বিজ্ঞাপন

আইনজীবী নিবন্ধন পরীক্ষা আর ‘উলঙ্গ শিক্ষানবীশ’

July 29, 2020 | 9:14 pm

রাশিব রহমান

সারাদেশের আইনজীবী মহলে একটি বিষয় বহুল আলোচিত। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের একাংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে কিছু কর্মসসূচি পালন করেছে। তাদের পক্ষে থেকে দাবি জানানো হয়েছে, বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে নেওয়া চলতি বছরের আইনজীবী নিবন্ধনের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা উত্তীর্ণদের নিবন্ধন সনদ প্রদান করা হোক। উল্লেখ্য, করোনা মহামারির কারণে লিখিত আর মৌখিক পরীক্ষা নেয়া সম্ভব হয়নি।

বিজ্ঞাপন

এই শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের দেখলে আমার একটা গল্প মনে পড়ে। গল্পটা শুনেছিলাম সৈয়দ মুজতবা আলীর কাছে। মুজতবা আলী আমাদেরকে এক গণেশের গল্প শুনিয়েছিলেন। গণেশ ছিল এক অফিসের জুনিয়র এপ্রেন্টিস। কাজ শেখে, মাইনে পায় না। এর ওর ফাইফরমাশ খাটে, আশা কোনো একদিন পাকা চাকরি হবে। অফিসে কর্মও খালি হয়। বড় বাবু একে ওকে নিয়োগ দিয়ে দেন। গণেশ তার এপ্রেন্টিসের আঁকশি দিয়ে চাকরি ধরতে পারে না। এমনি করে বছর তিনেক গেল। গণেশের পরিধেয় ধুতিতে গিট দেয়ার জায়গারও অভাব পড়ে গেল। একদিন বড় সাহেব গুরুতর রিপোর্ট লিখছিলেন। দারোয়ানদের ধর্মঘট থাকায় দরজা পাহারায় ছিলো গণেশ। রাস্তা থেকে ধেয়ে আসছে এক উন্মাদ ‘বার্থডে স্যুট’ পরে, তার পিছে আরও অনেকে। উন্মাদ এসে সোজা বড় সাহেবের ঘরে ঢুকলো। গণেশ বাঁধা দেয়ার চেষ্টাও করল না। ঘরে ঢুকেই উন্মাদ বড় সাহেবকে ঠেলে ফেলে দিয়ে চেয়ার দখল করল। শেষ পর্যন্ত থানা-পুলিশে রক্ষা। এরপর এলো গণেশের জিজ্ঞাসাবাদের পালা।

গণেশের বিনীত উত্তর, “আমি ভেবেছিলুম উনি আমাদের আপিসের সিনিয়র এপ্রেন্টিস। আমি তো জুনিয়র, ওঁকে ঠেকাবো কি করে?”

বড় বাবু ব্যাখ্যা জানতে চাইলে গণেশের জবাব, “হুজুর, আমি তিন বৎসর ধরে এ আপিসে এপ্রিন্টিসি করছি। খেতে পাইনে, পরতে পাইনে। এই দেখুন ধুতি। ছিড়ে ছিড়ে পট্টি হয়ে গিয়েছে। লজ্জা ঢাকবার উপায় নেই। তাই যখন একে দেখলুম আমাদের আপিসে ঢুকছেন অবস্তর উলঙ্গ, তখন আন্দাজ করলুম, ইনি নিশ্চয় এ আপিসের সিনিয়র এপ্রেন্টিস। তা না হলে তার এ অবস্থা হবে কেন? এখানে এপ্রেন্টিসি করে করে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে সিনিয়র এপ্রেন্টিস হয়েছেন।”

বিজ্ঞাপন

এমন সব শতচ্ছিন্ন ধুতিওয়ালা জুনিয়র এপ্রেন্টিস আদালত চত্বরে প্রায়ই চোখে পড়ে। শিক্ষানবিশ আইনজীবীদের যারা প্রিলিমিনারি উত্তীর্ণ হয়েছেন, তারা আন্দোলনে গেছেন। তাদের নিয়ে আমার কোনো কথা নেই, আমার কথা এ নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়েই। আইনে স্নাতক হওয়ার পরও কেনো এমন প্রিলিমিনারি, লিখিত, ভাইভা; এতোগুলো পরীক্ষায় বসতে হবে? এমন ছাঁটাই প্রক্রিয়ার আবশ্যকতা কী?

সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকলেও তার ন্যূনতম যৌক্তিকতা আমরা বুঝতে পারি যে, রাষ্ট্র বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিশ্চিত করে তাই সে সুবিধাভোগীর সংখ্যা সীমিতকরণে রাষ্ট্রের বিশেষ মনোযোগ না দিয়ে উপায় নেই। ওকালতি তো সরকারি চাকরি না, বরং স্বাধীন ব্যবসা। এলএলবি পাশ করাটাই তো তার যোগ্যতার প্রমাণ। আবার কেন ব্যবসায়ের অনুমতিপত্রের জন্য পরীক্ষা নামের এ ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় ঢুকতে হবে?

অথচ আইনের মতো স্পেশালাইজড প্রফেশনাল ডিগ্রির অধিকারী চিকিৎসক-প্রকৌশলীরা দিব্যি স্নাতক সম্পন্ন করেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের ফরম পূরণ করেই পেশাজীবনে প্রবেশ করেন। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ইন্টার্নশিপ তাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভূক্ত থাকে। অথচ আইন স্নাতকদের শতকরা আশি ভাগই আইন পেশার বাইরে অন্য পেশা খুঁজে নিতে বাধ্য হন।

বিজ্ঞাপন

এখন প্রশ্ন থাকে আইনজীবির সংখ্যা নিয়ে। উচ্চ শিক্ষায় প্রবেশকালে এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা নামক ছাঁটাই প্রক্রিয়া উৎরালাম। সুযোগ ছিল কলা, সমাজবিজ্ঞান, আইন ও ব্যবসায় প্রশাসনের যে কোনো একটিতে ভর্তি হওয়ার। সুপ্রিম কোর্টে মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত এক আইনজীবী মামার কাছে জানতে চাইলাম আইনে ভর্তি হবো কি না। মামা বললেন, “বাবারে, দেশে ফকিরের চেয়ে উকিল বেশি।”

হয়তো এ কারণেই পেশাজীবনে প্রবেশ পথে এতো প্রতিবন্ধকতা। এ বড় সহজ সমাধান। বার কাউন্সিলের যারা হর্তা-কর্তা, এতে তাদের সাপও মরল, লাঠিও ভাঙলো না। লক্ষ লক্ষ বেকার স্নাতকের দেশে কয়েক হাজার আইন স্নাতকদের স্বপ্নভঙ্গ কী আর বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে? অথচ স্নাতক পর্যায়ে আইনের ছাত্রসংখ্যা কতো হওয়া উচিত তা বিচারালয়গুলোর অবস্থার নিরিখে নির্ধারণ ও পুণর্নিধারণ করা যেতে পারতো। কতজন আইনজীবী লাগবে, কতজন বিচারক লাগবে, কতজন আইনের শিক্ষক লাগবে, কতজন আইনশাস্ত্র বিশারদ লাগবে রাষ্ট্রের কি সে পরিকল্পনা আছে? থাকলে তার নিরিখেই ছাত্র ভর্তি করা যেত। কেউ কেউ বলবেন, পরীক্ষা তুলে দিলে অযোগ্য আইনজীবী তৈরি হবে।

আমার কথা একজন অযোগ্য মানুষ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করতে পারার কথা না। পাঠ্যসূচি ও পাঠ্যক্রমে কাম্য পরিবর্তন এনে আইনের সব ছাত্রকেই যোগ্য করে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করা হোক। যোগ্য করতে না পারলে ব্যর্থতার দায় সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়কেই নিতে হবে। প্রয়োজনে পেশাপ্রবেশের প্রথম দু’এক বছর প্রবেশনারি বিবেচনা করা যেতে পারে। তাতেও আশা থাকে দু’এক বছর বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জন শেষে একজন তরুণ পূর্ণ আইনজীবী হয়ে উঠতে পারবেন। এ সময়কালে বার কাউন্সিলের তত্ত্বাবধানে বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন আয়োজন থাকতে পারে, যেগুলো উৎসাহপ্রদায়ী ও মানোন্নয়নমূলক, প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী নয়। তার বদলে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা কীভাবে তার পেশাজীবনে দক্ষতা বা যোগ্যতার প্রমাণ দেয় তা অন্তত আমার বোধগম্য হয় না। না কি পুরোটাই এক মোল্লাতন্ত্রের অধীনতা স্বীকার?

উপাসনালয়ের মোল্লা-পুরুতদের খবরদারিতে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন, “খোদার ঘরে কে কপাট লাগায়, কে দেয় সেখানে তালা? সব দ্বার এর খোলা রবে চালা হাতুড়ি শাবল চালা!”

বিজ্ঞাপন

আইনজীবী হিসেবে পেশাজীবন বরণ করা আইন স্নাতকদের অধিকার হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। তাই ‘প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত’ তত্ত্বের বিরুদ্ধে উত্তীর্ণ-অনুত্তীর্ণ ভেদাভেদ ভুলে, যে কোনো বর্ষের আইনের ছাত্র নির্বিশেষে অধিকার আদায়ের লড়াই গড়ে উঠুক তীব্রভাবে।

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আরএফ

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন