বিজ্ঞাপন

মাকে রেখে কেন চলে গেলি রে বাবা!

May 10, 2024 | 5:53 pm

রিপন আনসারী, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

মানিকগঞ্জ: মাকে রেখে কেন চলে গেলি রে বাবা! মায়ের কবরে তুই মাটি দিবি না? আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো, কে বলবে, আম্মু তুমি খাইছো? এ আর্তনাদ সন্তানহারা এক মায়ের। চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় মানিকগঞ্জের ছেলে নিহত পাইলট আসিম জাওয়াদ রিফাতের মা নিলুফা আক্তার একমাত্র সন্তানের মৃত্যুতে এভাবে আর্তনাদ করে যাচ্ছেন।

বিজ্ঞাপন

বৃহস্পতিবার দুর্ঘটনায় ছেলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে একাধারে তার আর্তনাদ থামছে না। ছেলের শোকে দুদিন ধরে মুখে খাবার নিচ্ছেন না তিনি।

স্বজনরা কেউ তার মুখে খাবার তুলে দিতে গেলেন তাদেরকে বলছেন, ছুটিতে বাড়িতে এলে আমার বাবা আমাকে ছাড়া খেতে বসত না। একা একা ছাদে দিয়ে যেতে দিত না, সবসময় আমার খেয়াল রাখত। বলতো আম্মু তুমি ভাত খাও, আম্মু নাস্তা খাও। আমি না খেলে আমার বাবা খেতো না। এখন কে বলবে আম্মু তুমি খাইছো?

ছেলের উদ্দেশ্যে তিনি বিলাপ করে বলছেন, তুই না আসলে আমি খাবো না বাবা, বলেই মুর্ছা যাচ্ছেন মা নিলুফা আক্তার।

বিজ্ঞাপন

আবার কিছু সময় পর সংজ্ঞা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠেন, ‘আমার বাবা কোথায়? তোমরা আমার বাবাকে এনে দাও। আমি আমার বাবাকে ছাড়া বাঁচব না। আমাকে রেখে কেন তুই চলে গেলি রে বাবা!’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত জাওয়াদের মা অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক বলেন, ‘আমার অসীমের কত স্বপ্ন। কত পুরস্কার পেয়েছে। সে তো কোনদিন কারো ক্ষতি করেনি। তাহলে এই অবস্থা হলো কেন?’

এদিকে বিমান দুর্ঘটনায় আসিম জাওয়াদ রিফাতের নিহতের খবর পাওয়ার পরপরই বৃহস্পতিবার দুপুরে তার চিকিৎসক বাবা আমান উল্লাহ চট্টগ্রাম চলে যান। তাছাড়া জাওয়াদ স্ত্রী ও ছোট ছোট দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে নিজের কর্মস্থল চট্টগ্রামে বসবাস করতেন। গ্রামের বাড়ি সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর হলেও মূলত পরিবার নিয়ে মানিকগঞ্জ শহরের বসবাস করছেন।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার বেলা বারোটার দিকে রিফাতের মরদেহ আনা হয় মানিকগঞ্জে।

নিহত আসিম জাওয়াদের মামা বাংলাদেশ বেতারের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি সুরুজ খান জানান, দুর্ঘটনার পরপরই তাদের কাছে খবর আসে। এরপর থেকেই জাওয়াদের মা ও পরিবারের সদস্যদের কান্না আর আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে । কে কাকে সান্ত্বনা দেবে সে ভাষাও হারিয়ে ফেলেন সবাই। নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে পুরো পরিবারটি।

সুরুজ খান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই পাইলট হওয়ার স্বপ্ন ছিল জাওয়াদের। সাভার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক অ্যান্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর প্রশিক্ষণ শেষে বিমান বাহিনীতে যোগদান করেন। প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন মেধাবী জাওয়াদ। পেশাগত জীবনে পেয়েছেন সোর্ড অব অনারসহ বিভিন্ন সম্মাননা।’

বিজ্ঞাপন

জাওয়াদের খালাতো ভাই শিমুল বলেন, ‘জাওয়াদ শুধু আমাদের পরিবার নয় বাংলাদেশের একজন চৌকস অফিসার ছিলেন। সবকিছুতেই সে ছিল পারদর্শী। ওর মৃত্যুতে আমরা পুরো পরিবার শোকাহত।’

নিয়তির খালু দেওয়ান লুৎফর রহমান আবু বলেন, ‘আসিমের মতো ছেলে লাখে একজনও পাওয়া যাবে না। কোনো জায়গায় সে সেকেন্ড হয়নি। সে ঢাকা মেডিকেলে চান্স পেয়েছিল বুয়েটে চান্স পেয়েছিল। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার।’

নানার কবরে শায়িত হলেন আসিম

শুক্রবার বেলা বারোটার দিকে বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে আসিম জাওয়াদের মরদেহ নামানো হয় মানিকগঞ্জ শহীদ মিরাজ-তপন স্টেডিয়ামে। এর আগে সকাল থেকে পরিবারের সদস্য ও এলাকার বিপুল সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ স্টেডিয়ামে অপেক্ষা করেন আসিমের মরাদেহ দেখার জন্য। সাড়ে এগারোটার দিকে নিহতের মা নিলুফা আক্তারকে তার স্বজনেরা স্টেডিয়ামে আনার পরপরই সেখানে আরেক হৃদয়বিদার পরিস্থিতি তৈরি হয়। কান্না আর আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে স্টেডিয়ামের পরিবেশ।

বেলা ১১টা ৫০ মিনিটে বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টার অবতরণ করে স্টেডিয়ামে। মানিকগঞ্জ শহরের সবার প্রিয় আসিমের মরদেহ দেখার জন্য তাৎক্ষণিক বিমানটিকে ঘিরে ফেলে উৎসব মানুষ। মরদের সঙ্গে ছিলেন নিহতে পাইলটের বাবা চিকিৎসক আমান উল্লাহ, স্ত্রী অন্তরা, শিশু ছেলে মেয়ে এবং শশুর।

কিছু সময় পর জাতীয় পতাকা মোড়ানো রিফাতের নিথর দেহের কফিন বিমান বাহিনীর সদস্যরা কাঁধে করে লাশবাহী গাড়ির ভেতর ওঠায়।

ছেলের মরদেহ প্রথমে তার মাকে দেখানো হয়। এ সময় মায়ের আত্মচিৎকারের ভারী হয়ে ওঠে মানিকগঞ্জ শহীদ মিরাজ তপন স্টেডিয়ামটি। পরিবারের প্রত্যেকটা সদস্যরা এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন।

এ সময় নিহত পাইলটের অবুঝ দুই শিশু ও স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে বিলাপ করতে থাকেন বা নিলুফা আক্তার।

জুমার নামাজ শেষে বেলা দুইটার দিকে শহীদ মিরাজ তপন স্টেডিয়ামে নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শহরের সেওতা কবরস্থানে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সেখানে তার নানা মরহুম আব্দুর রব খানের কবরেই চিরনিদ্রায় শায়িত হন বিমান বাহিনীর চৌকস পাইলট আসিম। বিমান বাহিনী, সেনাবাহিনী ও নৌ বাহিনীর সদস্যরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

আসিম জাওয়াদ ২০১১ সালে চাকরিতে যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি সাটুরিয়া উপজেলার গোপালপুর গ্রামে।

আরও পড়ুন
বিধ্বস্ত প্রশিক্ষণ বিমানের এক পাইলটের মৃত্যু
নানার কবরে শায়িত হলেন পাইলট আসিম জাওয়াদ

সারাবাংলা/একে

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন