বিজ্ঞাপন

রানা প্লাজা ধসের ১১ বছর: নিষ্পত্তি হয়নি ২০ মামলার একটিও

April 24, 2024 | 8:41 am

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল। সাভার বাস স্ট্যান্ডসংলগ্ন ভবন রানা প্লাজা। বেশির ভাগ তলাতেই পোশাক কারখানা। সেই ভবন ধসে এক ভয়াবহ ট্র্যাজেডির শিকার হন পোশাক শ্রমিকরা। প্রাণ হারান এক হাজার ১৩৮ জন, পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় আরও এক হাজার ১৬৯ জনকে। এরপর পেরিয়ে গেছে এক দশকেরও বেশি সময়। কিন্তু এই ১১ বছরে এসেও রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়নি। শ্রমিকরা পাননি যথাযথ ক্ষতিপূরণ। বিচার শেষ না হওয়ায় মর্মান্তিক সে ঘটনায় দোষীরাও শাস্তি পাননি।

বিজ্ঞাপন

রানা প্লাজা ধসের পর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত, অবহেলাজনিত হত্যার বিচার, হতাহত শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ প্রদান ও দোষীদের শাস্তির মুখোমুখি করতে শ্রম আদালতসহ অন্যান্য আদালতে মোট ২০টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে শ্রম আদালতে করা হয় ১১টি মামলা, হাইকোর্টে করা হয় পাঁচটি রিট, থানা ও আদালতে দায়ের করা হয় চারটি মামলা। গত ১১ বছরে এসব মামলার কোনোটিরই চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়নি।

শ্রম আদালতের মামলা

শ্রম আদালতে দায়ের করা মামলাগুলোর বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতর। এর মধ্যে ২০১৩ সালের ২৫ এপ্রিল পাঁচটি মামলা করা হয়। বাকি ছয়টি মামলা করা হয় তিন দিন পর ২৮ এপ্রিল।

এসব মামলার আসামিদের মধ্যে রয়েছেন— বজলুস সামাদ, দেলোয়ার আহমেদ, আমিনুল ইসলাম, জাফর আহমেদ, ডেভিড মায়ার রিকো, এ বি এম সিদ্দিক, মনির হোসেন, সোহেল রানা, আনিসুর রহমান, জান্নাতুল ফেরদুস, মো. নজরুল ইসলাম, সুরাইয়া বেগম, এ আর আইয়ুব হোসেন, জান্নাতুল ফেরদৌসসহ অন্যরা।

বিজ্ঞাপন

এসব মামলার মধ্যে একটিতে আগামী ২৩ মে, ছয়টি মামলায় আগামী ১৫ জুলাই ও চারটি মামলায় আগামী ১১ আগস্ট তারিখে শুনানির দিন নির্ধারণ করা রয়েছে। এসব মামলা গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর্যায়ে রয়েছে।

মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবের ব্লাস্ট আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনালের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এম এ আউয়াল শ্রম আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে জানান। সব সাক্ষী না পেলে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষ্যের ভিত্তিতেও মামলা নিষ্পত্তি করা যায় বলে জানান তিনি।

হাইকোর্টে রিট

হাইকোর্টে বিচারাধীন পাঁচটি রিটের মধ্যে ২০১৩ সালের ব্লাস্ট এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে একটি রিট করা হয়। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট সরকারকে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল ও নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করতে বলেছিলেন।

বিজ্ঞাপন

রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় ২০১৩ সালের ৩০ মে হাইকোর্টের আরেক বেঞ্চ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেছিলেন। একই বছর আইনজীবী কামাল হোসেন মিয়াজী হাইকোর্টে একটি রিট করেন।

এরপর গত বছর এই তিনটি রিট একত্রে শুনানির জন্য আবেদন করলে বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। গত ২১ মার্চ এ বিষয়ে শুনানি নেন আদালত।

এ ছাড়া ২০১৩ সালে নাগরিক উদ্যোগ নামের একটি সংগঠন ও ড. রিদওয়ানুল হক নামের এক ব্যক্তি একটি রিট দায়ের করেন। ওই রিটের শুনানি নিয়ে আদালত জাতীয় পেশাগত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নীতিমালা বিষয়ক প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন একই বছরে আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দের দায়ের করা আরেক রিটও শুনানির অপেক্ষা রয়েছে।

রিটকারীদের অন্যতম আইনজীবী ব্যারিস্টার অনীক আর হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় হাইকোর্টে রিটগুলো বিচারাধীন। রিটগুলোর মধ্যে তিনটি বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন কোর্টে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। আমরা আশা করছি, আগমী দুই-তিন মাসের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারব।’

বিজ্ঞাপন

ইমারত বিধির মামলা স্থগিত

থানা ও আদালতে দায়ের করা চারটি ফৌজদারি মামলার মধ্যে ভবন নির্মাণে ত্রুটির অভিযোগে ২০১৩ সালে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আইনে রাজউক বাদী হয়ে সাভার থানায় মামলা দায়ের করেছিল।

মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানা, মো. রেফাতুল্লাহ, মোহাম্মদ আলী, উত্তম কুমার রায়, মাহবুবুর রহমান, রকিবুল হাসান রাসেল, মো. আব্দুল মোতালেব, মর্জিনা খানসহ অন্যান্যদের আসামি করা হয়।

এই মামলায় সোহেল রানাসহ ১৮ জনকে আসামি করে ২০১৫ সালের ১ জুন আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছিল সিআইডি। সে অভিযোগপত্র গ্রহণ করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম মোস্তাফিজুর রহমান ২০১৬ সালের ১৪ জুন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন তথা বিচার শুরুর আদেশ দেন।

বিচারিক আদালতের ওই আদেশ চ্যালেঞ্জ করে কয়েকজন আসামি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতে রিভিশন আবেদন করেন। এর মধ্যে নিউ ওয়েব বটমস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বজলুস সামাদ ও সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমানের রিভিশন আবেদন নামঞ্জুর হয়েছে। অন্যদিকে ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের রিভিশন মঞ্জুর করে তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে আসামি রেফায়েত উল্লাহ হাইকোর্টের দ্বারস্থ হলে তার ক্ষেত্রে মামলার কার্যক্রমের ওপর স্থগিতাদেশ দেন হাইকোর্ট। ওই সময় থেকেই এ মামলাটির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে আছে।

সাড়ে ৫ বছর পর সচল হত্যা মামলা, চলছে সাক্ষ্য

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) তথ্য অনুযায়ী, অন্য তিনটি মামলার মধ্যে ২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার থানায় তৎকালীন উপপরিদর্শক (এসআই) ওয়ালী আশরাফ হত্যাসহ কয়েকটি অভিযোগে একটি মামলা করেন।

মামলায় সোহেল রানা, বজলুস সামাদ, আমিনুল ইসলাম, মর্জিনা বেগম, আনিসুর রহমানসহ ৪১ জনকে আসামি করা হয়। ২০১৫ সালের ২৬ এপ্রিল সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। অভিযোগপত্রে সোহেল রানার বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়।

২০১৬ সালের ১৮ জুলাই ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এস এম কুদ্দুস জামান আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেন। কিন্তু এই অভিযোগ গঠনের পরপরই আট আসামি উচ্চ আদালতে গেলে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর স্থগিত থাকার পর ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি ফের মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে।

এদিকে ২০১৩ সালের ৬ মে একজন নিহত শ্রমিকদের স্ত্রী বাদী হয়ে দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় সোহেল রানাসহ একাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়। তবে মামলা দুটি হলেও তা একসঙ্গে চলমান।

রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ মামলাটিতে মোট ৫৯৬ জন সাক্ষী রয়েছেন। এর মধ্যে গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৮৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। আগামী ২৮ এপ্রিল ফের এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করা রয়েছে।

এই মামলার প্রধান আসামি রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাকে জামিন দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে আপিল বিভাগ সে আদেশ স্থগিত করলে সোহেল রানা আর জামিন পাননি। গত ১৫ জানুয়ারি আপিল বিভাগ এই মামলা দুটি ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন।

ক্ষতিপূরণের মামলা খারিজ

এ ছাড়া ২০১৩ সালের ৬ মে ক্ষতিপূরণ চেয়ে নিহত এক শ্রমিকের নির্ভরশীল (স্ত্রী ও সন্তান) আদালতে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ফ্যান্টম অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি), ঢাকা জেলা প্রশাসক, সাভার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিবাদী করা হয়। তবে ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা মামলাটি বাদীর অনুপস্থিতে ২০১৮ সালের ২৫ অক্টোবর একতরফাভাবে খারিজ হয়ে গেছে।

যা বলছে রাষ্ট্রপক্ষ

রানা প্লাজা ধসের দীর্ঘ ১১ বছর পেরিয়ে গেলেও মর্মান্তিক এ ঘটনায় কোনো আদালতেই বিচার শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর কারও জানা নেই। রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের ভাষ্য, সাক্ষ্যগ্রহণে দেরি হওয়ার কারণে আটকে আছে ‘অবহেলাজনিত হত্যা’র অভিযোগে করা মামলার বিচার।

রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর বিমল সমাদ্দার সারাবাংলাকে বলেন, ‘হত্যা মামলায় ৫৯৬ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত ৮৪ জনের সাক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সাক্ষীরা সময়মতো আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় বিচার শেষ হচ্ছে না।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে তিন ধরনের সাক্ষী আছে। তাদের মধ্যে আছেন ঘটনার ভুক্তভোগী তথা আহত শ্রমিক; রয়েছেন নিহতদের স্বজন, যারা লাশ উদ্ধার করেছিলেন; আরও রয়েছেন পুলিশ সদস্যরা যারা বিভিন্নভাবে মামলার আলামত জব্দ ও তদন্তে যুক্ত ছিলেন। সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করাই এই মামলার বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা।

অবহেলাজনিত হত্যার অভিযোগের এ মামলা (নিহত এক শ্রমিকের স্ত্রীর দায়ের করা মামলাসহ দুটি মামলা একত্রে) আপিল বিভাগ ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশনা দিয়েছেন। গত ১৫ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ আদেশ দেন। সে সময় পর্যন্ত ভবনটির মালিক সোহেল রানার জামিন স্থগিত থাকবে বলে আদেশে উল্লেখ করা হয়েছে।

বিমল সমাদ্দার বলেন, ‘নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির চেষ্টা করব। আদালতে সাক্ষী হাজির করার ক্ষেত্রে সবার সহযোগিতা চাই।’ এ বিষয়ে লিগ্যাল এইডকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

রানা প্লাজার মামলাগুলোর মধ্যে হত্যা মামলা ও ইমারত বিধির মামলা দুটিই প্রধান। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মামলা দুটি নিষ্পত্তি হলেই মূলত রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের ন্যায় বিচার পাওয়ার পথ সুগম হবে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিলের সেই ভয়াবহ রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় কয়েক দিনের প্রচেষ্টায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া ভবন থেকে উদ্ধার করা হয় সহস্রাধিক মরদেহ। পরে আরও কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। দুই হাজারেরও বেশি মানুষকে উদ্ধার করা হয় ধ্বংসস্তূপ থেকে।

রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার করা মরদেহের মধ্যে স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা সম্ভব হয় ৮৪৪টি। ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা রেখে বাকি মরদেহগুলো শনাক্ত না হওয়া অবস্থাতেই জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।

ভবন ধসের সেই ঘটনার পাঁচ দিন পর ২৯ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন ভবন মালিক সোহেল রানা। যশোরের বেনাপোল থেকে তাকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। এরপর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।

সারাবাংলা/কেআইএফ/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন