বিজ্ঞাপন

দেরিতে চিকিৎসা ডেঙ্গু রোগে মৃত্যুর কারণ, অক্টোবরে কমবে প্রকোপ

September 30, 2018 | 8:14 am

।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: এ বছরের ডেঙ্গু কেবল রোগিদেরকেই ভোগাচ্ছে না, চিন্তিত করেছে চিকিৎসকদেরকেও। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু তার স্বাভাবিক ধরন বদলেছে যার কারণে রোগীরা সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসার আওতায় আসেনি। তাতে সময়ক্ষেপণ হয়েছে, পরিণতিতে মৃত্যু হয়েছে বেশ কয়েকজনের।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টারের ইনচার্জ ডা. আয়েশা আখতার সারাবাংলাকে বলেন, আমরা আশা করছি অক্টোবর মাস থেকেই  ডেঙ্গুর প্রকোপ কমবে। গত বছরে ডেঙ্গুর প্রকোপটা না বাড়লেও চলতি বছরে প্রকোপ বেড়েছিল। তবে  তাকেও আমরা খুব বেশি প্রকোপ বলছি না  বলেন ডা. আয়েশা আখতার।

শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. কিংকর ঘোষ জানান, সাধারণত জুলাই-আগস্ট এবং সেপ্টেম্বর এ তিন মাস-ডেঙ্গু রোগের ঝুঁকি থাকে। গত বছরে চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি ছিল কিন্তু এ বছরে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব খুব বেশি। তিনি জানান, তার হাসপাতালে আসা অনেক রোগীই সঠিক সময়ে চিকিৎসকের কাছে আসেনি, সঠিক সময়ে চিকিৎসা পাওয়ার আগেই অনেকেই মারা গিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে গত ২ মাসে ৩৬৫ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে ৩১৯ জন চিকিৎসা নিয়ে চলে যান। তবে শিশুসহ মারা যায় ৩ জন। বর্তমানে ৪৬ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, বাংলাদেশসহ ডেঙ্গু প্রকোপ অঞ্চলে ভারত, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যাণ্ড, পূর্ব তিমুর ও উত্তর কোরিয়া রয়েছে। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বের মোট জনসংখ্যার এক-চতুর্থাংশ মানুষ এই অঞ্চলে বসবাস করে। দ্রুত নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এই অঞ্চলে এই দু’টি রোগ ছাড়াও কীটবাহিত অন্যান্য রোগের ঝুঁকিও বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশনস সেন্টারের হিসাবমতে ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ৪৪২ জন, বর্তমানে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ২৩৬ জন এবং গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৫০ জন।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন: দুই মাসে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি ৩৬৫ ডেঙ্গু রোগী, ৩ জনের মৃত্যু

স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায় ২০০০ সালে। সে বছরে রেকর্ড সংখ্যক ৯৩ জন রোগী মারা যান, রোগী ছিলেন ৫ হাজার ৫৫১ জন। ২০০১ সালে মারা যান ৪৪ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে মারা যান ৫৮ জন, রোগী ছিলেন ৬ হাজার ২৩২ জন, ২০০৩ সালে মারা যান ১০ জন, রোগী ছিলেন ৪৮৬ জন, ২০০৪ সালে মারা যান ১৩ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ৪৩৪ জন, ২০০৫ সালে  মারা যান ৪ জন, রোগী ছিলেন ১ হাজার ৪৮ জন, ২০০৬ সালে মারা যান ১১ জন, রোগী ছিলেন দুই হাজার ২শ জন, ২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেউ মারা না গেলেও রোগী সংখ্যা ছিলেন যথাক্রমে ৪৬৬ জন, এক হাজার ১৫৩ জন, ৪৭৪ জন এবং ৪০৯ জন। তবে তার পরের বছর থেকেই আবার রোগীর মৃত্যু শুরু হয়।

২০১১ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৩৫৯ জন, ২০১২ সালে মারা যান একজন, রোগী ছিলেন ৬৭১ জন, ২০১৩ সালে মারা যান ২ জন, রোগী ছিলেন এক হাজার ৭৪৯ জন, আবার ২০১৪ সালে কেউ মারা না গেলেও রোগী ছিলেন ৩৭৫ জন। ২০১৫ সালে মারা যান ৬ জন, রোগী ছিলেন ৩ হাজার ১৬২ জন, ২০১৬ সালে মারা যান ১৪ জন, রোগী ছিলেন ছয় হাজার ৬০ জন এবং গত বছরে মারা যান ৮ জন এবং রোগী সংখ্যা ছিলেন দুই হাজার ৭৬৯ জন।

চলতি বছরের গত ৯ জুন প্রথম ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। ৩৪ বছরের ফারজানা আক্তার নামের ওই রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন ৭ জুন। সে মাসেই ৩১ বছরের রোজলিন বৈদ্য এবং ২৬ বছরের সেঁজুতি নামে আরও দুজন মারা যান।

বিজ্ঞাপন

পরের মাসে এক বছর সাত মাসের আরইয়ান, আট বছরের হিমু, নয় বছরের তাহমিদ এবং বারডেম হাসপাতালে কর্তব্যরত ২৭ বছরের ডা, ফয়সাল বিল্লাহ মারা যান। এর পরের মাস আগস্টে ৫৫ বছরের মৃদুলা বেগম, দুই বছরের শ্রেষ্ঠা ঘোষ, পাঁচ বছরের আমিনা, ১২ বছরের তাহজীব খান, ৪৯ বছরের মাকসুদা বেগম, পাঁচ বছরের আরাফাত ইসলাম মারা যায়। চলতি মাসে অর্থাৎ সেপ্টেম্বরে মারা যায় ৪০ বছরের আর্জিনা বেগম, দুই বছরের সাফায়াত এবং তিন বছর বয়সী সুমাইয়া। চলতি বছরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মোট মারা যায় ১৬ জন-তবে এর মধ্যে নারী এবং শিশুর সংখ্যাই বেশি।

ডেঙ্গু

হাসপাতাল ঘুরেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত শিশুদের সংখ্যাই বেশি পাওয়া গেছে। ঢাকা শিশু হাসপাতালের তথ্যানুযায়ী, এ হাসপাতালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা গতবারের চেয়ে এবার দ্বিগুণ। গতবছর মে থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী ছিল ১১৫ জন আর একজনও মারা যায়নি। অথচ চলতি বছরের জুলাই থেকে ২৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ২৮৫, মারাও গিয়েছে তিন শিশু।

হাসপাতাল থেকে জানা যায়, এ বছরে জুলাই মাসে ২৮ জন, আগস্টে ৭০ জন আর চলতি মাসের গত ২৬ তারিখ পর্যন্ত ১৮৭ জন অর্থ্যাৎ মোট ২৮৫ জন আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে এসেছে, কেউ চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরলেও এখনও অনেকেই চিকিৎসাধীন। তবে এর মধ্যে মারা গিয়েছে ৩ জন। শিশু হাসপাতালের চিকিৎসকরা বলছেন, আক্রান্ত শিশুদের মধ্যে মিরপুর অঞ্চল থেকে আসা রোগীই ৬৫ শতাংশ।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু ও চিগুনগুনিয়া রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. কিংকর ঘোষ সারাবাংলাকে বলেন, এই হাসপাতালে গত ১ জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত ২৮৫ জন ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে এবং এখনও চিকিৎসাধীন রয়েছে।

অপরদিকে, রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর জ্যেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর জানালেন, কেবলমাত্র বৃষ্টির প্রকোপ কমলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ কমতে পারে।

আরও পড়ুন: ৩ মাসে শিশু হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ২৮৫, মৃতের সংখ্যা ৩

জুন থেকে ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম উল্লেখ করে ডা. এ এস এম আলমগীর বলেন, থেমে থেমে হতে থাকা বৃষ্টিটা কমলেও ডেঙ্গু কমবে না সেভাবে। ডিসেম্বর পর্যন্ত থাকবে তবে এভাবে চলতে থাকা প্রকোপ কমবে। তবে এ জন্য সবাইকে সচেতন এবং সাবধান হবার পরামর্শ দেন তিনি।

ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘কীটপতঙ্গবাহিত রোগের ঝুঁকি বেড়েছে, এর প্রমাণ চলতি বছরগুলোতে ডেঙ্গু-চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ। জলবায়ু পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে এ প্রকোপ বেড়ে গিয়েছে।’

‘তবে এর প্রতিকারের জন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে, সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে এ সর্ম্পকে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা এবং জনসচেতনামূলক কাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিজীবী, সমাজসেবী, সামাজিক প্রতিষ্ঠান তাদেরও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে অংশগ্রহণ করতে হবে’, বলেন ডা. এ এস এম আলমগীর।

সারাবাংলা/জেএ/একে/জেডএফ

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন