বিজ্ঞাপন

বেতনের দাবিতে এখনো মাঠে নামতে হয় পোশাক শ্রমিকদের

May 1, 2020 | 3:30 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রানা প্লাজা ধ্বসের পর গেল সাত বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়েছে দেশের তৈরি পোশাক শিল্প খাতকে। দেশি-বিদেশি নানামুখী চাপে কারখানাগুলোর অবকাঠামোগত সুরক্ষা নিশ্চিতের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষায় কর্মপরিবেশ উন্নয়নের পাশপাশি শ্রম আইনও সংশোধন হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতসব উদ্যোগে শিল্প কারখানার উন্নতি ঘটলেও শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সুযোগ সীমিতই থেকে গেছে।

বিজ্ঞাপন

শ্রমিক নেতারা বলছেন, শ্রমিকদের কেবল ন্যায্য মজুরি থেকেই বঞ্চিত করা হয় না, ন্যায্য দাবি আদায়ে এখনো শ্রমিকদের নামতে হচ্ছে মাঠের আন্দোলনে। কারণে অকারণে ছাটাইয়ের ঘটনা তো আছেই। বিপদের সময়ও শ্রমিকদের সুরক্ষার বিষয় ভাবেও না মালিক পক্ষ। করোনাভাইরাস মহামারিতে সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির মধ্যেও শ্রমিকদের কারখানায় কাজের জন্য নিয়ে আসার মাধ্যমেও সেটাই প্রমাণিত হয়েছে বলে মন্তব্য তাদের।

আরও পড়ুন- শ্রম অধিকার নেই ৫ কোটি ১৭ লাখ শ্রমিকের

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ ২০১৮ সালের শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, বর্তমানে দেশে তৈরি পোশাক শিল্প কারখানার সংখ্যা ৪ হাজার ৮০৯টি। এর আগে ২০১৪ সালে করা জরিপে এই কারখানার সংখ্যা ছিল ৩ হাজার ৪৯৮টি। চার বছরে পোশাক কারখানার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে শ্রমিকের সংখ্যাও।

বিজ্ঞাপন

জরিপ অনুযায়ী, এই খাতে নিয়োজিত ৩৩ লাখ ১৫ হাজার মানুষ, যার সিংহভাগই শ্রমিক। আর বেসরকারি হিসাবে বলা হয়, এ খাতে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা ৪০ লাখ। এই বিশাল সংখ্যক শ্রমিকদের অধিকারের কথা বলতে রয়েছে ৭৩৩টি ট্রেড ইউনিয়ন। তাতে শ্রমিকদের অধিকার কতটুকু নিশ্চিত হয়েছে?

পোশাক শ্রমিকরা বলছেন, ঘোষণা ছাড়াই শ্রমিক ছাটাই এখনো দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে নিয়মিত চিত্র। অনেক পোশাক কারখানাতেই নিয়মিত বেতন হয় না।  কোথাও কোথাও মাসের পর মাস বেতন-ভাতা বকেয়া থাকে। এরপর সেই বেতন-ভাতা পরিশোধ না করেই কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। আর বেতনের দাবিতে শ্রমিকদের রাস্তায় নামার উদাহরণ তো হরহামেশাই দেখা যায়।

আরও পড়ুন- করোনা বিধ্বস্ত বিশ্বে মহান মে দিবস আজ

বিজ্ঞাপন

এ প্রসঙ্গে শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার সারাবাংলাকে বলেন, ভেবেছিলাম ২০১৩ সালে রানা প্লাজা দুর্ঘটনা থেকে এই গার্মেন্টস খাত বড় ধরনের শিক্ষা নেবে। মালিক-শ্রমিকদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হবে। এই খাতে পরিবর্তন আসবে। বাস্তবে তা আসেনি।

তিনি বলেন, শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে, ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যাও কিছুটা বেড়েছে। এই পরিবর্তনগুলো ইতিবাচক। কিন্তু বাস্তবতা হলো— শ্রমিকদের মৌলিক যে প্রাপ্য, সেই বেতনের দাবিতেই এখনো রাস্তায় নামতে হয়। আন্দোলন করতে হয়। তার জন্য পুলিশের লাঠিপেটা আর মালিকপক্ষের মামলাও সহ্য করতে হয়।

শ্রমিকদের অধিকারের জায়গা প্রতিষ্ঠিত হয়নি— এমন মন্তব্যের সঙ্গে একমত নন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান। আওয়ামী লীগ সরকার শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় সবকিছুই করেছে বলেও দাবি তার।

প্রতিমন্ত্রী সারাবাংলাকে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান সরকারের আমলে শ্রমিকেরা যে সুবিধা পেয়েছে, তা আর কোনো সরকারের আমলে পায়নি। তাদের অধিকার নিশ্চিত হয়নি, এটা সঠিক নয়।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- করোনায় সংকটে শ্রমজীবী, ধৈর্য নিয়ে মোকাবিলার আহ্বান

প্রতিমন্ত্রী জানান, পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য ফান্ড গঠন করা হয়েছে। এ ফান্ড থেকে বিপদগ্রস্ত শ্রমিকরা অর্থ সহায়তা পাচ্ছেন। শ্রমিকদের মেধাবী সন্তানেরা পড়ালেখার খরচ পাচ্ছে। তাদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া শ্রমিকদের যেকোনো অসুবিধায় সরকারের দরজা খোলা রয়েছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।

এদিকে বিশ্বজুড়ে মহামারী আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে প্রথম ধাপে। পরে ছুটি বাড়ানো হয় দফায় দফায়। ওই সময় বলা হয়েছিল, কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্রয়াদেশ থাকা ও সুরক্ষা সরঞ্জাম উৎপাদনে যুক্ত কারখানাগুলোই কেবল খোলা রাখা যাবে।

সরকারের নির্দেশনায় পোশাক কারখানার মালিকদের দুই সংগঠন বিজেএমইএ ও বিকেএমইএ-ও কারখানাগুলোকে বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয়। কিন্তু বাস্তবে অনেক কারখানাই তখনো চালু ছিল। ফলে চাকরি বাঁচাতে ‘লকডাউন’ পরিস্থিতিতে কোনো যানবাহন না থাকায় গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে হাজারও শ্রমিককে আসতে হয় ঢাকায়।

অনুরোধ না রেখে কয়েকশ কারখানা চালু রাখে মালিকরা। ফলে চাকরি বাঁচাতে গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে হাজার হাজার শ্রমিক ছুঁটে আসে ঢাকায়। শুধু তাই নয়, সরকার রফতানি খাতের শ্রমিকদের বেতন-ভাতার জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করলেও অনেক পোশাক কারখানাই নির্ধারিত সময়ে বেতন-ভাতা পরিশোধ করেনি। অনেক কারখানার শ্রমিকদের এই করোনা ঝুঁকির মধ্যেও রাস্তায় আন্দোলন করতে হয়েছে বেতনের জন্য।

শ্রমিক নেতা নাজমা আক্তার বলেন, করোনাভাইরাস সারাবিশ্বে মহামারি আকার ধারণ করেছে। দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রায় ৯৯ শতাংশ প্রতিষ্ঠানও বন্ধ রাখা হয়েছে। সেখানে পেশাক কারখানা একবার বন্ধ, একবার খোলার যে ঘোষণা আমরা দেখেছি, এটি চরম সমন্বয়হীনতা। আর মালিকদের এমন আচরণের মূল্য শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে। লকডাউনের মধ্যে কারখানা খোলা রাখার বিষয়টি শ্রমিকদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান বলেন, কারখানা খোলা রাখা বা না রাখার সিদ্ধান্ত মালিকের, এর আইনি কর্তৃত্ব সরকারের নেই। তবে শ্রমিকের অধিকার ক্ষুন্ন হলে সরকার ব্যবস্থা নেবে। আর প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে জরুরি কাজে নিয়োজিত কারখানা খোলা রাখা যাবে। তবে সেক্ষেত্রে সামাজিক দূরত্ব অবশ্যই বজায় রাখতে হবে। এ বিষয় দেখারও এখতিয়ার শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের নেই।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা দেখছি কোনো কারখানা বিনা অপরাধে শ্রমিক ছাটাই করছে কি না, বেতন বকেয়া রেখেছে কি না। এখন পর্যন্ত ৯৫ শতাংশ শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি যে ৫ শতাংশ শ্রমিকের বেতন হয়নি, তারা সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা ছোট কারখানার শ্রমিক। তাদের বেতনও দ্রুত পরিশোধ করতে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে তগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

মন্নুজান সুফিয়ান আরও বলেন, এবার করোনাভাইরাসের কারণে মে ক্রোড়পত্র ছাড়া কোনো আয়োজন থাকছে না মে দিবস পালনে। সব সংকট কাটিয়ে মালিক-শ্রমিকের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হবে— এমনটিই প্রত্যাশা তার।

সারাবাংলা/জেআর/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন