বিজ্ঞাপন

১ বছরেই স্তর নেমেছে ৪ ফুট, বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির জন্য হাহাকার

April 24, 2024 | 10:50 pm

মাহী ইলাহি, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রাজশাহী: বরেন্দ্র অঞ্চলে প্রতিবছর নামছে পানির স্তর। সেই সঙ্গে তাপমাত্রাও বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। উধাও হচ্ছে সবুজ প্রকৃতি ও জলাধার। বৃষ্টিপাতও কমে এসেছে। যেটুকু বৃষ্টি হচ্ছে, সেই পানিও কোনো কাজে লাগছে না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজশাহীর প্রকৃতিতে এখন মরুভূমির হাওয়া লেগেছে। ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও চরম আকার ধারণ করেছে। গবেষকদের তথ্য বলছে, গত এক বছরেই গোটা বরেন্দ্র এলাকায় গড়ে চার ফুট পর্যন্ত পানির স্তর নেমে গেছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের উত্তরাঞ্চলের মধ্যে পানি সংকট বেশি সবচেয়ে তানোর উপজেলায়। এই উপজেলা বরেন্দ্র অঞ্চলের মধ্যে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরেই রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোরের প্রায় সব উপজেলাতে এই খরা মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানি নিয়ে সংকট দেখা দিতে শুরু করেছে।

তানোর উপজেলার মুণ্ডুমালা পৌরসভার একটি বড় এলাকাজুড়েই পানির সংকট দীর্ঘদিনের। এখানে পানির স্তর নিচে নেমে গেছে। এখানকার পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের মাহালী সম্প্রদায়ের বসবাস। গৃহস্থালি কাজ ও খাওয়ার জন্য তাদের প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি বয়ে নিতে হয়।

একই চিত্র বাঘা উপজেলার শিমুলিয়া ও পাটিয়াকন্দি গ্রামেও। টিউবওয়েল ও ডিপ টিউবওয়েলে গত ২০ দিন থেকে পানিই উঠছে না। এসব গ্রামের মানুষকেও পানি সংগ্রহের জন্য দূর-দূরান্তে ছুটতে হচ্ছে। গ্রামগুলোর প্রতিটি পরিবারের দুঃখ ও কষ্টের নাম পানি। প্রকৃতির নিষ্ঠুরতার কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েছে।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয়রা বলছেন, এসব গ্রামের বিভিন্ন স্থানে গভীর নলকূপ রয়েছে। তবে সেগুলো থেকেও এখন আর পানি মিলছে না। অনেকেই পানি নিয়ে আসছেন দূর গ্রাম থেকে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে দূর গ্রাম থেকে পানি আনতে গিয়ে গর্ভপাত ঘটেছে পরিবারের অন্তঃসত্ত্বা নারীর। এ অবস্থায় অনেকে গ্রাম ছেড়ে শহরে পাড়ি জমিয়েছেন। পাঁচন্দর মাহালীপড়া গ্রামের অনেক আবাদি জমি সেচের পানির অভাবে অনাবাদি পড়ে রয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যথেচ্ছভাবে গভীর নলকূপ স্থাপন পানির স্তর নেমে যাওয়ার পেছনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছে। ফলে এখন ফসলি এলাকাতেও সহজে পানি মিলছে না। ছবি: সারাবাংলা

শুধু তানোর ও বাঘা নয়, রাজশাহী মহানগরীতেও এখন পানির সংকট প্রকট। নগরীর শিরোইল এলাকায় বেশ কয়েকটি টিউবওয়েল থেকে পানি মিলছে না কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে। এখানকার মঠপুকুর এলাকার আহলে হাদিস জামে মসজিদের টিউবওয়েল থেকেও পানি উঠছে। একই অবস্থা উপশহর এলাকাতেও।

বাঘা উপজেলা জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের সহকারী প্রকৌশলী মিঠন কুমার রবিদাস জানান, উপজেলায় দুই হাজার ৯৫১টি টিউবওয়েল বসানো আছে। এর মধ্যে ৫২৭টি বা প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ টিউবওয়েলেই বর্তমানে পানি উঠছে না। সেগুলো অকেজো হয়ে পড়ে আছে। অথচ সর্বশেষ শীত মৌসুমেও এই টিউবওয়েল থেকে পানি সংগ্রহ করেছিল এলাকাবাসী।

বিজ্ঞাপন

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুই-তিন দশক আগে রাজশাহীসহ শুষ্ক বরেন্দ্রভূমিতে ভূগর্ভের ৬০-৭০ ফুট নিচে পানির স্তর অবস্থান নিশ্চিত করা যেত। এসব এলাকায় এরকম গভীরতা থেকে নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানি তুলে জমিতে সেচ দেওয়া হতো। তবে গত তিন দশকে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি উদ্যোগেও নীতিমালা অমান্য করে বহুগুণ গভীর ও অগভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় গভীর নলকূপের ঘনত্ব বেড়েছে, বিপরীতে পানির স্তরও নিচে নেমে গেছে।

ওয়াটার রিসোর্স প্ল্যানিং অর্গানাইজেশনের (ওয়ারপো) পক্ষ থেকে ইনস্টিটিউট অব ওয়াটার মডেলিং (আইডব্লিউএম) পরিচালিত সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে এবং পানি সংকটাপন্ন অঞ্চলগুলোর পরিধি প্রসারিত হচ্ছে। বরেন্দ্র এলাকাতেও এমন এলাকা দিন দিন বাড়ছে।

রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলাজুড়ে ‘উঁচু বরেন্দ্র অঞ্চলে ভূপৃষ্ঠ ও ভূগর্ভস্থ পানি পরিস্থিতির হাইড্রোলজিক্যাল অনুসন্ধান ও মডেলিং’ শীর্ষক একটি গবেষণা চালানো হয় ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে। গবেষণার অধীনে তিন জেলার ২৫টি উপজেলায় চালানো হয় সমীক্ষা।

সংকটাপন্ন অনেক এলাকায় এমন অনেক আবাদি জমি রয়েছে, কেবল সেচের পানির অভাবে যেখানে আবাদ করা সম্ভব হচ্ছে না। ছবি: সারাবাংলা

ওই গবেষণার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে পরিস্থিতি আগের চেয়ে দিন দিন খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে পানি সংকটাপন্ন এলাকা। ১৯৮৫ থেকে ১৯৯০ সালে বরেন্দ্র অঞ্চলে গড় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ছিল ২৬ ফুট নিচে। সে সময় সর্বোচ্চ তানোরে পানির স্তর নেমেছিল ৬৮ ফুট গভীরে। খাবার পানি, সেচ, মাছ চাষের মতো বিভিন্ন কাজে অতিরিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি তোলায় ২০১০ সালে পানির ভূগর্ভস্থ পানির জন্য গড়ে ৫০ ফুট গভীরে নলকূপ বসাতে হতো।

বিজ্ঞাপন

গবেষণার তথ্য বলছে, ২০২১ সালে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরের গড় আরও নিচে নেমে দাঁড়ায় ৬০ ফুটে। একই বছর চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরের একটি স্থানে ভূপৃষ্ঠ থেকে মাটির নিচে পানি নেমে যায় ১৫৩ ফুট গভীরে। গত বছর এই পানির স্তর ১৬০ ফুট পর্যন্ত নিচে নেমেছিল।

এ অঞ্চলের ২১৪টি ইউনিয়নের মধ্যে ৮৭টি ইউনিয়ন অতি উচ্চ ও উচ্চ পানি সংকটাপন্ন এলাকা। পানির স্তর সবচেয়ে বেশি নেমেছে পোরশার ছয়টি ও নাচোলের চারটি ইউনিয়নে। অতি উচ্চ পানি সংকটে রয়েছে গোদাগাড়ি, তানোর, গোমস্তাপুর, নিয়ামতপুর ও সাপাহারসহ ৯ উপজেলার ৩৭টি ইউনিয়ন। গবেষণায় ৪০টি ইউনিয়নকে ‘উচ্চ পানি সংকটাপন্ন’ ও ৬৫টি ইউনিয়নকে ‘মাঝারি পানি সংকটাপন্ন’ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করেন গবেষকরা।

রাজশাহী জনস্বাস্থ্য ও প্রকৌশল অধিদফতরের তথ্য বলছে, রাজশাহীর ৯ উপজেলার পানির স্তর আরও নেমে যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নেমেছে তানোর ও গোদাগাড়ীতে। এই দুই উপজেলায় পানির স্তর নেমেছে ৯২ ফুট। এর পরের স্থানে আছে মোহনপুর ও পবা। এই দুই উপজেলাতে পানির স্তর নেমেছে ৮২ ফুট পর্যন্ত। বাগমারা উপজেলায় পানির স্তর নেমেছে ৬০ ফুট, বাঘা ও দুর্গাপুর উপজেলায় ৪৩ ফুট। পুঠিয়ায় নেমেছে ৩৮ ফুট ও চারঘাটে ৩৭ ফুট।

চলমান এই সংকটের কথা স্বীকার করে নিচ্ছেন বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আবদুর রশীদ। এর পেছনে গণহারে গভীর নলকূপ স্থাপনকে অন্যতম কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন তিনিও। আবদুর রশীদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুধু বিএমডিএ একা ভূগর্ভস্থ পানি তুলছে না, ব্যক্তি পর্যায়েও ডিপ ও সেমি-ডিপ টিউবওয়েলের মাধ্যমে পানি তোলা হচ্ছে। এতে পানির স্তর রীতিমতো সংকটাপন্ন অবস্থায় পৌঁছে গেছে। এ পরিস্থিতিতে বিএমডিএ নতুন করে আর গভীর নলকূপ না বসানোর নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে।’

চলমান পরিস্থিতিতে ভূ-উপরিস্থ ও নদীর পানি এবং বৃষ্টির পানিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। ছবি: সারাবাংলা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান সজল এই অঞ্চলের পানির ভবিষ্যৎ ও ব্যবস্থাপনা নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে গবেষণা করে আসছেন। সারাবাংলাকে তিনি বলেন, ‘গত বছর বৃষ্টিপাত এমনিতেই কম হয়েছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর বাড়েনি। গত বছরের সংকটই কাটেনি। গত বছরও বলা হয়েছিল, আগামী বছর কৃষকরা পানি পাবে না। এখন প্রলম্বিত তাপপ্রবাহ চলছে। এ বছর তাই প্রচণ্ড খরা হবে।’

রাবির এই গবেষক আরও বলেন, ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার বা ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নামছে দ্বিগুণ হারে। খরা মৌসুমে গ্রাউন্ড ওয়াটার লেভেলে পানিই থাকছে না। মরুভূমির দেশগুলোতে বৃষ্টিপাত ও বন্যা হলেও দেশের অতি বৃষ্টিপ্রবণ এলাকাগুলোতে বৃষ্টির দেখা নেই। এ বছর ভূগর্ভস্থ পানির স্তর আরও চার ফুট পর্যন্ত নেমে গেছে। বিএমডিএ যে পরিমাণ গভীর নলকূপ স্থাপন করেছে, তার দ্বিগুণ গভীর নলকূপ এই অঞ্চলে স্থাপন করা হয়েছে ব্যক্তি উদ্যোগে। এভাবে চলতে থাকলে আগামী ২৫ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে এই অঞ্চলে মাটির নিচে পানি থাকবে না।’

এ পরিস্থিতিতে সমাধান কী হতে পারে— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘গ্রাউন্ড ওয়াটার রিচার্জ করা ও সারফেস ওয়াটারের ব্যবহার নিশ্চিত করা ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো সম্ভাবনা নেই। বৃষ্টির পানির অপচয় না করে এই পানিকে কার্যকরভাবে মাটির নিচে পৌঁছে দিতে হবে। আর নদীনালার পানির ব্যবহার বাড়াতে হবে। সেচে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে হবে। এ জন্য নদীনালা, খালবিল খনন করে পানি ধারণক্ষমতা বাড়াতে হবে।’

বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী আবদুর রশীদ অবশ্য জানালেন, তারাও এসব উদ্যোগের দিকেই ঝুঁকছেন। তিনি বলেন, ‘পরিস্থিতি মোকাবিলায় ভূ-উপরিস্থ পানির ব্যবহার বাড়াতে পদ্মা ও মহানন্দার পানি এনে সেচের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। জলাধার খনন, সংস্কার, পানির অপচয় রোধসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। খাল খনন করে ভূ-উপরিস্থ পানির আধারও তৈরি করা হচ্ছে।’

সারাবাংলা/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন