বিজ্ঞাপন

মনি হায়দারের গল্পগ্রন্থ ‘জিহ্বার মিছিল’,গল্পের তরঙ্গে রক্তসাঁতার

November 9, 2020 | 9:12 pm

সৌর শাইন

কোথায় আমাদের কেন্দ্র? কেন্দ্র! কেন্দ্র বাস করে কেন্দ্রে। বুঝলাম, কেন্দ্র বাস করে কেন্দ্রে। কিন্তু কোথায় অব্যাখ্যাত কিংবা দ্রুবিভূত কেন্দ্র? কেন্দ্র বাস করে মগজে। মনে। মননে আর চারুতলায় ঘেরা দগ্ধ চৈতন্যে। আরও নির্দিষ্ট করে লিখলে, কেন্দ্র আমাদের ‘করোটি’তে, যা বলেছেন কথাসাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হক। কেন্দ্রের রঙিন বিছানায় যখন নাচের মুদ্রা পাখা মেলে, তখনই গল্পকারের করোটিতে তৈরি হয় গল্প। গল্পের রাজ্যপাটের অস্থি থেকে লিখছি-নিপাট, নির্মেদ, নির্মোহ বাংলা গল্পের সমকালীন যাদুকর, মনি হায়দার।

বিজ্ঞাপন

কেন্দ্র থেকে বিন্দু, জলকণা থেকে সিন্ধু- সৃষ্টি ও জীবনের সবখানেই সূক্ষ্ম অনুভূতির তীক্ষ্ণ বসবাস। সময়, মুহূর্তের ভাঙাগড়া, উত্থান পতন ও অনুভূতি পরস্পরের মধ্যে এক অবিচ্ছিন্ন রসায়ন সম্পর্কের সেতু তৈরি করে চলে অবিরাম। রসায়নের রূপ-রেখা-রঙ-রসের মাধুর্যে সময়ের স্রোতধারায় গল্পকার গড়ে তোলেন গল্পের বিস্ময়াকর মন্ময় ক্যানভাস। যেখানে ঠাঁই পায় অণুকাল থেকে মহাকালের বিস্তৃত নির্ণয় কলার পৃথিবী। এই কলা পৃথিবীর নির্মাতা এক কথায় সাহিত্যিকগণ। মনি হায়দার কথাকলার সচেতন বয়ন শিল্পী। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যে সুপরিচিত কথাশিল্পী ও টিভি ব্যক্তিত্ব। অবিরাম লিখে চলেছেন গল্প। গল্পই মনি হায়দারের আঁধার ও আধেয়। গত বইমেলায় মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত হয়েছে তেরোতম গল্পগ্রন্থ ‘জিহ্বার মিছিল’ । নামটাই পাঠকদের ভিন্ন সংকেত প্রদান করে। জিহ্বার মিছিল? আমাদের, মানে মানুষের জিহ্বা মিছিল করছে? চিত্রকল্প আঁকতে গেলেই শরীরে ও মনে এক ধরনের প্রলুব্ধ ভয় প্রবেশ করে। ভয় আর পাঠের তৃষ্ণায় ‘জিহ্বার মিছিল’ গ্রন্থের বারোটি গল্প পাঠ করলাম। বিচিত্র বিভঙ্গে আর দৃষ্টি প্রক্ষেপণের অভিজ্ঞায় গল্পগুলোতে পারস্পরিক সম্পর্কের জটিল থেকে জটিলতর মানচিত্র যেমন পাই, তেমন পাই ব্যক্তি জীবন থেকে রাষ্ট্রীয় অনুষঙ্গও। বিশেষ ইঙ্গিতে বৈশ্বিক উগ্র ধর্মবাদ সংক্রান্ত প্রতিকূলতাকেও স্পর্শ করেছেন গল্পগুলোতে মনি হায়দার। মানুষ, সময় ও সমাজ তার গল্পের প্রথম ও প্রধান কেন্দ্রবিন্দু। তিনি গল্পের আখ্যানে নিংড়ে নিংড়ে মানুষের মর্ম-যাদুঘরের সকল দুয়ার খুলে দেন অনায়াসে, আবার গলিত লাশের দুর্গন্ধের উপর বসাতে পারেন হৈ হুল্লোড়ের মচ্ছবও। ধীমান, শক্তিশালী কথাশিল্পী মনি হায়দারের অনন্য বৈশিষ্ট্য— তিনি চরিত্র ও আখ্যানের উপর বজায় রাখেন দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ, দিতে পারেন কুসুমে আগুনের হল্কা, ধরতে পারেন গল্পে দুরন্ত গতির ধাবমান অশ্বের লাগাম।

‘জিহ্বার মিছিল’ প্রথম গল্প ‘রক্ত মাখামাখি’। গল্পের আরম্ভ অতিপ্রাকৃত রোমাঞ্চকর ঘটনায় প্রবেশের মধ্যে দিয়ে, যা সহজে প্রধান চরিত্র অতিথির মতো বিস্ময়, মোহ ও কৌতূহল অনুভূতির উদ্রেক ঘটায়। গল্পকারের অসাধারণ প্রতীকী কারিশমায় গড়ে ওঠেছে বহুকালের প্রাচীন রাজবাড়ির রূপরেখা, যা ঘটনার ঘনঘটার কেন্দ্র বিন্দু। হঠাৎ এক রাতে কাঙ্ক্ষিত পথিকের আগমন উপলক্ষে সেই রাজবাড়ি জরাজীর্ণতা, জৌলসহীনতা ঘুচে অলৌকিকভাবে জেগে ওঠে। গল্পকারের গল্পে— “সেই রাজবাড়িতে হঠাৎ জ্বলে উঠলো আলো। রাজবাড়ির চারপাশের প্রজাসাধারণ হতবাক। কৌতূহলের বাজনার পরে কেউ কেউ এগিয়ে আসতে থাকে রাজবাড়ির দিকে।” পথিকের আগমনের চিত্রকল্প লিখেছেন এভাবে— “সূর্য অস্তপারের দিকে, লাল ম্লান আলোর সময়ে প্রধান ফটকের প্রহরী রাজবাড়ির দরজায় এক পথিককে দেখতে পেয়ে উৎফুল্ল।”

ঝলমলে প্রদীপের রোশনাই, বাদ্যের ঝঙ্কার, সুরের লহরী, সখিদের দৈহিক ছন্দ, নগ্ন নৃত্যশৈলী, নর্তকীদের যৌবন উন্মত্তা, কামপুরুষের কামনায় দীর্ঘ প্রতীক্ষা ও দেহ বিগলিত উষ্ণ নিঃশ্বাস যা নিঃসন্দেহে দক্ষ কারিগরের চিত্র প্রমাণ করে, শুধু চিত্রকল্পে নয়, সংলাপ ও মসৃণ বাক্য আরও অফুরন্ত মুগ্ধতার উৎস। বাঁকে বাঁকে প্রশ্ন জাগবে কে এই অতিথি, যিনি রাজনর্তকীর যৌবন তেষ্টা পূরণের জন্য রাজবাড়ির প্রধান ফটক থেকে অন্দর মহল পর্যন্ত বয়ে বেড়াচ্ছেন প্রায় অনাবৃত রূপসী নর্তকীদের সংবর্ধনার সোহাগ, অতঃপর স্নানের আমন্ত্রণ! এক সময় অতিথির পরিচয় মেলে তিনি আর কেউ নন, কবি জীবনানন্দ দাশ। স্নান শেষে পবিত্র কবিকে নিয়ে যাওয়া হলো প্রধান নর্তকীর পাশে। কবি ভাবতে লাগলেন, “এখন যদি দু’দণ্ড শান্তি পাই— খুন খারাবি আর পাপ ধর্মোন্মদনার দুনিয়ায়।”

বিজ্ঞাপন

বিমোহিত কবিকে ঘিরে নাচতে থাকে নর্তকীরা, আর কবির দৃষ্টি রাজনর্তকীর দিকে। তখন বুভুক্ষু কবিকে পান করানো হয় শীতল দ্রাক্ষারস। মহাশব্দে বেজে ওঠে বাদ্য, শুরু হয় যজ্ঞ। ঠিক তখন জীবনানন্দ দাশের প্রশ্ন, “এসব কী হচ্ছে?” উত্তরে আসে এভাবে গল্পকারের ভাষায়, “বীভৎস হাসেন প্রধান রাজনর্তকী, কবি আপনি প্রেম ও শান্তির বারতা নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পৃথিবীতে কি প্রেম ও শান্তি বলে কিছু আছে? নেই। আমাদের রাজ্যেও কোনো সুখ নেই, শান্তি নেই। আছে পান, পান এবং রক্তপান। হাজার বছর ধরে তোমার অপেক্ষায় কারণ তোমার রক্ত পান করবো আমরা।”

গল্পের এ চরম বাক্যে স্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে উগ্রবাদের বীভৎস সাম্প্রতিক রূপ গল্পকার বর্তমানের আয়নায় তুলে ধরেছেন শিল্পের নিপুণ এ ঝাঁজ। রেখেছেন রূপক আশ্রিত প্রশ্ন। গল্পের পরিণতিতে রাজনর্তকীর হাতের কৃপাণে দ্বিখণ্ডিত হন জীবনানন্দ দাশ। বর্ণনায় গল্পকার মনি হায়দার তুলে এনেছেন সমগ্র পৃথিবীর করুণ কাব্যিক মুহূর্তকে। “কাটা গলা আর মুণ্ডুর ফাঁক দিয়ে গর গর শব্দের সঙ্গে বের হচ্ছে রক্ত, কাব্যমণ্ডিত রক্ত, ভেজা ঘাসের রক্ত, ডাহুকের ডাকের রক্ত, হিজল আর গাঙ্গুরের জলের রক্ত, হটি বনের বর্ণযুক্ত রক্ত রক্ত রক্ত..।

অতিপ্রাকৃতের ঘোরে বন্দি পাঠককে চমকে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে গল্পের শেষ অংশ। বর্তমান বিশ্বের রক্ত মানচিত্রের খসড়া দেখিয়ে দেয় , ধ্বংসের আরেক নাম ধর্মোন্মাদনা ও উগ্রতা। মনি হায়দারের ‘রক্ত মাখামাখি’ গল্পের শেষচিত্র, “প্রধান রাজনর্তকী কৃপাণ দূরে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রক্ত নগ্ন শরীরে মাখতে লাগলেন। সঙ্গে সঙ্গে সখিরাও মাখতে লাগলেন— নগ্ন শরীরে রক্ত মাখতে মাখতে নাচতে শুরু করে সবাই মিলে। সেই রক্তনাচ এখনও চলছে, আইএস ঘোষণা দিয়েছে এই রক্ত উৎসব চলতেই থাকবে।”

বিজ্ঞাপন

হাজার বছর ধরে পথ হাঁটছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। সেই কবিকে গল্পের আখ্যানে এনে, বহুমাত্রিক দ্রাক্ষায় গল্পটিকে উপস্থাপন করেছেন মনি হায়দার— চাতুর্যের সঙ্গে, কারণ, শেষ লাইনটা পাঠ না হওয়া পর্যন্ত পাঠকের বুঝবার উপায় থাকে না, প্রকৃতপক্ষে কী মহা সর্বনাশ ঘটতে যাচ্ছে গল্পে, গল্পকারের সৃজন কলার অমিত শক্তি আর শৌর্যের ধারাপাতে।

দ্বিতীয় গল্প ‘জিহ্বার মিছিল’। এই গল্পে গল্পকার এঁকেছেন নাটকীয় ও চাঞ্চল্যকর চিত্র, যা দেশ ও সমাজের অপরাধ, অসততা ও দুর্নীতির অভিনব কিন্তু সুসজ্জিত প্রেক্ষাগৃহ। গল্পের চরিত্রগুলোর ঘটনাচক্রে রাতের ঘুম শেষে সকাল হতেই মুখ থেকে জিহ্বা হারিয়ে যায়। ফলে কথা বলতে, ভাব বিনিময় করতে সৃষ্টি হয় মহাবিপত্তি। কোনোভাবেই এ বিপত্তি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় না। মুখোশের আড়ালে কুৎসিত ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর ও প্রমোশন প্রত্যাশী লোভী পুলিশের এডিশনাল ডিআইজি, মুনাফাখোর ব্যবসায়ী, রক্তচোষা অসাধু ডাক্তার, মিথ্যুক ও চরম কপট ধর্মগুরুদের কুকর্মের কাবিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘জিহ্বার মিছিল’। সবাই জিহ্বাহীন চরম অসহায়। জিহ্বারা মিছিলে মিছিলে সমবেত হয়েছে সত্যমাঠে। জিহ্বার মালিকেরা নিজেদের জিহ্বা ফেরত পেতে মরিয়া হয়ে ছুটে এসেছে সত্যমাঠে। কিন্তু জিহ্বারা ফিরে যেতে নারাজ। জিহ্বারা নানা ভাগে ভাগ হয়ে তৈরি করেছে মহাসমাবেশ, সেখানে জিহ্বার গোঁড়া থেকে পড়ছে টাটকা লাল রক্ত। বিদ্রোহী জিহ্বারা জানাচ্ছে প্রতিবাদ, প্রতিবাদের ভাষ্যে প্রকাশ পাচ্ছে মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সমাজজীবীদের নোংরা কদর্য পাশবিক রূপ। যা আমরা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে চারপাশে দেখি, কেবল কী দেখি, আমরাও শিকার হই এইসব অভিনব শিকারিদের শিকারে, গল্পকার মনি হায়দার সৃষ্টিশীল শিল্পকলায় নান্দনিক প্রতিবাদ কৌশলে ভয় জাগানিয়া আখ্যানে তুলে ধরেছেন গল্পে। গল্পের শেষাংশের প্রকাশ,‘জিহ্বাহীন আত্মপ্রতারক লোভী মিথ্যুক ধর্ষক মুনাফাখোর মজুতদার প্রাণীগুলো মুমূর্ষু বেদনায় দাঁড়িয়ে থাকে, যদি জিহ্বারা ফিরে আসে। কিন্তু জিহ্বারা মিছিল করে সত্যমাঠ পার হয়ে চলে যাচ্ছে দূরে, দূরে, বিরামহীন কোনো দেশে..। যে দেশ থেকে ফিরে আসে না কেউ। গল্পটি পাঠ করার পর একদিকে আতঙ্কে যেমন কেঁপে উঠতে হয় আবার প্রতীকায়িত গল্পের মোড়কে গোটা সমাজভূমির রাঙতা মাখানো মুখগুলো নতুন করে দেখতে পাই, তখন বুঝতে পারি, গল্পও কতোটা বাস্তব ম্যাজিক হয়ে উঠতে পারে, হয়ে উঠতে পারে তীক্ষ্ম তরবারি, হানতে পারে সাপলেজা মাছের লেজের চাবুক মনি, হায়দারের ‘জিহ্বার মিছিল’ গল্প পাঠে প্রমাণ পাই আরেক বার।

‘জিহ্বার মিছিল’ গল্পগ্রন্থের তৃতীয় গল্প— ‘একটি অরক্ষিত গল্প’। গল্প অরক্ষিত! কেমন অশরীরী লাগে। কি বলতে চেয়েছেন গল্পকার মনি হায়দার এই গল্পে? পাঠকের প্রতি গল্পকারের চমৎকার সংলাপের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে এই ঢাকা শহরের রামপুরার একটি গলির রাত জাগা এক পাহারাদার ও স্ত্রীর পরিণতির মর্মান্তিক আখ্যান। গল্পকারেরা তো সমাজ বা রাষ্ট্র বিচ্ছিন্ন কেউ নয়। গল্প গল্পকারদের মগজে কিভাবে তৈরি হয়? সমাজ ও রাষ্ট্রের গণসর্বনাশের মানচিত্র থেকে গল্পের গ্রাম আসে, এবং গল্পকার নিজের মননের কারখানায় লালন করে গল্পে শব্দের জালে প্রাণ দেন। ‘একটি অরক্ষিত গল্প’র গল্পও মনি হায়দার পেয়েছিলেন এই নগরের মানচিত্র থেকে। পাঠ করুন, দেখবেন এই গল্পটা আপনার, আমার, গোটা শহরের এবং এক সময়ে সমগ্র বাংলাদেশের।

গ্রাম পর্যায় থেকে অত্যাচারিত হয়ে শহরে আসা লোকটা ঢাকার রামপুরার একটি রাস্তার নাইট গার্ড হিসেবে কাজ পায়। পায় থাকার এক টুকরো ঘরও। সঙ্গে থাকে সুন্দরী স্ত্রী কুলসুম। চমৎকার ভালোবাসার বন্ধনে আবদ্ধ জীবন। সারারাত পাহারা দিয়ে পাহারাদার দিনে ঘুমায়। কখনো কখনো স্ত্রীর সোহাগ পেতে মাঝ রাতে পাগলের মতো বিছানায় ছুটে যায়। এভাবেই চলছিল পাহারাদার আর কুলসুমের সংসার। এক কুচক্রীমহল পাহারাদারকে নানাভাবে প্রলোভন দেখায়, একটি ধনাঢ্য বাড়িতে ডাকাতির কাজে সাহায্য করার জন্য। কিন্তু পাহারাদার সততায় অটল থেকে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলাফল, জীবন থেকে কেড়ে নেওয়া হয় প্রিয় স্ত্রী কুলসুমের প্রাণ। প্রতি সকালের মতো বাসায় ফিরে আসে পাহারাদার, ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করে ধর্ষণের শিকার কুলসুমের ক্ষতবিক্ষত দেহ! ‘একটি অরক্ষিত গল্প’-এর করুণ চিত্র যে কোনো মানুষের দরজায় ভিন্ন প্রশ্ন নিয়ে দাঁড়াবে। প্রশ্ন তুলবে, আমরা কোন সমাজে বাস করছি? আদৌ কি বাস করছি? বর্তমান সময় বয়ে বেড়াচ্ছে অসংখ্য কুলসুমের প্রাণহীন শরীর, দেশে বিদেশে। আরব দেশের পুরুষেরা বাংলাদেশ থেকে যাওয়া দরিদ্র নারীদের সঙ্গে যা করছে, এক কথায় ভয়াবহ। কিন্তু কে কার হিসেব রাখে? এই গল্পের কুলসুমেরও হিসাব কেউ রাখবে না। গল্পকারের গল্প নির্মাণের উদ্দেশ্য নিঃসন্দেহে উত্তরণের পথে সংকল্প। প্রশ্ন, সেই সংকল্প কখনো কি সত্য পরিণত হবে? গল্পের শেষ বাক্যগুলো, “পাহারাদার এখনও রামপুরার ওয়াপদা রোডের উপ-গলি পাহারা দেয়। বাসার দরজাটা এখন আর বন্ধ থাকে না, দিন রাত থাকে খোলা। কারণ জানে, কুলসুম মারা যাওয়ার পর পুরো বাংলাদেশটাই অরক্ষিত, খোলা। সেখানে ছোট ঘরটায় তালা দেওয়া আর না দেওয়া সমান।”

বিজ্ঞাপন

‘দড়ি’ গল্পে চিত্রিত হয় এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মুহূর্ত। গুলিস্তান থেকে কেনা দড়ি, যখন কথা বলা শুরু করে, তখন দড়ির মহা বিড়ম্বনায় পড়েন গোলাম কবির। ঘরে-বাইরে তাকে বার বার ভয়াবহ উদ্বেগ ও হেনস্থার শিকার হতে হয়। ‘দড়ি’ কখনো সাপ হয়ে ওঠে তার মৃত্যুকে কাছে ডাকে। এই নাজুক মানসিক পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য গোলাম কবির দড়িটা ফেলে দেয়। কিন্তু সেখান থেকেও বাঁচার উপায় হয় না। শেষ মুহূর্তে দড়ির সাথে স্ত্রীর আত্মহত্যার সম্পর্ক গড়ে ওঠে, যা গল্পে আচ্ছন্ন পাঠক মনে ধোঁয়াচ্ছন্ন প্রশ্নের উদ্রেক ঘটানো স্বাভাবিক।

‘ন্যাশন ৫৭০’ এক হৃদয়স্পর্শী বিস্ময় ও তীব্র বিস্ময়ানুভূতির রাজনৈতিক বেদনায় ভারাক্রান্ত গল্প। বাঙালির চির দুঃখ-বেদনা ও কলঙ্ক ১৯৭৫ সালের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে, বঙ্গবন্ধুকে এই গল্পের আখ্যানে গড়ে তুলেছেন মনি হায়দার, দরদ ভালোবাসা আর প্রগাঢ় শ্রদ্ধার বুননে। ‘ন্যাশন ৫৭০’ গল্পের সূচনা সদ্য স্ত্রী বিয়োগ হওয়া এক ভিনদেশি আগন্তুকের কাঙ্ক্ষিত সাবান খোঁজার মাধ্যমে। প্রিয়তম স্ত্রীর অন্তিম ইচ্ছে অনুযায়ী, শব স্নানের জন্য সুগন্ধি সাবানের অনুসন্ধানে আগন্তুক বর্ষায় নৌকায়-ভেলায়-গরুর গাড়ি- ঘোড়ার গাড়ি চড়ে হন্যে হয়ে পথ চলতে থাকেন। বাজারের ছোট্ট কুটির থেকে শুরু করে হাট-গঞ্জ-শহর থেকে শহর এমনকি রাজধানী শহরেও তিনি সাবানের জন্য ছুটে বেড়ান। কিন্তু তিনি যেখানেই যাচ্ছেন, পরিবর্তিত প্যাকেটে কেবল একটি সাবানই খোঁজে পাচ্ছেন, ‘সাবান ৫৭০’। ৫৭০ সাবানের চেয়ে ভালো সাবান কোথায় পাওয়া যায় প্রশ্ন করে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন গ্রাম-শহরের প্রান্তরে, কিন্তু মিলছে না ৫৭০ সাবানের চেয়ে ভালো কোনো সাবান। কারণ কী? উত্তর জানার জন্য তাকে যেতে হয় জ্ঞানবৃক্ষের কাছে। জ্ঞানবৃক্ষ জানায়, এক মহান জাতির জনকের পরিচয় ও করুণ ইতিহাসের ঘটনা। যে ইতিহাসে ঠাঁই করে নিয়েছে ৫৭০ নামের পবিত্র সাবান। অতঃপর আগন্তুক এ সাবানটিকেই বেছে নেয় তার প্রিয় স্ত্রী, প্রিয় প্রেমিকার শেষ ইচ্ছা পূরণের জন্য। গল্পকার মনি হায়দার লিখেছেন, “কুর্নিশ করে বেরিয়ে গেল আগন্তুক দৃপ্ত পায়ে। জ্ঞানবৃক্ষ এস্রাজ বাজাতে শুরু করলেন শামসুর রাহমানের অমর কবিতাকে ধারণ করে, নিহত জনক আগামেনন শায়িত আজ..।”

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে চিরস্মরণীয় একটি গল্প লিখেছেন মনি হায়দার। সামান্য একটা সাবানকে প্রতীকে রেখে এমন গল্প সেই লিখতে পারে, যার চৈতন্যে বঙ্গবন্ধুর অধিবাস থাকে সব সময়ে। আর আমরা তো জানি, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু সমার্থক। ‘ন্যাশন ৫৭০’ গল্পে মনি হায়দার স্মরণীয় দক্ষতায় বঙ্গবন্ধুকে শিল্পিত আবেগে গল্পের আবেগে এঁকেছেন পরম শ্রদ্ধায়।

মনি হায়দারের জিহ্বার মিছিল গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোর সৌন্দর্য, চিত্রকল্প, বর্ণনা কৌশল, চমৎকার বাক্য, গল্পের গল্প, চরিত্র চিত্রণ সব মিলিয়ে পাঠকের কাছে ভিন্ন চিন্তা ও অনুভূতির সঞ্চার করবে। জায়গার অভাবে ‘জিহ্বার মিছিল’ গল্পগ্রন্থের বাকী গল্পগুলোর বিশ্লেষণ করা গেলো না। কিন্তু পাঠকেরা উপরের আলোচনা থেকেই বুঝে নিতে পারবেন, শক্তিশালী কথাসাহিত্যিক মনি হায়দারের গল্প অভিলাষ ও যাত্রার ঠিকুজি। মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত মনি হায়দারের ‘জিহ্বার মিছিল’ গল্পগ্রন্থের প্রচ্ছদ ‘অস্তিত্ব’, ‘জয়বাংলা’ ও ‘ন্যাশন ৫৭০’ গল্পত্রয় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধকালীন একটি পরিবারে যখন পাকিস্তানি মিলিটারিরা এসে হানা দেয় তখনকার সংকটটি তৈরি হয় তা ‘অস্তিত্ব’। ‘অস্তিত্ব’ গল্পে খবিরউদ্দীনের ছেলে মুক্তিযুদ্ধে যায় আর তার সন্ধান পেতে মেজর দীদার কর্মকর্তাদের নিয়ে এসে হানা দেয় বাড়িতে। শেষ পর্যন্ত খবিরউদ্দীনের চোখের সামনেই তুলে নিয়ে যায় কন্যা লায়লাকে। যেন খবিরউদ্দীন আশা করেন, পুরো ঘটনাটিই যেন একটি নাটকের মঞ্চায়ন কিন্তু শেষমেশ বাস্তবতা নিষ্ঠুর রূপেই মঞ্চায়িত হয়।

‘রক্তাক্ত কাঁটাতার’ গল্পের প্রশ্নটি মূলত যুদ্ধ ও এর ফলাফলের যৌক্তিকতা নিয়ে। জসীমউদ্দীন নামের এক প্রবীণ মানুষ তিনটি যুদ্ধ করেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় যুদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে। তৃতীয় যুদ্ধ তেইশ বছর পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তিনটি যুদ্ধের গৌরবময় ভূমিকা পালনস্বরূপ মেডেলের মূল্যসংক্রান্ত সকল চিন্তাভাবনা ধুলোয় লুটিয়ে পড়ে যখন তিনি দেখতে পান ফেলানীকে আজও সীমান্তে ভারতের সীমান্তরক্ষীর গুলিতে কাঁটাতারে ঝুলতে হয়। এবং পিতাকে কন্যার তিল তিল সেই মৃত্যু দেখতে বাধ্য করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষীরা। জসীমউদ্দীনের প্রশ্ন, এতসব যুদ্ধের ফলাফল কি ফেলানীদের কাঁটাতারে ঝুলন্ত রক্তাক্ত দেহ? গল্পের শেষে আমরা দেখতে পাই, রাজনৈতিক সত্য উচ্চারিত হয়েছে চরিত্রের মাধ্যমে গল্পকারের গল্পে— “জগতের সকল যুদ্ধই একটা প্রবল প্রতারণা। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে হয়তো কারো রাজত্ব প্রতিষ্ঠা পায়, কিন্তু আপনার মতো সাধারণ দরিদ্র বিপন্ন মানুষের কিছুই হয় না।” গল্পের চরিত্র জসীমউদ্দীন তিনটি যুদ্ধে অর্জিত যুদ্ধের মেডেলগুলো রাস্তায় বিছিয়ে রাখেন আর চোখের জল হয়ে উঠে রক্তের ফুল। ফেলানীকে কেন্দ্র করে গল্পটি গোটা মাবন সভ্যতার পক্ষ থেকে যথার্থ শিল্পিত প্রতিবাদ।

‘একটা ছবির গল্প’ মধ্যবিত্ত পরিবার সংকট অথবা একজন চরিত্র জামীর জীবন সংগ্রাম কেন্দ্র করে আবর্তিত। জীবন সংগ্রামের সাথে জড়িত লুকায়িত প্রেমের অকথিত বেদনা আর হাহাকার বোধ। ‘সমুদ্র সঙ্গম’ ও ‘মধ্যবয়সের প্রেম’ দুটি গল্পই পরকীয়া নিয়ে। পরকীয়া প্রশ্নটি যাচাই করা হয়নি গল্প দু’টোয় বরং গল্পকার মনি হায়দার দেখিয়েছেন প্রেমে মানুষের তীব্র আবেগীয় সংকট। ‘সমুদ্র সঙ্গম’ গল্পটিতে রাজন-কণার প্রেমের বিয়ে। ব্যবসার কারণে বিদেশে থাকতে হতো মাঝে মধ্যে। কিন্তু এটুকুতেই কখন কণার জীবনে প্রবেশ করে প্রতিবেশী হিমেল। শেষে আমরা দেখি, রাজন কণার উপর প্রতিশোধ নিতে কক্সবাজার সৈকতে কণাকে মেরে ফেলবার পরিকল্পনা করে। পাঠকেরা যখন নির্জন সমুদ্র সৈকতে সুন্দরী একজন নারীর মৃত্যু দেখতে প্রস্তুত হই, তখন গল্পকার মনি হায়দার পাঠকদের জন্য নিয়ে আসেন ভিন্নদৃশ্য কল্প। বিশাল সমুদ্রের উত্তাল জলরাশির তরঙ্গ আর কণা বিপন্ন মুখ দেখে রাজন, কণাকে হত্যা করে না, প্রতিশোধ নেয় অন্যভাবে। ফলে গল্পটি পাঠকদের কাছে নতুন এক পরিপ্রেক্ষিতে স্থির থাকে। প্রেমের জায়গায় মানসিক দ্বন্দ্ব আরও তীব্র হয় যখন আমরা পাঠ করি গল্পের শেষ অংশ, “কণার বিষণ্ণ বিপন্ন বিধ্বস্ত মুখের উপর দিয়ে রাজন তাকায় সফেদ সমুদ্রের দিকে। হঠাৎ সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে নিজেকে সম্রাটের মতো লাগে। আবার নিজেকে ক্ষণস্থায়ী ঢেউয়ের মতোও মনে হয়। বিশাল এই সমুদ্রের জলে কতো পাপ কতো অনাচার কতো আবর্জনা ছড়িয়ে আছে। সমুদ্রের বিশালতার সামনে নিজেকে খুব ক্ষুদ্রতম কীট মনে হলো! নিজের প্রতি উল্টো একটা ধিক্কারও জন্মালো, নিশ্চয়ই আমার মধ্যে কোনো শূন্যতা আছে, যা আমি জানি না। শূন্যতার সেই গোপন গলি দিয়ে কণার জীবনে প্রবেশ করেছে হিমেল। আমিই ব্যর্থ…। একজন ব্যর্থ মানুষের কোনো অধিকার কি আছে, সমুদ্রের অতল জলে কণাকে বিসর্জন দেয়ার! কণাকে ছেড়ে দেয় রাজন, যাও তুমি মুক্ত। কিন্তু তোমার সঙ্গে এই জীবনে আমার দেখা হোক আমি আর চাই না। দ্রুত লোকালয়ের দিকে হাঁটতে থাকে রাজন। পেছনে পড়ে থাকে কণা, সমুদ্র আর সমুদ্র তরঙ্গের শো শো আওয়াজ!

কক্ষ বিচ্যুত কণার জন্য কি করুণা জাগে না? গল্পকার মনি হায়দার কেন অপ্রতিরোধ্য গল্পকার? এ জন্য যে কক্ষচ্যুত কণার জন্য পাঠকের জমিনে করুণা জাগাতে পারেন।

‘মধ্যবয়সের প্রেম’ হাফিজুর রহমানের মধ্যবয়সের এক পশলা বৃষ্টির মতো প্রেমে পড়বার গল্প। গল্পটি পরকীয়ার জটিল জলের অসাধারণ কাঁটা কম্পাস। মানুষের সাধারণ আবেগে জারিত প্রেমের ক্ষেত্রে নানা সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রূপে আত্মপ্রকাশের গল্প তা নির্ণয় করবার দায়িত্ব পাঠকের। গল্পকার শুধু চিত্রটুকুর বর্ণনা করে গেছেন দারুণ দক্ষতায়। স্বামীর অনুপস্থিতিতে মনিকাও কি চায়নি শূন্যতাটুকু দূর করতে? হাফিজুর রহমানকে কাছে টানতে? নাকি মনিকা সচেতন কৌশলে হাফিজুর রহমানকে কেবল পরিস্থিতির শিকার বানাতে চেয়েছে? নাকি মণিকা নারীর চিরায়ত লাবণ্যের লবণে একজন মধ্যবয়সী হাফিজুরকে নিয়ে একটু খেলে তিনটু মজা লুটেছে? প্রশ্ন তৈরি হয় গল্পটি পড়তে পড়তে। আবেগীয় সংকটের চিত্রায়ন হিসেবে গল্পটি সার্থক।

‘জায়গা জমিন’ গল্পটি আমাদের বাস্তব সমাজের একটি মুমূর্ষু খণ্ডচিত্র। এই গল্পটি শুরু করবার সময়ে অন্যকিছু মনে হলেও গল্পের শেষে সেই ‘অন্যকিছু’ দাঁড়ায় একবারে ভিন্ন অণুতে। গল্পকার মনি হায়দার অনন্য দক্ষতায় গল্পটাকে মোচড় দিয়ে পাঠকদের দাঁড় করিয়ে দেন নিজের সামনে। মানুষের সর্ম্পকের কাঠামোর মধ্যে জমি টাকা পয়সা অন্যতম নিয়ামক। দেড় বিঘা জমি ভাই ভাই সম্পর্কের ছেদ টানে আর জড়িত হয়ে পড়ে একটি পুরো পরিবার সর্ম্পকের সুইঁসুতো থকে ছিটকে পড়ে, তারই নির্মম আখ্যান। সম্পর্ক যদিও ভাঙে, অখণ্ড থেকে যায় যে সংশ্লিষ্ট স্মৃতিসমূহ, সেই স্মৃতি এই গল্পের শ্রেষ্ঠ আরতি। জমিজমার স্থায়িত্ব কতটুকু? লোভ, কূট কৌশল ধরণের কালো পোকাগুলোতো আমাদের সমাজে চারপাশেই ঘুরে বেড়ায়। সোহাগ রহমান আসলে সমাজের একটা বড় ভুক্তভোগী অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন।

মনি হায়দার আমাদের কালের ছোটগল্পের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কারিগর। শাশ্বত বাংলার মাটি আর জলের মানচিত্র আঁকেন গল্পের তরঙ্গে তরঙ্গে। একজন গল্পকার গল্পে কতটা নিবিষ্ট, কতোটা নিবেদিত— গল্পকার মনি হায়দার উদাহরণ। তোরোতম গল্পগ্রন্থ ‘জিহ্বার মিছিল’-এ বারোটি গল্পই একেক মাত্রায় উজ্জ্বল, অবিনশ্বর। পৃথিবীর সমস্ত গল্পই বলা হয়ে গেছে, এ সত্য হতে পারে না। বলা সম্ভব নয়। প্রতিদিন জগতে নতুন মানুষ আসে, জন্ম হয় নতুন গল্পের আখ্যান. শত শত লাখ লাখ কোটি কোটি। কোটি গল্পের ধারণা শেষ হবারও নয়। অসংখ্য কথা অসংখ্যভাবে বর্ণিত হতে হতে তৈরি হচ্ছে গল্পের মিছিল। মনি হায়দারের ‘জিহ্বার মিছিল’ সেই গল্পের মহামিছিলের উৎফুল্ল অংশ। ইতিহাসেরও অংশ তো বটেই।

প্রচ্ছদ শিল্পী: ধ্রুব এষ।

সারাবাংলা/এসবিডিই/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন