোগ করা দরকার আরো কয়েকটি ধাপের পরীক্ষা।  বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজন এই বিষয়ে কথাও বলেছেন। সেই লব্দজ্ঞান ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা মিলিয়েই কয়টি প্রস্তাব-

বিজ্ঞাপন

১.  শিক্ষা জীবনের তিনটিতে প্রথম শ্রেণি আছে এমন শিক্ষার্থীরা আবেদন করতে পারবেন প্রভাষক পদে। তাদেরকে নিয়োগ পরীক্ষায়  আহ্বান জানানো হবে।

২. ২০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা। ১০০ নম্বর প্রার্থীর সংশ্লিষ্ট বিষয়-ভিত্তিক এবং ১০০ নম্বর গবেষণা-পদ্ধতির ওপর (ল্যাব-সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে ল্যাব-পরীক্ষা)।

৩. লিখিত পরীক্ষা থেকে বাছাইকৃত প্রার্থীদের ক্লাসে আমন্ত্রণ জানানো। এক্ষেত্রে নম্বর ১০০। ৫০ নম্বর দেবেন পরীক্ষকরা, ৫০ নম্বর শিক্ষার্থীরা। এক্ষেত্রে প্রার্থীর কাজ আছে, অতীতে গবেষণা করেছেন বা আগ্রহের বিষয়েই ক্লাসে আমন্ত্রণ জানানো যেতে পারে।

৪. সবশেষ ৫০ নম্বরের মৌখিক পরীক্ষা। ৫০ নম্বর থাকতে পারে প্রার্থীর প্রকাশিত গ্রন্থ, আর্টিকেল ও প্রবন্ধ বা অন্যান্য লেখালেখির ওপর।

বিজ্ঞাপন

প্রথম ধাপে বর্ণিত তিনটি প্রথম শ্রেণি প্রস্তাবের উদ্দেশ্য হলো, রেজাল্ট থাকলেই যে ভালো পড়াবেন এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফল ভালো শিক্ষকের মেধা শনাক্তের একমাত্র মাধ্যম হতে পারে না, হবে অন্যতম মাধ্যম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় মৌলিক গবেষণার স্থান। গবেষণায় ভালো এমন প্রার্থীর চারটি প্রথম শ্রেণি নাও থাকতে পারে। অসুস্থতা, পারিবারিক কারণসহ বিভিন্ন কারণে যে কোনো একটি পর্যায়ে একজন শিক্ষার্থী প্রথম শ্রেণি নাও পেতে পারেন। কিন্তু এজন্য তাকে বঞ্চিত না করে সুযোগ দিয়ে অন্য পর্যায়ের পরীক্ষাগুলোতে অংশ নেওয়ানোর মাধ্যমে তার মেধা যাচাই হতে পারে। ক্লাসে পাঠদান, মৌলিক গবেষণা এই দুইটি দক্ষতাই মূল দক্ষতা হওয়া উচিত একজন শিক্ষকের, কখনোই রেজাল্ট নয়। জন্মগত ও অভ্যাসগতভাবেই একজন মানুষ সব গুণপ্রাপ্ত হয় না। কথা বলায় জড়তা আছে বা প্রাণবন্ত নন এমন প্রার্থীরও যেমন শুধু গবেষণা বিবেচনায় শিক্ষকতায় আসা উচিত আবার ভালো ক্লাস নিতে পারেন এমন প্রার্থীর জন্যও সুযোগ রাখা দরকার। ভালো রেজাল্ট ভালো জানার, ভালো বলার, ভালো গবেষক হওয়ার নিশ্চয়তা দেয় না। তবুও রেজাল্টের একটা গুরুত্ব নিশ্চই আছে, যেহেতু এর জন্য শিক্ষার্থী অতীতে শ্রম দিয়েছেন এবং সাধনাও ছিল। সেই বিবেচনায় তিনটি প্রথম শ্রেণিই যোগ্যতার মাপকাঠি হওয়া উচিত। বিকল্পহীন ভাবে চারটি নয়।

সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে যোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ে কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা। যদি তা না থাকে তবে যত নিয়মে, যত উপায়েই পরীক্ষা নেওয়া হোক প্রকৃত মেধাবী নিয়োগ পাবে না। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার স্বার্থেই শিক্ষক নিয়োগে প্রকৃত মেধাবীদের স্থান করে দেওয়া উচিত। এ নিয়ে কোনো আপোষ হলে তা হবে বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার পথে সবচেয়ে বড় বাধা।
সারাবাংলা/ এসবি

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন