June 17, 2019 | 5:02 pm
এসেছে ডেঙ্গুর সিজন
সময় থাকতে সাবধান হোন
প্রতিবছর জুন-জুলাই থেকে অক্টোবর-নভেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। কোন শিশুর ডেঙ্গুজ্বর হলে বাবা-মা স্বভাবতই অস্থির হয়ে যান। অনেকেই শুরু করেন বাচ্চাকে নিয়ে হসপিটাল থেকে হসপিটালে ছুটোছুটি।
অনেকেরই ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে ভুল ধারণা আছে। ডেঙ্গু হলেই যে তার আলাদা কোন চিকিৎসা শুরু করতে হবে অথবা প্লেটলেট কমে গেলেই রক্ত বা স্যালাইন দিতে হবে, তা নয়। কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলেই শিশুকে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা করা সম্ভব।
সব ডেঙ্গুজ্বরেই জটিলতা দেখা দেব তা নয়। দুদিনেই জ্বর ভালো হয়ে যেতে পারে। তবে জ্বরের পরয়ের ৫ থেকে ৬ দিন সাবধান থাকতে হয়। এরপর আর কোন সমস্যা দেখা দেয় না। শিশু যদি নিজে নিজে প্রচুর পরিমানে পানি (২-৩ লিটার), ফলের রস, ডাবের পানি ও তরল খাবার খেতে পারে ও র্যাশ না থাকলে বা প্লেটলেট কাউন্ট ১ লাখের আশেপাশে থাকলেও আমরা তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেইনা। বাসাতেই চিকিৎসা দিতে বলি। তবে বাচ্চা মুখে খেতে না পারলে, প্রেসার কম থাকলে, পেটে ব্যথা বা পেটে পানি আসলে, র্যাশ বা প্লেটলেট নরমাল থাকলেও বাচ্চাকে অবজারভেশনের জন্য পরিস্থিতি অনুযায়ী ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
ডেঙ্গুর লক্ষণ
যে কোন ভাইরাল ফিভারেই প্রচন্ড জ্বরয়ের সাথে সারা শরীরে ব্যথা থাকে। সেই সাথে বমি বমি লাগা ও দুর্বলতাও থাকে। ডেঙ্গু জ্বর হলেও এসব লক্ষণ দেখা দেয়। তবে ব্যথার মাত্রা বেশি হতে পারে।
সাধারণত চোখের পিছনে, মাথা ও হাড্ডির ভেতর ব্যথা হচ্ছে এমন মনে হয়। অনেক সময় বাচ্চারা ঠিকমতো বুঝিয়ে বলতেও পারেনা ব্যথা কোথায় বা কেমন। কিছু বাচ্চার জ্বরের সাথে কাশি বা ডায়রিয়াও হতে পারে। এছাড়া পেট ব্যথা, পেট ফুলে যাওয়া, মাথাঘোরা, খিচুনি ও হয়ে অজ্ঞান হওয়ায় মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরে সাধারণত দুইদিনের মধ্যেই জ্বর চলে যায়। তবে দেখে দেয় অন্যান্য লক্ষণ। যেমন, সারা শরীর লাল হয়ে যাওয়া, চুলকানি, মাড়ি থেকে রক্তপাত ইত্যাদি।
এটাই মূলত ডেঙ্গুর ক্রিটিকাল পিরিয়ড। এসময়ে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে এবং কাশি বা বমির সাথে রক্ত যেতে পারে। পেটে পানি জমা বা তীব্র পেটে ব্যথাও হতে পারে। ফুসফুসে পানি জমে শ্বাসকষ্ট হতে পারে। তাই এসব লক্ষণ দেখা দিলে বাড়তি কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
তবে সব ডেঙ্গু জ্বরেই এমন হবে তা নয়। অনেক সময় জ্বর পাঁচ ছয় দিনও থাকে। এবং শিশুর গায়ে জ্বর থাকা অবস্থাতেই গায়ে র্যাশ, চুলকানি, তীব্র পেটব্যথা ও রক্তক্ষরণ হতে পারে। অনেক শিশুর খিচুনি দেখা দিতে পারে বা অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে কেউ কেউ।
কোন জটিলতা না থাকলে সাধারণত ডেঙ্গুর আলাদা কোন চিকিৎসা নেই। কাজেই গায়ে র্যাশ দেখা দিলেই বা রক্ত পরীক্ষায় প্লেটলেট ১ লাখের নীচে নামলেই ঘাবড়ে যাওয়ার প্রয়োজন নাই। আসুন দেখে নেই শিশুর ডেঙ্গুজ্বরে করণীয় সম্পর্কে জেনে নেই।
শিশুর ডেঙ্গুজ্বরে করণীয়
অন্যান্য জ্বরের মতই ডেঙ্গু জ্বর হলে বাচ্চার গা মুছে দেবেন। প্রচুর পানি পান করাবেন। তবে একটু একটু করে। সেই সাথে তরল খাবার যেমন, ডাবের পানি, স্যুপ, শরবত বেশি বেশি করে দেবেন।
বমিভাব দূর করার জন্য প্রয়োজনে সেভেন আপ বা স্প্রাইট গ্লাসে ঢেলে আগে গ্যাসটুকু বের হয়ে যেতে দেবেন। গ্লাসে বুদবুদ ওঠা বন্ধ হয়ে গেলে ঔষধের মতো করে এক চামচ এক চামচ করে ১০-১৫ মিনিট পর পর খাওয়াবেন। এর ফাঁকে ফাঁকে এক চামচ করে খাবার খাওয়াবেন।
বাচ্চাকে যতটা সম্ভব বিশ্রামে রাখতে চেষ্টা করবেন। দৌড়ঝাপ না করে ও গায়ে যেন ঘাম বসে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখবেন। গা ঠান্ডা রাখতে ও জ্বর কমাতে মাথায় পানিপট্টি দিতে হবে। কিন্তু অতিরিক্ত পানিযুক্ত ভেজা গামছা দিয়ে গা মোছাবেন না। এতে ঠান্ডা লেগে জ্বর আরো বেড়ে যাবে। পানিতে গামছা বা পাতলা কাপড় ভিজিয়ে ভালো করে চেপে পানি ঝরিয়ে সেই কাপড় দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত বার বার করে মুছে দেবেন। স্বাভাবিক গোসল বন্ধ করবেন না, প্রয়োজনে কুসুম গরম পানি দিয়ে গোসল করাবেন।
জ্বর যদি ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা তার বেশি হয় তাহলে প্যারাসিটামল সিরাপ খাওয়াবেন ছয় ঘন্টা পর পর। তবে অপ্রয়োজনে বা জ্বর না মেপেই ওষুধ খাওয়াবেন না। ভুলেও বা অপ্রয়োজনে প্যারাসিটামল বা ক্লোফেনাক জাতীয় বা অন্য কোন NSAID জাতীয় ব্যথার ঔষধ; আবারও বলছি, ভুলেও খাওয়াবেন না।
এগুলো শরীরের প্লেটলেটের উপর বিরূপ প্রভাব (প্লেটলেট এগ্রিগেশনে বাঁধা দেয়া) ফেলে এবং হঠাৎ ব্লিডিং শুরু হতে পারে ও কিডনি বিকল করে দিয়ে পরিস্থিতি আরো জটিল হতে পারে। তবে ব্যথা বেশি হলে টকজাতীয় খাবার যেমন লেবু, কমলা, জাম্বুরা, আমড়া ইত্যাদি ফল খাওয়ালে উপকার পাবে।
জ্বর বেশি হলে গা মুছিয়ে ঠান্ডা রাখতে হবে। অনেকসময় প্যারাসিটামল দেওয়ার পরও জ্বর কমতে চায় না। তাই জ্বর খুব বেশি হলে (১০৩°F – ১০৫°F), সাপোজিটরি ব্যবহার করতে পারেন। মনে রাখবেন, একটা সাপোজিটরি ব্যবহারের ৮ ঘন্টার মধ্যে আর নতুন করে সাপোজিটরি দিতে পারবেন না। সারাদিনে তিনবারের বেশি সাপোজিটরি ব্যবহার করা যাবে না।
ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে জ্বর ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যে কমতে শুরু করে। আবার অনেকসময় জ্বর আসে না। তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে জ্বর কমার সাথে সাথে নানা সমস্যা দেখা দেয়। তাই জ্বর কমলেও ডাক্তারের তত্বাবধায়নে থাকতে হবে। অন্য কোন সমস্যা না থাকলে, সাধারণ জ্বর ও ডেঙ্গুর একই চিকিৎসা চলবে।
কিছু সতর্কতা
মনে রাখবেন,
মশা প্রতিরোধ করুন
ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়াকে
বাই বাই বলুন
লেখক – শিশু বিশেষজ্ঞ
আবাসিক মেডিকেল অফিসার
বহির্বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল
সারাবাংলা/আরএফ