বিজ্ঞাপন

জিহান সারোয়ার প্রিয়’র মা বলছি…

November 24, 2019 | 7:23 pm

মোহছেনা ঝর্না

আমার প্রিয় শুক্রবার সকাল নয়টার দিকে ঘুম থেকে ওঠে। ওকে কোলে নিয়ে আমি হাঁটছিলাম। হঠাৎ করে ও গলগল করে বমি করে। পরপর দু’বার। তারপর খুব দুর্বল ছিল সারাদিন। গা গরম ছিল। শনিবার সকাল থেকে প্রিয় সুস্থ। তারপরও আমি সকালে ডাক্তার আশুতোষ দাশের সিরিয়াল নিলাম। ৭/৮ নম্বর সিরিয়াল। জিহান নামে। পরে দেখি সারাদিন আমার প্রিয় সুস্থ। জ্বর নেই। হাসি খুশি। প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক। সেজন্য রাতে আর ডাক্তারের কাছে যাইনি। রাতে প্রায় ১০/১১টা পর্যন্ত ছেলে খেলছিল। তারপর ঘুমিয়ে যায়।

বিজ্ঞাপন

নরমালি প্রতিরাতে প্রিয় দুইবার বুকের দুধ খেতো। তাই ঘুমের মধ্যেও ওর উউ শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যেত। সেরাতেও ঘুম ভাঙল। ছেলের গায়ে হাত দিয়ে মনে হলো অনেক জ্বর। ওর বাবাও ছেলের উউ শব্দে জেগে উঠল। বললাম, থার্মোমিটার নাও। ছেলের জ্বর। ও উঠে থার্মোমিটার দিল। বগলে জ্বর মেপে দেখি ১০১ ডিগ্রি। ইনটেক নাপা ছিল। নাপা খুলে ১ চামচ নাপা খাইয়ে দুধ খাওয়ালাম। কিছুক্ষণ পর প্রিয় ঘুমিয়ে পড়ল। তারও কিছুক্ষণ পর গায়ে হাত দিয়ে দেখি প্রিয় বাবার শরীরে ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়েছে। এরপর রাতে আর জ্বর আসেনি।

সকাল সাড়ে নয়টার দিকে জ্বর মেপে দেখি আবারও ১০১ ডিগ্রি। আবার নাপা খাওয়ালাম এক চামচ। এর পর আবার ডাক্তার আশুতোষ দাশের সিরিয়াল নিলাম। ৫ নম্বর সিরিয়াল। ‘প্রিয়’ নামে সিরিয়াল নিলাম। এরপর ছেলেকে খিচুড়ি খাওয়ালাম। সামান্যই খেলো। দুর্বল লাগছিল। আমি কোলে নিয়ে কতক্ষণ হেঁটে তারপর দুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম।

মেয়ে জাইফা স্কুল থেকে ফিরেছে পৌনে বারটায়। জাইফা স্কুল থেকে ফেরার একটু আগেই প্রিয়র ঘুম ভাঙে। শরীরে শান্তি লাগছিল না। তারপরও বোনকে দেখে হাসার চেষ্টা করল। বোনকে দেখলে একটা অদ্ভুত সুন্দর হাসি দিত। যেন জান ফিরে পেয়েছে। এর মধ্যে আমি মেয়েকে নাস্তা খাইয়ে ছেলের গা মুছে দিলাম কুসুম গরম পানি দিয়ে। মাথায় পানি দিলাম। মাথা মুছিয়ে, জামা বদলিয়ে খিচুড়ি খাওয়াতে চাইলাম, খেলো না। আবার দুধ মুখে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। তখন গা হালকা গরম ছিল।

বিজ্ঞাপন

এরপর দুপুরের ভাত খেয়ে আমি তিনটার দিকে আবার ছেলের জ্বর মেপে দেখি জ্বর ১০২ ডিগ্রি। আমার ছোট ভাই জীবনকে দিয়ে দ্রুত এইচ সাপোজিটরি ১২৫ মিলিগ্রাম আনালাম। আনতে আনতে ছেলেও ঘুম থেকে জেগে উঠল। আমি ওকে কোলে নিয়ে দ্রুত দুধ মুখে সাপোজিটরির কভার খুলে হাতে নিলাম।ঠিক তখনি আমার প্রিয় বাবা একটা চিৎকার দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে খিঁচুনির মতো একটা অন্যরকম শব্দ করতে থাকল। কোনো কিছুতেই শব্দ কমছিল না। সেইসঙ্গে ওর তাকানোটাও কেমন জানি লাগছিল। ততক্ষণে আমার ছোট ভাই পাশের বাসা থেকে আমার বাবা-মাকে ডেকে এনেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ছেলেকে নিয়ে শিশু হাসপাতালের দিকে রওনা দিলাম।

পাগলের মতো রাস্তায় নেমে দেখি একটা সিএনজিও নেই। এদিকে প্রিয় বাবা তো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। কোথ থেকে আল্লাহ এক দয়াশীল মানুষ পাঠালো। গাড়ি ড্রাইভ করে ঢুকছিল আমাদের গলির দিকে। রাস্তায় এরই মধ্যে মানুষ জমে গেছে। আমি কান্না করে বলছিলাম, ভাই একটু দয়া করেন না। একটু শিশু হাসপাতালে পৌঁছে দেন। তার মনে দয়া হলো। হাসপাতালে পৌঁছাতে সময় যেন ফুরোচ্ছিল না। হাসপাতালে পৌঁছেই ছুটে গেলাম ইমার্জেন্সিতে। ততক্ষণে প্রিয়র বাবাও পৌঁছে গেছে। ইমার্জেন্সির ডাক্তাররা সাপোজিটরি দিল। তড়িৎ গতিতে ওষুধের নাম লিখে দিল। শামীম দৌড়ে গিয়ে আনল। ওরা প্রথমে পুশ করল সেডিল। এর মধ্যে আমার ভাইয়ের স্ত্রী তানজুকে বলল, যেন ঠাণ্ডা কাপড় দিয়ে প্রিয়’র গা মুছে দিতে। সেডিলে কাজ হচ্ছিল না। প্রিয়র হাত-পা, সারাশরীর শক্ত হয়ে যাচ্ছিল। ডাক্তাররা বলছিল, সেডিলে এখন কাজ করে না। তারা ডোরমিকাম পুশ করল। ডোরমিকাম পুশ করার পর হাত-পা একটু নরম হয়ে ফের শক্ত হয়ে গেল। ডাক্তাররা বলল, ওর জ্বরজনিত স্বাভাবিক খিচুনি মনে হচ্ছে না। ধরন দেখে মনে হচ্ছে মেনিনজাইটিজ। ওকে দ্রুত আইসিইউতে নিতে হবে। আমাদের আইসিইউ খালি নেই। সিসিইউ খালি আছে। কিন্তু ওর যে কন্ডিশন তাতে সিসিইউতে রিস্ক হয়ে যাবে। বেটার আপনারা ওকে কোথাও আইসিইউতে ভর্তি করান।

আমি কান্না থামিয়ে বললাম, ‘আপু, কোন আইসিউতে নিব? একটু সাজেস্ট করেন না।আমাদের তো ব্রেন কাজ করছে না।’ ওরা বলল, আপনাদের যেখানে পছন্দ নিতে পারেন। চাইল্ড কেয়ার আছে, মেডিকেল সেন্টার আছে। ম্যাক্স আছে। আমার বড় ভাই সুমন এসে পৌঁছে গেল। মুহূর্তেই সিদ্ধান্ত নিলাম ম্যাক্সে নিয়ে যাব। কারণ চাইল্ড কেয়ার সম্পর্কে আমার বিরূপ ধারণা আছে। আমার মেয়েকে পুরা মেরেই ফেলছিল ওরা। তাই চাইল্ড কেয়ারের নাম শুনলেই আমার রাগ হয়। আর গত বছর ১৮ অক্টোবর আমার কাকা মারা গেছে মেডিকেল সেন্টারে। বাকি থাকল ম্যাক্স। কাকাকে মেডিকেল সেন্টার থেকে ম্যাক্স এ নিয়েছিল। তখন কাকা অলরেডি নাকি ডেথ। কিন্তু হার্টের ডাক্তার আশীষ দে এর আন্তরিকতা নাকি অনেক বেশি ছিল। সবার ধারণা, ভুল চিকিৎসায় সাংবাদিক কন্যা রাইফার মৃত্যুর পর তুমুল আন্দোলনের ফলে ম্যাক্স হয়তো অনেক বেশি আন্তরিক সেবা দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

তাই বিলম্ব না করে অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে ছুটে গেলাম ম্যাক্সে। মেজো ভাই রিমন ম্যাক্সেই অপেক্ষা করছিল। নিয়ে গেলাম ম্যাক্সের এন আইসিইউতে। ডিউটি ডাক্তার এসে বলল, আপনারা কোন স্পেলাশিস্টকে দিয়ে চিকিৎসা করাতে চাচ্ছেন। প্রিয়র অবস্থা দেখে আমাদের সবারই নার্ভ কম বেশি ডাউন গেছে। আমি বললাম, এন আইসিইউতে নিজস্ব স্পেশালিস্ট নাই?’ ডিউটি ডাক্তার বললেন, ‘না। তবে এই মুহূর্তে এখানে একজন চাইল্ড স্পেশালিস্ট আছেন। ডা. সনৎ কুমার বড়ুয়া। আপনারা চাইলে ওনাকে দেখাতে পারেন। আমি বললাম, দেখান। ডা. সনৎ কুমার বড়ুয়া আমার ছেলেকে দেখলেন। ডিউটি ডাক্তারকে বিভিন্ন নির্দেশনা দিয়ে আমাকে আর শামীমকে এন আইসিইউর বাইরে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে বললেন, মা ও শিশু হাসপাতাল থেকে এখানে পাঠালো কেন আপনাদের?

আইসিইউ খালি নাই বলার পর তিনি সেখানকার যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে জানতে চাইলেন। আমি জানানোর পর তিনি বললেন, শিশু হাসপাতালে যে ওষুধ দিয়েছে জ্বর থেকে স্বাভাবিক খিচুনি হলে তা কন্ট্রোল হয়ে যাওয়ার কথা। যেহেতু হয়নি তাই তিনি ধারণা করছেন, মেনিনজাইটিজ এংকা ফালাইটিস নামক একটা ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসবাহিত খিচুনি এটা। এটা হলে বাচ্চার ব্রেন ড্যামেজ হয়ে যেতে পারে। ওর স্বাভাবিক চলন ব্যাহত হতে পারে।।বাচ্চা কোমায়ও চলে যেতে পারে। এগুলো এই রোগের ফলাফল। আমাদের গলা শুকিয়ে আসছিল। তিনি বললেন, ‘দোয়া করেন, আল্লাহকে ডাকেন। আমি মেনিনজাইটিজের চিকিৎসাই শুরু করেছি। আর কিছু টেস্ট করাচ্ছি। বাচ্চার এমআরআই করতে হবে, আর মেরুদণ্ডের হাড়ের রস নিয়ে একটা পরীক্ষা আছে, সেটা করে দেখতে হবে ওর ব্রেনে কোনো ইনফেকশন হয়েছে কি না। তবে সেগুলো পরে। কারণ এই মুহূর্তে ওর শরীরের যে কন্ডিশনে তাতে ওগুলো করা যাবে না। এরপর অবশ্য তিনি বলেছেন, ‘এই মুহূর্তে আমি দেখলেও আপনারা অন্য কনসালটেন্ট আনতে চাইলে আনতে পারেন। আবার আপনার যদি মেডিকেল বোর্ড বসাতে চান, তাও বসাতে পারেন।’ তারপর তিনি বেরিয়ে গেলেন।

এর পর আমি আমার আপনজন নাসির ভাইকে (সাংবাদিক নাসির উদ্দীন হায়দার) ফোন দিলাম। ছেলের কন্ডিশন জানিয়ে বললাম, ‘ম্যাক্স নিয়ে তো ভয় পাই। কিন্তু কি করব বুঝে উঠতে পারছি না।’ তারপর ডাক্তার আশুতোষ দাশের নম্বরে কল দিয়ে আমার ছেলে যে ওনার পেশেন্ট সে পরিচয় দিলাম। এর পর বললাম, ‘দাদা আমার ছেলেটা ম্যাক্সের আইসিউতে ভর্তি আছে। ডাক্তার সনৎ কুমার বড়ুয়া ওকে দেখেছে। দাদা আপনি কি একবার আসবেন?’ উনি বললেন, ‘আমাকে ভর্তির আগে ফোন দেননি কেন? এখন তো একজন কনসালটেন্ট দেখছে, আমি তো ওভাবে যেতে পারব না।’ আমার প্রশ্ন হলো, ডাক্তারদের এত ইগো সমস্যা কেন? একজন ডাক্তারের রিপোর্ট অন্য আরেকজন ডাক্তার কেন দেখবে না? কেন?

এর মধ্যে ছেলেকে ভাইরাক্স, জোভিক্স আরেকটা কি যেন অ্যান্টিবায়োটিক দিল। প্রায় দুই ঘণ্টার মধ্যে আমার প্রিয় বাবা জেগে উঠল। কান্না করে উঠল। ওরা আমাকে ডেকে ছেলেকে আমার কোলে দিল। আমাকে চিনল। মাম্মা বলে ডাকল। তবে দুর্বল ছিল। তখনও অ্যান্টিবায়োটিক চলছিল। একটা এন্টিবায়োটিক দেওয়ার পর আমার ছেলের মুখ লাল হয়ে যাচ্ছিল। তখন আমি সঙ্গে সঙ্গে নার্স ও ডিউটি ডাক্তারকে ডেকে দেখালাম। ওরাও প্রিয়’র মুখে লাল র‌্যাশ দেখে অ্যান্টিবায়োটিক বন্ধ করে দিল। তারপর তারা ডাক্তারের সাথে কথা বলে আরেকটা অ্যান্টিবায়োটিক শুরু করল। ওই অ্যান্টিবায়োটিক শেষ হওয়ার আগেই প্রিয় আবার ঘুমিয়ে পড়ল। এরপর প্রিয় যখন ঘুম থেকে জাগলো, তখন সে পুরোপুরি সুস্থ।

বিজ্ঞাপন

ডিউটি ডাক্তার আমাকে বলেছে ওর রিকোভারি ভালো। ওর অক্সিজেন নেওয়ার লেভেলও ভালো। ও আগের চেয়ে ইম্প্রুভ করছে। তবে গায়ে জ্বর ছিল। তাই আমাকে সারাক্ষণ স্পঞ্জ করতে বলল। সারারাত আমি ছেলের পাশে বসে একটু পরপর ওকে স্পঞ্জ করেছি। ওরা একবার পানির গামলা আর কিছু কটন এনে দিয়ে বলল, স্পঞ্জ করেন। না হলে, জ্বর আবার বেড়ে গেলে আবার খিচুনি হতে পারে। পরে স্পঞ্জ করার জন্য একটা ছোট তোয়ালে এনে দিলেন। ছেলের গা গরম মনে হওয়ায় আমি জ্বর দেখার জন্য বললে, নার্সরা একবার, দু’বার এসেছে। পরে বলেছে আপনি জ্বর দেখেন। থার্মোমিটার আছে। রাতে যে ডিউটি ডাক্তার ছিল তিনি তার চেয়ারেই বসে ছিলেন। প্রিয় কাঁদছিল। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে কান্না থামাচ্ছিলাম। তখন ডিউটি ডাক্তার বললেন, শুধু কান্না থামালে হবে না। স্পঞ্জ করেন। ছেলেকে কোলে নিয়ে এক হাতে অনেক কষ্ট করে তোয়ালে চেপে আমি ছেলের গা মোছার চেষ্টা করছিলাম। ওই সময় কোনো নার্স, মাসী বা কেউ একটু সাহায্য করেনি। আইসিইউর সেবা কি এমনই হয়?

পরদিন আল্লাহর রহমতে প্রিয় পুরোপুরি সুস্থ। আমি ডিউটি ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারব কি না! ডিউটি ডাক্তার স্পেশালিস্টকে কল দিয়ে আমাকে বললেন, ‘দুধ খাওয়াতে পারবেন।’ আমি প্রিয়কে দুধ খাওয়ানোর পর দুবার সে বমি করল। ফলে ডাক্তার আমাকে সেদিন প্রিয়কে সলিড খাবার দিতে নিষেধ করেন। দুপুরের দিকে ওর টেস্টের রিপোর্ট আসছে। ডিউটি ডাক্তার জানালেন প্রাইমারি টেস্টের রিপোর্ট ভালো আসছে। সেদিন ডাক্তার সনৎ কুমার বড়ুয়াকে আবার কল দিয়ে এনেছিলাম। উনি প্রিয়কে দেখে বললেন, আপনারা গতকাল যে অবস্থায় ছেলেকে এনেছেন, তারচেয়েও তো ইম্প্রুভ হয়েছে। কি বলেন? আমি বলি, ‘হ্যাঁ, হয়েছে। আমার ছেলে আমাদেরকে চিনছে। স্বাভাবিক আচরণ করছে।’ ডাক্তার বললেন, ‘তাহলে আজ মেরুদণ্ড থেকে টেস্ট (লাম্বার পাংচার) সংক্ষেপে এলপিটা করিয়ে ফেলা যায়।’ তখন প্রিয়র বাবা বলল, ‘যেহেতু বলছেন ছেলে ভালো আছে সেহেতু টেস্টটা না করালে হয় না। ছেলের কষ্টের কথা ভেবে বলছি।’
ডাক্তার জবাব দিলেন, টেস্টটা না করালে ফুল ট্রিটমেন্টটা করা যাবে না। পরবর্তীতে তার হিয়ারিং প্রব্লেম হতে পারে, তার স্কুল পারফরম্যান্স খারাপ হতে পারে। কিছু না কিছু ঘাটতির সম্ভাবনা থেকেই যাবে।
তখন প্রিয়র বাবা খুব নরম গলায় বলল, আচ্ছা তাহলে করেন।

এর কিছুক্ষণ পর আরেকজন ডাক্তার এসে লোকাল এনেস্থিসিয়া দিয়ে প্রিয়’র সেই জটিল টেস্টের জন্য রক্ত কিংবা রস সংগ্রহ করল। রাতে সেই টেস্টের একটা আংশিক রিপোর্ট এসেছে। সেই রিপোর্ট ভালো এসেছে। হাসপাতালের দ্বিতীয় দিন প্রিয়কে শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়াতে বলেছিল। তাই সেদিন একটু পরপর ক্ষুধায় ও কান্না করছিল। তৃতীয় দিন প্রিয়কে খিচুড়ি খাওয়ানোর কথা বলেছে। তৃতীয় দিন প্রিয় এত আগ্রহ নিয়ে খিচুড়ি খাচ্ছিল, চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। আর পানি খাচ্ছিল প্রচুর। পানির ফিডারটা দেখলেই পানি খাওয়ার জন্য বারবার আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল। তৃতীয় দিনও সেই বাকি রিপোর্ট আসেনি। চতুর্থ দিন (২০ নভেম্বর) বিকেলে বাকি রিপোর্ট আসছে। তখন ডিউটি ডাক্তার ছিলেন তৃণা নামের একজন। এত ভালো ব্যবহার। এত আন্তরিকতা দেখালেন। আমার ছেলের সাথে খেলার ভঙ্গি করতেন। উনি প্রিয়’র ভাইরাসের রিপোর্টটা দেখে খুব মন খারাপ করে বললেন, ‘আপনার ছেলের রিপোর্ট আসছে ‘ আমি ওনার চেহারা দেখেই বললাম, ‘আপু রিপোর্ট কি খারাপ আসছে?’ তিনি মন ভার করেই বললেন, ‘হ্যাঁ, রিপোর্টটা পজিটিভ আসছে।’ আমার ঝাপসা চোখ দেখে বললেন, ‘বাবুর রেসপন্স তো ভালো। স্যার আসুক। স্যার নিশ্চয়ই পরবর্তী করণীয় জানাবেন। ওর অন্য রিপোর্টগুলো ভালো আসছিল দেখে মনে করেছিলাম, এই রিপোর্টটাও ভালো আসবে।

আমার প্রিয়’র সাথে এন আইসিইউর সব নার্স, ডিউটি ডাক্তার অর্পা, ডাক্তার তৃণা’র খুব ভাব হয়ে গিয়েছিল। ওই তিনদিনের ম্যাক্সের এন আইসিইউর সিসি ফুটেজ দেখলেই সবাই বুঝতে পারবে আমার ছেলেটা কতখানি সুস্থ হয়ে উঠেছিল। চতুর্থ দিন প্রিয়’র পায়ে ক্যানোলা লাগাতে কনসালটেন্ট ডাকতে হয়েছে। ডিউটি ডাক্তার আর নার্সরা বলল, ‘ও একটু বড় বাচ্চা তো। আর কিছু মনে করবেন না, ও একটু হেলদি বেবি তো তাই ভেইন সহজে পাওয়া যায় না। সেজন্য কনসালটেন্ট কল করেছি। আমাকে তখন আইসিইউর বাইরে পাঠিয়ে দিত। ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারব না বলে। দ্বিতীয় দিন থেকেই প্রিয়কে এন আইসিইউর বাইরে বের করে হাঁটতে বলতো ডিউটি ডাক্তার আর নার্সরা। তখন প্রিয়’র বাবা, নানা, বড় মামা, মেজো মামা আর কলিজার টুকরা বোনেরা প্রিয়র কাছে থাকতো। বাইরে থাকলে ভালো থাকতো। আইসিইউর ভেতরে নিয়ে গেলেই কাঁদত। প্রিয়’র খিচুড়ি গরম করার জন্য কোনো ওভেন পাইনি। ডিউটি ডাক্তার ও মাসীকে রিকোয়েস্ট করার পর উপরের কোনো ফ্লোর থেকে খিচুড়ি গরম করে দিয়েছিল। কিন্তু সমস্যা হচ্ছিল যখন ওরা বলতো প্রিয়কে বাইরে না হলে ওয়েটিং রুমে গিয়ে খিচুড়ি খাওয়াতে।

চতুর্থ দিন শামীম সকাল, দুপুর ও বিকেলে এসেছে। ছেলে বাবাকে পেয়ে যেন জান ফিরে পেয়েছে। বাবাকে দেখলে এমন স্বর্গীয় হাসি! ছেলে বাবার কলার চেপে শক্ত করে ধরে রাখতো। আর আঙুল দিয়ে শুধু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যেতো চাইতো। কে জানে আমার প্রিয় বাবা হয়তো বুঝতে পেরেছে এই এন আইসিইউই ওকে মেরে ফেলবে। তাই কিছুতেই ভেতরে যেতে চাইতো না। চতুর্থ দিন বিকেলে শামীম হাসপাতালে গিয়ে যখন শুনল রিপোর্ট খারাপ এসেছে- ওর চেহারায় তখন সে কি কষ্ট। ছেলে হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে ওর বাবার মুখ লুকিয়ে কান্নাও শেষ পর্যন্ত লুকানো থাকতো না। শামীম আমাকে বলল, ‘যেই রিপোর্টটা এসেছে তুমি আমাকে একটা ছবি তুলে দাও। আমি একটু নেটে পড়ি, দেখি অসুখটা নিয়ে কিছু জানতে পারি কিনা।’ ডিউটি ডাক্তার সেই ভালো আপুটা আমাকে বললেন, ‘এভাবে ছবি তুলে দেওয়ার নিয়ম নাই। স্যার আসুক। স্যার দেখে আপনাদেরকে নিশ্চয়ই সব বলবে।’ আমিও আর জোর করলাম না। কিন্তু ভাবছিলাম এটা এমন কি গোপন দলিল যে সিনিয়র ডাক্তারের অনুমতি ছাড়া রোগীর স্বজনকে দেখানো যাবে না। ছবি তুলতে দেওয়া যাবে না।
রাত দশটায় শামীম চলে গেল। ওর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ও শুধু কেঁদে কেঁদে দোয়া করছিল রিপোর্টটা যেন পজিটিভ না আসে। কিন্তু আমাদের কপালে দুঃখ নিয়ে রিপোর্ট পজিটিভ এসেছে। রাত প্রায় ১১ টার দিকে ডাক্তার সনৎ কুমার বড়ুয়া এসেছেন। রিপোর্ট দেখেছেন। প্রিয়কেও দেখেছেন।

তারপর কথা বলার জন্য ডাকলেন আমাকে আর প্রিয়র বাবাকে। প্রিয়র বাবা বাসায় চলে আসায় আমি আর আমার মেজো ভাই রিমন ডাক্তারের সাথে বসলাম। ডাক্তার বললেন, ওর ব্যাক্টেরিয়াল মেনিনজাইটিজ এংকা ফেলাসিয়াটাই পজিটিভ এসেছে। কিন্তু ওর রিকোভারি অনেক ভালো। জ্বরও আর আসে নাই। তাই ওষুধ এগুলোই কন্টিনিউ করব ১০ দিন। তবে যে ওষুধটা ওর শরীরে স্যুট করেনি, রিঅ্যাকশন হচ্ছিল, সেই ওষুধটা দিতে পারলে অনেক ভালো হতো। কিন্তু ব্যাড লাক। ওষুধটা ওর শরীর নিতে পারছে না। তখন আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সেই ওষুধের অল্টারনেট কিছু নেই?’ ডাক্তার মাথা নেড়ে বললেন, না। তারপর আবার ডিউটি ডাক্তারকে আগামীকাল থেকে নতুন একটা অ্যান্টিবায়োটিক যোগ করতে বললেন। নাম টারবোসেফ ১৫০ মিলিগ্রাম। আর বললেন, আগামীকাল কেবিনে শিফট হতে পারব আমরা।

পরদিন, মানে ২১ নভেম্বর আমার জীবনের কালো দিন। সকালে প্রিয়’র ঘুম ভাঙার পর আবার ক্যানোলা লাগানোর জন্য কনসালটেন্ট কল করতে হলো। প্রিয়কে আমি একটু দুধ খাইয়ে বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। এর মধ্যে প্রিয়’র বাবা ওর জন্য খিচুড়ি, গরম পানি, আর আমার জন্য নাস্তা নিয়ে এসে দেখে আমি বাইরে বসে কাঁদছি।।জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে? বললাম, ছেলেকে ক্যানোলা লাগাচ্ছে। অনেকক্ষণ হয়ে গেছে। দরজায় উঁকি দিতেই একজন নার্স দরজা খুলে বললেন, না এখনো দিতে পারেনি। প্রিয়’র কান্নার শব্দ শোনা যাচ্ছিল। তার কয়েক মিনিট পরে আমাকে মানে জিহানের মাকে ভেতরে ডাকলেন নার্স। গিয়ে প্রিয়কে কোলে নিলাম। বাইরে নিয়ে ওর বাবার কাছে দিলাম। তারপর খিচুড়ি হটপট থেকে বাটিতে নিয়ে ওর বাবার কাছ থেকে ওকে এনে খাওয়াতে চাইলাম। কিন্তু চার- পাঁচ চামচ খেয়ে আর খায়নি।
তারপর আবার ওকে ওর বাবার কোলে দিয়ে বললাম, একটু ঘুম পারাতে পারো কি না দেখো। নার্স অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়ার জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছে। ছেলে বাবার কোল থেকে আসতেই চায় না। শুধু হাত দিয়ে দেখিয়ে দেয় সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে যাবে। ওর বাবা একটু ঘুম ঘুম ভাব এনেই আমার কোলে দিল। আমি দুধ মুখে দিতে চাইলাম, নিল না। তারপর জড়িয়ে পিঠে হাত বুলাচ্ছিলাম। নার্স এক সিরিঞ্জ অ্যান্টিবায়োটিক পুশ করার জন্য সেট করল মেশিনে। অ্যান্টিবায়োটিক যাওয়ার সময় মনে হয় ব্যথা পাচ্ছিল। একটু কোঁ কোঁ করে উঠছিল। আমি বুকের সাথে লাগিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করছিলাম। এক সিরিঞ্জ শেষে নার্স আরেক সিরিঞ্জ ইনজেকশন অ্যান্টিবায়োটিক সেট করল মেশিনে। তখন প্রিয়’র বাবাও আইসিউর ওয়েটিং রুমে আমার পাশে এসে বসল। চোখের পানি মুছে বলল, কিছু ভালো লাগছে না। চলো ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে যাই। ছেলের কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। প্রিয়’র বাবার মনও কি বুঝতে পেরেছিল, এখান থেকে আমাদের ছেলে আর ফিরবে না।

প্রিয়’র সিটটার ওখানে খুব গরম লাগতো। ইনজেকশন দেওয়ার সময় ও ঘেমে যেতো। তাই সকালের নার্স ওকে শেষের দুইদিন আইসিউর ওয়েটিং রুমে ফ্যান ছেড়ে অ্যান্টিবায়োটিক দিত। পরের ওই ইনজেকশন শেষ হলো। নার্স ইনজেকশনের পাইপ খুলে ক্যানোলার মুখ লাগালেন। এরপর দৌড়ে এসে নার্স আবার ক্যানোলার মুখ খুলে পাইপে যে সামান্য পরিমাণ ওষুধ ছিল তা ম্যানুয়ালি পুশ করল। এর পর আবার ক্যানোলার মুখ লাগানোর সঙ্গে সঙ্গেই প্রিয় ঘুম থেকে চিৎকার করে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমি প্রিয়কে ওর বাবার কোলে দিয়ে দিলাম। দুবার শব্দ করে প্রিয় শক্ত হয়ে গেল। দৌড়ে ডাক্তারের কাছে নিতে গিয়ে দেখি আমার বাবাটা নীল হয়ে যাচ্ছে। ডিউটি ডাক্তার, নার্স সবাই তখন খুব চেষ্টা করেছে। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। আমার প্রিয় বাবা চলে গেছে সবাইকে ছেড়ে। সব কষ্ট ছেড়ে। নিজের বাবা-মাকে ছেড়ে চলে গেছে।

এখন আমার প্রশ্ন হলো

* কী অ্যান্টিবায়োটিক দিল যে, ১৫/২০ মিনিটের মধ্যে আমার বুক খালি হয়ে গেল?
* আমার অসুস্থ প্রিয় বাবাকে সুস্থ করে কেন মেরে ফেলল তারা?
* নতুন একটা অ্যান্টিবায়োটিক আমার ছেলের শরীরে পুশ করার আগে তার স্কিন টেস্ট করানো হয়নি কেন?
* একটা এন আইসিইউতে একই সাথে পি আইসিইউ (পেডিয়াট্রিক ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট) কেন পরিচালনা করা হবে? যেখানে পি আইসিইউর বাচ্চার কান্না সমস্যা, খাওয়ানোর সমস্যা। এটার আলাদা ব্যবস্থা নেই কেন?
* এন আইসিইউতে একজন সিনিয়র কনসালটেন্ট কেন নিয়মিত থাকবে না?
* কেউ কি বলতে পারবেন এই চট্টগ্রাম শহরে কোন হসপিটাল সত্যিকার অর্থে রোগী বান্ধব?
* এই সেবাখাত যে ভয়ংকর রকম ব্যবসা ও মুনাফা খাত হয়েছে তার কী উপায় হবে? চিকিৎসকরাও নাকি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে জিম্মি। কারণ হাসপাতালে পরিচালকরা বেশির ভাগই নাকি ব্যবসায়ী।
* আমার প্রিয় বাবাকে যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে ম্যাক্স কর্তৃপক্ষ সেই প্রেস্ক্রিপশন কেন দেয়নি আমার ছেলের ফাইলে?
* যে অ্যান্টিবায়োটিকগুলো আমার ছেলেকে প্রয়োগ করা হয়েছে সেগুলো ম্যাক্স কেন গায়েব করে ফেলল?
* ডিউটি ডাক্তার কেন রিপোর্টের কপি কনসালটেন্টের সিদ্ধান্ত ছাড়া দেখতে দেয়নি? কেন ছবি তুলতে দিল না?
* আদৌ কি আমার প্রিয়’র মেনিনজাইটিজ হয়েছিল? নাকি রিপোর্ট ভুল ছিল?

লেখক: কথা সাহিত্যিক ও স্ক্রিপ্ট রাইটার

সারাবাংলা/পিটিএম

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন