বিজ্ঞাপন

বেতন বকেয়ায় ‘পাংচার’ বিআরটিসি

July 26, 2018 | 8:24 am

।। মেসবাহ শিমুল, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: অনিয়ম-দুর্নীতি আর অব্যবস্থাপনায় ডুবতে বসেছে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিসি)। ব্যক্তি মালিকানাধীন গণপরিবহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে দিন দিন কমছে বাসের সংখ্যা। অন্যদিকে বছর বছর লোকবল বাড়ানোয় বাড়ছে ব্যয়। চালক-শ্রমিকদের বেতনও বকেয়া পড়ে রয়েছে মাসের পর মাস। সব মিলিয়ে রাষ্ট্রীয় পরিবহন সেবা বিশাল এ খাতের সামনে এখন ঘোর অন্ধকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিআরটিসি’র নিজের চাকাই এখন ‘পাংচার’ হয়ে গেছে।

বিআরটিসি সূত্র জানায়, বর্তমানে সারাদেশে বিআরটিসির মোট ২২টি ডিপো আছে। এর মধ্যে ঢাকায় ডিপো রয়েছে ছয়টি। এসব ডিপোয় কর্মরত প্রায় তিন হাজার চালক, টেকনিশিয়ান, অফিস সহকারী এবং নিরাপত্তারক্ষী। সরকারি বেতন স্কেলে তারা তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, যাদের সাত থেকে আট মাসের বেতন বকেয়া রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ইনক্রিমেন্টও।

বুধবার (২৫ জুলাই) সরেজমিনে রাজধানীর খিলক্ষেতের জোয়ার সাহারায় বিআরটিসি ডিপোতে গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে বকেয়া বেতন-ভাতার দাবিতে ধর্মঘট পালন করছেন কয়েকশ চালক-কর্মচারী। ডিপো কম্পাউন্ডে সারিবদ্ধভাবে গাড়িগুলো পড়ে রয়েছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষুব্ধ এসব শ্রমিক-কর্মচারী দফায় দফায় স্লোগান দিচ্ছেন। বকেয়া বেতানের দাবি জানাচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

জোয়ার সাহারা ডিপোর চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ ডিপোর ১৫৩ জন চালক গত আট মাস ধরে বেতন পান না। এছাড়া ১৬১ জন শ্রমিকের পাওনা বাকি সাত মাসের। এর মধ্যে ঈদুল ফিতরের সময়ে কেবল বোনাস পেয়েছেন তারা। প্রায় একই অবস্থা রাজধানীর অন্য বিআরটিসি ডিপোগুলোতেও।

জানা গেছে, বিআরটিসির গাবতলী ডিপোতে ছয় মাস, মোহাম্মদপুর ডিপোতে পাঁচ মাস এবং মতিঝিল ডিপোতে এক মাসের বেতন বকেয়া আছে। তবে রাজধানীর  তেজগাঁও ট্রাক ডিপো, মিরপুর দ্বিতল বাস ডিপো এবং কল্যাণপুর ডিপোতে বেতন-ভাতা নিয়মিত রয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ ছাড়া চট্টগ্রাম ডিপোতে বেতন বকেয়া ৯ মাস, গাজীপুরের তিনটিতে তিন মাস, নরসিংদী ডিপোতে আট মাস, নারায়ণগঞ্জ ডিপোতে ৯ মাস, রংপুর ডিপোতে ১৩ মাস, কুমিল্লা ডিপোতে চার মাস, বগুড়ায় চার মাস, সিলেটে তিন মাস, পাবনা ডিপোতে সাত মাস, নোয়াখালীর সোনাপুর ডিপোতে তিন মাস, খুলনায় তিন মাস এবং দিনাজপুর ডিপোতে বিআরটিসি কর্মীরা গত ছয় মাস ধরে কোনো বেতন-ভাতা  পাচ্ছেন না।

বিআরটিসির দেওয়া তথ্য মতে, সংস্থাটিতে বর্তমানে ৯৩৭টি একতলা ও দ্বিতল বাস রয়েছে। এগুলো দেশের মোট ১৯৮টি রুটে চলাচল করছে। এছাড়া ঢাকার বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস ভাড়া দেওয়া রয়েছে। এছাড়া এ সংস্থার মালিকানায় ১১০টি ট্রাকও রয়েছে।

জোয়ার সাহারা ডিপোতে কথা হয় চালক মো. সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। তিনি সারাবাংলা’কে বলেন, ‘গত আট মাস ধরে বেতন বকেয়া। সংসার চলছে না। আমার মেয়ে অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু টাকার অভাবে তাকে এখন ময়মনসিংহের গ্রামের বাড়িতে রেখে এসেছি। সেখানের একটা স্কুলে ভর্তি করেছি তাকে। আমার বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় মেয়েকে ঢাকায় রেখে পড়াতে পারছি না।’

মো. শাকিব বিশ্বাস নামের আরেক চালক জানান, আমরা যে কত কষ্টে আছি তা বলে বোঝানো যাবে না। বাসায় যাই না ভয়ে, বাড়িওয়ালা যদি দেখে ফেলে! ভাড়া তো দিতে পারি না। ঘরে চুলা জ্বলে না।

বিজ্ঞাপন

সোহরাব হোসেন ও শাকিব বিশ্বাসের মতো বিআরটিসির চালক ও শ্রমিকরা বলছেন, বিআরটিসি নিজেই এখন ‘পাংচার’ হয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। এখনই বিশেষ কোনো ব্যবস্থা না নিতে পারলে সরকারি এই সংস্থাটিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।

জোয়ার সাহারা ডিপোতে ধর্মঘটের খবরে সেখানে বিআরটিসির কর্মকর্তারা ছুটে গিয়ে শ্রমিকদের একমাসের পাওনা পরিশোধের আশ্বাস দেন। তবে সেই আশ্বাসে ধর্মঘট তোলেননি চালক-শ্রমিকরা। বকেয়ার পুরো টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত তারা ধর্মঘট চালিয়ে যাবেন বলে জানান। এর জন্য চাকরিচ্যুত হতে হলে সেই ঝুঁকি মেনে নিয়েই আন্দোলন করছেন বলে জানান সারাবাংলা’কে।

এদিকে, ২০১৩ সাল থেকে বিআরটিসি জোয়ার সাহারা ডিপোতে নিয়মিত লোকসান হয়ে আসছে বলে জানালেন এখানকার ম্যানেজার মো. মনিরুজ্জামান। তিনি বলেন, বেতন বকেয়ার জন্য অনেকগুলো সমস্যাই দায়ী। কেবল সিটি সার্ভিস দিয়ে সব কর্মচারীর বেতন-ভাতার সংকুলান করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।

গত দেড় বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ঘেঁটে দেখা যায়, ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে এ ডিপোতে বাস চলেছে ৯৬টি, লোকসান ছিল ৪ লাখ  ৯৭ হাজার ৪২৯ টাকা। ফেব্রুয়ারিতে ৯৭টি বাসে লোকসান ছিল ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬৯০ টাকা, মার্চে ৯৭টি বাসে লোকসান ৪২ হাজার ৮২৮ টাকা, এপ্রিলে ৯২টি বাসে লোকসান ৬ লাখ ৪২ হাজার ৪৮৩ টাকা, মে মাসে ৯২টি বাসে লোকসান ৩ লাখ ৮১ হাজার ৯২৬ টাকা, জুনে ৯০ বাসে ৩১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬৪ টাকা, জুলাইয়ে ৯০ বাসে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫৯ টাকা, আগস্টে ৯৬ বাসে ১৭ লাখ ৭০ হাজার ১৩৩ টাকা, সেপ্টেম্বরে ৯০ বাসে ১৪ লাখ ৪৪ হাজার ১৬৩ টাকা, অক্টোবরে ৯২ বাসে ৭ লাখ ৪৫ হাজার ২৩৩ টাকা, নভেম্বরে ৯৫টি বাসে ৬ লাখ ৭৩ হাজার ৪৬ টাকা ও ডিসেম্বর মাসে ৯১টি বাসে লোকসান ছিল ১৭ লাখ ৭ হাজার ৭৬৮টাকা।

একই চিত্র দেখা গেছে ২০১৮ সালেও। এ বছরের জানুয়ারিতে ৮১টি বাসে লোকসান ছিল ১২ লাখ ১৯ হাজার ২৪৮ টাকা, ফেব্রুয়ারিতে ৮৫টি বাসে ১২ লাখ ৬৯ হাজার ৩০ টাকা, মার্চে ৮৪টি বাসে ৫ লাখ ৫০ হাজার ৫৭২ টাকা, এপ্রিলে ৮০টি বাসে ১৯ লাখ ৬১ হাজার ৭০১ টাকা, মে মাসে ৮৮ বাসে ২৫ লাখ ৩০ হাজার ৫৮২ টাকা এবং জুনে ৭৬টি বাসের লোকসান ছিল ৪৯ লাখ ৩২ হাজার ৭৯৪ টাকা।

এ ডিপোর ম্যানেজার মনিরুজ্জামান সারাবাংলা’কে বললেন, ‘রাজধানীর আব্দুল্লাপুর থেকে মতিঝিলে যে গাড়িটি আগে পাঁচটি ট্রিপ দিত, এখন যানজটের কারণে ট্রিপ নেমে এসেছে একটি থেকে তিনটিতে। এতে খরচ সমান হলেও আয় বাড়ছে না। ফলে লোকসান বাড়ছে।’ তার মতে, কেবল রাজধানীর মধ্যে গাড়ি চালিয়ে কোনোভাবেই ডিপোর লোকসান সামাল দেওয়া সম্ভব না।

রাষ্ট্রীয় সেবা সংস্থা হিসেবে বিআরটিসিতে আলাদা বরাদ্দের যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি এর পেছনে সরকারে ভর্তুকি বাড়ানো কথা বলেন। সেইসঙ্গে জোর দেন নতুন গাড়ি সংযোজনের ওপরও।

এদিকে, ডিপোতে শ্রমিকদের বেতন বকেয়ার বিষয়টি স্বীকার করে বিআরটিসির চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া জানিয়েছেন, জোয়ার সাহারায় বকেয়ার পরিমাণটা একটু বেশি। অন্যগুলোর বকেয়া তেমন নয়। তার মতে, বিআরটিসির ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় বকেয়া বেড়েছে।

২০১৫ সালে নতুন বেতন স্কেল অনুযায়ী, বর্তমানে মাসে ৭ কোটি ২০ লাখ টাকা বেতন দিতে হয় জানিয়ে চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভুঁইয়া সারাবাংলা’কে বলেন, কোনোভাবেই নিজস্ব আয় দ্বারা এ পরিমাণ বেতন-ভাতা পরিশোধ সম্ভব নয়।

চালক-শ্রমিকরা বলছেন, রাস্তায় বের হলেই গাড়িতে আয় আসছে। এখন আগের চেয়ে ব্রেকডাউনও কমেছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন গাড়ির চেয়ে কম ভাড়া এবং কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে লোকসান হচ্ছে।

কর্মচারীদের বক্তব্যের সত্যতা মিললো খিলক্ষেত থেকে মতিঝিলগামী গাজীপুর ডিপোর একটি দ্বিতল বাসে উঠে। দুপুর দেড়টায় বাসে উঠে হাইকোর্ট মোড় পর্যন্ত আসতে বাসটি সময় নেয় ২ ঘণ্টা ১৩ মিনিট। যাত্রাপথে বাসটির গতি ছিল অন্য গণপরিবহনের চেয়ে অনেক কম। রাস্তায় নির্ধারিত স্টপেজ ছাড়াও যাত্রী তুলতে দেখা যায় ওই বাসটিকে। বাসটির কন্ডাক্টর ইয়াসিন জানান, তাদেরও বেতন-ভাতা বকেয়া রয়েছে।

এ গাড়িতেই গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে সকাল ৯টায় ওঠেন সোহেল নামের একজন যাত্রী। দুপুর সাড়ে ৩টার সময় তিনি ফার্মগেটে নেমে যান। এ সময় ওই বাসের যাত্রীদের বাসের সেবা নিয়ে তুমুলভাবে অসন্তোষ প্রকাশ করতে দেখা গেছে।

সারাবাংলা/এমএস/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন