বিজ্ঞাপন

বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি

May 2, 2019 | 2:33 pm

“A free press can, of course, be good or bad, but, most certainly without freedom, the press will never be anything but bad.” ― Albert Camus

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি প্যারিসভিত্তিক সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংস্থা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্সের (আরএসএফ) একটি প্রতিবেদন জানিয়েছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশ চার ধাপ পিছিয়েছে। গণমাধ্যম পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে তৈরি সূচকে ১৮০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। এর আগে ২০১৮ সালে ছিল ১৪৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বাংলাদেশের৷

এমন একটা মন্তব্য খুব ঢালাও বলেই ধারণা করি। তবে আমরা সবাই বুঝতে পারি, বাংলাদেশের গণমাধ্যম এক নতুন প্রেক্ষাপটের সামনে হাজির। একথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশে স্বাধীন মত প্রকাশের অবস্থা ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে৷ স্বাধীন সংবাদ পরিবেশন এবং স্বাধীন সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে পড়ছে৷ একদিকে জঙ্গি, দুষ্কৃতকারী, পেশিশক্তির দাপট, অন্যদিকে বিভিন্ন আইনের খড়গ সাংবাদিকদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক৷

গণতান্ত্রিক সমাজে গণমাধ্যম নাগরিকের অধিকার রক্ষায় ভূমিকা রাখে, তথ্য জগতে তার প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। মানুষ জানতে চায়, মানুষ সমাজের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে চায়। আর সেখানেই গণমাধ্যমের ভূমিকা। নীতিনির্ধারক, আইনসভাসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটাতে ভূমিকা রাখে গণমাধ্যম। গণমাধ্যমে প্রতিফলিত হয় দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। স্বাধীনতার আগে এবং পরে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মানুষের প্রতিটি গণতান্ত্রিক, সমাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগ্রামের সঙ্গে থেকেছে। বাংলাদেশে গণমাধ্যম নানা ঐতিহাসিক ঘটনায়, মানুষের অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থেকেছে। দুর্নীতি, সহিংসতার ইস্যুকে অনেক সময় গণমাধ্যমই সবার আগে মানুষের কাছে নিয়ে আসতে পেরেছে।

বিজ্ঞাপন

বাংলাদেশের media landscape বা গণমাধ্যম চিত্রটি গত দুই দশকে বড় ধরণের পরিবর্তনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। এক সময় শুধু সংবাদপত্রের উপর নির্ভরশীল সমাজ এখন বাস করছে ইনফরমেশন সুপার হাইওয়ে বা তথ্যের মহাসড়কে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সম্প্রচার সাংবাদিকতার যে দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল, তা আজ সম্প্রসারিত। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুবাদে অনলাইন নতুন বাস্তবতা। তথ্যের এক সময়ের যে একক প্রবাহ ছিল তার স্থলে চলে এসেছে মানুষের সরাসরি অংশগ্রহণের টু-ওয়ে গণমাধ্যম।

একদিকে সরকারের প্রচেষ্টায় মানুষের ভেতরে জন্ম নেয়া উন্নয়ন স্পৃহা, অন্যদিকে জটিল রাজনীতি, উগ্রবাদের মত বিষয়গুলো মোকাবেলা করে চলতে হচ্ছে বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজকে। কিন্তু বলতে দ্বিধা নেই রাজনৈতিক কারণে বিভাজিত সাংবাদিক সমাজ রাজনীতি থেকেই বড় চাপটি বয়ে চলেছে। গণমাধ্যমের ওপর রাজনৈতিক চাপ নতুন নয়৷ তবে এখন আগের চেয়ে সেল্ফ সেন্সরশিপ বেড়েছে বহুগুণ। আমরা অনেক কিছু লিখছি, বলছি, অবাধে বলছি বা লিখছি, কিন্তু অনেক কিছুই প্রকাশ করছিনা।

পুরোটা নয়, আংশিক সত্যের এই তথ্য প্রবাহে যুগে এসে প্রশ্ন উঠেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম যে তথ্য বা কনটেন্ট উপস্থাপন করে, তার মালিকানা আসলে কার কাছে? সাংবাদিকের কাছে যিনি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন? নাকি গণমাধ্যম মালিকের কাছে? নাকি রাষ্ট্রে যার ক্ষমতা তার কাছে? এসব জটিল প্রশ্নের নানা ধরণের উত্তর হবে। তবুও বলতে হবে, গণমাধ্যমের মালিক ও রাষ্ট্রের মিলিত নেক্সাসের মাঝেও জনগণের ভরসার এখনও শেষ ঠিকানা গণমাধ্যম। গণতান্ত্রিক অনেক প্রতিষ্ঠানের অকার্যকারিতায় বিভিন্ন বিষয়ে বিতর্কের, মত প্রকাশের সুযোগ করে দিচ্ছে গণমাধ্যমই এবং সেটা করছে সাংবাদিক সমাজ একটা লড়াইয়ে আছে বলেই।

বিজ্ঞাপন

এদেশের একজন সাংবাদিককে এক নিরন্তর লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে তার দিন/মাস/বছর পার করতে হয়। এ লড়াই নিজের সাথে যে, সঠিক সাংবাদিকতা সে করতে পারছে কিনা, লড়াই সহকর্মীদের সাথে, লড়াই মালিকের ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সাথে, লড়াই রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে, এমনকি নিজের সাংবাদিক ইউনিয়নের সাথে। প্রতিটি স্তরে তাকে বুঝে নিতে হয় কত কঠিন তার এই পেশা। রাষ্ট্র এবং কর্পোরেটের চাপ, সমাজে কট্টর মতামত, আইন ও প্রশাসনের অপব্যবহার, মিডিয়ার আপোস— মত প্রকাশের স্বাধীনতার সামনে বিস্তর বাধা। সাংবাদিকদের মামলা দিয়ে হয়রানি করা খুব সাধারণ একটা ব্যাপার এখানে। মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ অনেক সময় ব্যয় করতে হয় সম্পাদক ও সাংবাদিকদের। যারা নিজেদের উদ্যোগে সাংবাদিকতা করেন, তাদের ক্ষেত্রে এই বিপদ অতি প্রবল। বিশেষত দূরবর্তী অঞ্চলগুলিতে, তথাকথিত ‘জাতীয়’ সংবাদমাধ্যমের নাগাল ও নজর থেকে তারা অনেক দূরে।

চাকরির নিরাপত্তা নেই, ঠিক মত বেতন হয়না বহু পত্রিকা, অনলাইন ও সম্প্রচার মাধ্যমে। কারণ গণমাধ্যম অর্থনীতি নতুন সব চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে নিয়মিত। সংবাদপত্র পাঠকের স্বল্পতা ক্রমশ প্রকট হচ্ছে। সংবাদপত্রের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখাই এখন আরেক লড়াই। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিয়মিত সংবাদপত্র পাঠের অভ্যাস শোচনীয় ভাবে কমছে, কমছে দেশীয় টেলিভিশন দেখা। ডিজিটাল প্লাটফর্মের ব্যাপক বিস্তার এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছে যে, পাঠক বা দর্শক টেনে নেয়ার পাশাপাশি এখন তারা গণমাধ্যমের আয়ের একমাত্র উৎস – বিজ্ঞাপনও ছিনিয়ে নিচ্ছে।

বাংলাদেশের গণমাধ্যমে বড় পুঁজির প্রবেশ ঘটেছে, একটা ঝা-চকচকে অবস্থা অনেকদিন ধরে, অনেকের মাঝে দেখা গিয়েছে। কিন্তু তথাকথিত পুঁজি সাধারণ কর্পোরেট সংস্কৃতিও এই জগতে আনতে পারেনি। বাংলাদেশের খুব কম পত্রিকা, টেলিভিশন, বেতার বা অনলাইনের প্রাতিষ্ঠানিকতা দেখছি আমরা। গণমাধ্যম কর্মীদের রাজনৈতিক বিভাজন একটি বড় উদ্বেগের কারণ, সেকথা আগেই বলেছি। সরকারের সহযোগিতায় এবং একই সাথে গণমাধ্যম কর্মীদের নিজেদের উদ্যোগে গণমাধ্যমসমূহ প্রাতিষ্ঠানিক হয়ে না উঠলে আমাদের সাংবাদিকতার মান বাড়বেনা, আমাদের স্বাধীনতা নিশ্চিত হবেনা, আর্থিক অবস্থার কোন বিকাশ দেখতে পাবনা নিকট ভবিষ্যতে।

মুক্ত গণমাধ্যম দিবসের প্রাক্কালে দাঁড়িয়ে বলতে চাই আসলে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য দরকার নিজের ভূমিকার প্রতি গণমাধ্যম কর্মীদের আস্থা রাখা। প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, এমনকি সাংবাদিক ইউনিয়নগুলোর উচিত একটা নিজস্ব আচরণবিধি তৈরি করে সে পথে চলা। গণমাধ্যমের কর্মকাণ্ড নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব আমাদের নিজেদেরই। তবে একই সাথে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ গণমাধ্যমকে বাঁচাতে ভূমিকা চাই নাগরিক সমাজ থেকেও। পশ্চিমী গণতান্ত্রিক দেশগুলিতে নাগরিক সমাজের নানা সংগঠন আছে, যারা গণমাধ্যম আক্রমণ হলে, বিপদে পড়লে তার পাশে দাঁড়ায়। এ দেশে তেমন সংহতির খুব অভাব। গণমাধ্যম লেখক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকারদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিপন্ন হলে যেভাবে দাঁড়ায় তা কি দেখতে পাই আমাদের বেলায়?

বিজ্ঞাপন

বর্তমান বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমের জন্য তিনটি বিষয়কে প্রধানতম সমস্যা বলা যায়। এগুলো হলো গণমাধ্যমের অভ্যন্তরীণ সমস্যা, সরকার ও জাতীয় সমস্যা এবং উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতা। কিন্তু গণমাধ্যমের অর্থনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিকতার সংকট আমাদের কোথায় নিয়ে যায় সেটি দেখার অপেক্ষায় না থেকে একটু নিবিড় দৃষ্টি দেই কিভাবে সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে পারি। গণমাধ্যমে মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, সংকট ও সম্ভাবনার কথা বলে। গণমাধ্যম মানুষের স্বপ্ন পূরণের কথা বলে এবং বলেও যাবে সবসময়। কিন্তু আমরা জানিনা নিজেদের আকাশে জমে থাকা মেঘ কাটবে কবে?

নিবন্ধটি জাতীয় প্রেসক্লাবের সেমিনারে উপস্থাপিত
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এডিটর ইন চিফ সারাবাংলা ও জিটিভি

Tags: , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন