বিজ্ঞাপন

অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে ছিনতাই

January 5, 2018 | 9:40 am

উজ্জল জিসান, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট

বিজ্ঞাপন

ঢাকা: মঙ্গলবার বেলা ১২টা। মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ ছুটি হয়েছে। গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী তানফা ফেরদৌসি। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা কলেজ বাসে উঠছে সবাই। বাসে ওঠার জন্য লাইনেই ছিলেন তানফা। হাতে ছিল দামি মোবাইল ফোন। হঠাৎ করে ৩/৪ জন যুবক এসে ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিলেন এবং মোবাইল ফোনটি ছিনিয়ে নিয়ে সবার সামনে দিয়েই চলে যায়।

বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আইয়ের সিনিয়র রিপোর্টার মোরসালিন বাবলার মেয়ে তানফা ফেরদৌসি। বাসায় গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মঙ্গলবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সারাবাংলার কাছে এভাবেই সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করছিলেন তানফার বাবা সাংবাদিক মোরসালিন বাবলা।

তিনি বলেন, গত এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পায় তানফা। পরীক্ষার আগে তার শর্ত ছিল গোল্ডেন এ প্লাস পেলে একটা দামি মোবাইল ফোন কিনে দিতে হবে। তার কথা রাখতেই ৪০ হাজার টাকা দিয়ে একটি মোবাইল ফোন কিনে দেই। তার প্রথম ফোন হওয়ায় অনেক স্মৃতি জড়িত রয়েছে। অনেক ছবি ও গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্টস থাকায় সে ভেঙ্গে পড়েছে। এজন্য পুলিশের কাছে অভিযোগ নিয়ে এসেছি।

বিজ্ঞাপন

গত সোমবার সকালে দয়াগঞ্জে রেললাইনের পাশে গৃহবধু আকলিমার সঙ্গে ছিনতাইকারীদের অপ্রতিরোধ্য আচরণে কোলে থাকা ছয় মাসের শিশু আরাফাত পাকা রাস্তায় পড়ে মারা যায়। গণমাধ্যমে এ হৃদয়বিদারক ঘটনা যারাই দেখেছেন তাদের প্রত্যেকই শোকাহত হয়েছেন। এ ঘটনায় পুলিশের এএসআই বদরুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হলেও ছিনতাইকারীদের কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।

৮ ডিসেম্বর। বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন ইকবাল মাহমুদ। গ্রামের বাড়ি বগুড়া থেকে ফিরে ভোরে কল্যাণপুরে নামেন। এরপর রিকশাযোগে ফিরছিলেন তালতলার বাসায়। মোটরসাইকেলে আসা ছিনতাইকারীরা ছোঁ মেরে তার হাতব্যাগটি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ওই ব্যাগে বেশ কয়েক হাজার টাকা ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছিল বলে জানান ইকবাল মাহমুদ।

রাজধানীতে গত দুই মাসের অপরাধ পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ছিনতাইকারীদের গুলি ও ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নিহত হয়েছে তিনজন, আহত অর্ধশতাধিক।

বিজ্ঞাপন

২৯ নভেম্বর কর্মস্থল থেকে রিকশায় মোহাম্মাদিয়া হাউজিং সোসাইটির বাসায় ফিরছিলেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ফরহাদ আলম। মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডে আসতেই ছিনতাইকারীরা মোটরসাইকেলে এসে ব্যাগ টান দেয়। তিনি ছিটকে রাস্তার আইল্যান্ডে পড়ে মাথায় আঘাত পেলে তাকে নিউরো সায়েন্স ইনস্টিটিউটে ভর্তি করানো হয়। এরপর ৫ ডিসেম্বর তিনি মারা যান। এ ঘটনাতেও কোনো ছিনতাইকারীকে আটক করতে পারেনি পুলিশ।

১০ ডিসেম্বর রাতে ওয়ারীতে শাহীদা নামে এক নারীর পায়ে গুলি করে ভেনিটি ব্যাগ ছিনিয়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। এর আগে মৌচাক এলাকায় রিকশায় যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে আহত হন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক মাহবুবুল হক। তারও আগে গত ৮ অক্টোবর টিকাটুলীতে এক নারীকে ছিনতাইকারীদের কবল থেকে বাঁচাতে গিয়ে খুন হন ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আবু তালহা খন্দকার।

ছিনতাইয়ের শিকার ব্যক্তিরা বলছেন, বেশিরভাগ ঘটনার প্রতিকার না পাওয়ায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যেতে চান না। তাদের অভিযোগ, ডিএমপিতে অনেকগুলি চেকপোস্ট বসালেও গাড়ির কাগজপত্র দেখাতেই বেশি ব্যস্ত থাকেন পুলিশ সদস্যরা। তা ছাড়া ভোরে ও বিকেলে টহল একেবারই থাকে না বেশিরভাগ এলাকায়। এ সুযোগে বেড়ে গেছে ছিনতাইকারীচক্র।

আর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একটি সূত্র বলছে, রাজধানীতে প্রায় ১৫০টির মতো স্পট আছে যেখানে প্রতিদিন অন্তত একটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাইকারীরা কোথাও কোথাও ‘গ্যাং পার্টি’ গড়ে তুলেছে। গোয়েন্দা পুলিশ এরই মধ্যে এসব স্পট চিহ্নিত করে কাজ শুরু করেছে বলে জানা গেছে। এর মধ্যে মোহাম্মদপুরের কলেজগেট থেকে রিং রোড, আগারগাঁওয়ের সংযোগ সড়ক, খিলক্ষেত থেকে বিমানবন্দর সড়ক, মৌচাক মার্কেট থেকে মগবাজার, সদরঘাটথেকে সূত্রাপুর-দয়াগঞ্জ, ওয়ারী, উত্তরা থেকে আব্দুল্লাহপুর, ঝিগাতলা থেকে রায়েরবাজার-শংকর, মিরপুরের রূপনগর-বেড়িবাঁধ, যাত্রাবাড়ীর দোলাইরপাড়-শ্যামপুর অন্যতম।

বিজ্ঞাপন

এর আগে ২০১৪ সালের ২৮ অক্টোবর ধানমণ্ডির সোবহানবাগে টানা পার্টির কবলে পড়ে শিশুসন্তান রাইসার সামনে প্রাণ হারান মা রিপা। ২০১৫ সালের ২৪ আগস্ট কমলাপুরে চিকিৎসক দম্পতি সানজানা জেরিন খান ও মোনতাহিন আহসান ভূঁইয়া রনি একইভাবে পড়েন টানা পার্টির কবলে। মাথায় গুরুতরজখমে কোমায় চলে গেছেন ডা. জেরিন। তিনি বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন আছেন।

এ ব্যাপারে জানতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ছিনতাইকারীদের অনেককে পুলিশ কষ্ট করে ধরে আদালতে পাঠায়। সেই ছিনতাইকারীরা ৩/৪ দিনের মাথায় আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান। এতে করে তারা বেশি উৎসাহিত হয়। জেল থেকে বেরিয়ে আরো বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠে।

তবে ডিএমপির মিডিয়া শাখার উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেছেন, ছিনতাইকারীদের ধরতে এরই মধ্যে পুলিশ পোশাকে ও সাদা পোশাকে কাজ করছে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশও মাঠে নেমেছে। আশা করি জড়িতরা ধরা পড়বে। তিনি আরো বলেন, ছিনতাই হঠাৎ করেই বাড়েনি। এটি চলমান পেশা দুর্বৃত্তদের। তবে এটি মাঝে মধ্যে নিয়ন্ত্রণে ছিল। যারাই ছিনতাই করছে তারা সবাই নেশাগ্রস্থ। মূলত নেশার টাকা যোগান দিতেই তারা ছিনতাই করে থাকে।

সারাবাংলা/ইউজে/এসআই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন