বিজ্ঞাপন

ঝুলে আছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানি

February 4, 2021 | 2:13 pm

কামরুল ইসলাম ফকির, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ের পর রাষ্ট্রপক্ষের করা রিভিউ আবেদনের শুনানি ঝুলে আছে। আইনি প্রক্রিয়ার শেষ ধাপে এসে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ ও ‘জনস্বার্থমূলক’ এ মামলাটি থেমে আছে।

বিজ্ঞাপন

রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে তারা যে কোনো সময় শুনানি শুরু করবেন। কিন্তু গত তিনবছর ধরে এভাবেই ঝুলে আছে সংবিধান সংশ্লিষ্ট মামলাটি। বিষয়টির সুরাহা না হওয়ায় সরকার নতুন করে সংবিধান পুনর্মুদ্রণও করছে না।

রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তারা বলছেন, খুবই দ্রুতই তারা রিভিউ শুনানির উদ্যোগ নেবেন। তবে রিটকারীদের অভিযোগ সরকার ইচ্ছা করেই মামলাটির শুনানি শুরু করছে না। আর জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা মনে করেন, ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদন খুব দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেওয়া উচিত।

২০১৭ সালের ৩ জুলাই সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেন আপিল বিভাগ। ওই রায়ে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেওয়া হয়। পরে একই বছরের ১ আগস্ট এ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

বিজ্ঞাপন

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় পাঁচ মাস পর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ।

২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই আবেদন দায়েরের পর কেটে গেছে তিন বছরেরও বেশি সময়। রিভিউ আবেদনটি এখনও আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায় আছে।

এর আগে, ২০১৪ সালে অসামর্থ্যতা ও অযোগ্যতার কারণে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিয়ে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীটি জাতীয় সংসদে পাস করা হয়।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে এ ক্ষমতা ছিল।

এরপর সংশোধনীটির বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে ৯ জন আইনজীবী রিট দায়ের করেন। পরে হাইকোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে সংশোধনীটি বাতিল ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে রায় দেন। ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে।

এরপর ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ২০১৭ সালের ৩ জুলাই বহাল রাখে আপিল বিভাগ। ওই রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুনর্বহাল করা হয়। পরে পুরো রায়টির রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদনে করা হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও আবেদনটির শুনানি আর হয়নি।

সম্প্রতি দেশের বিশিষ্ট ৪২ জন নাগরিক নির্বাচনসংক্রান্ত গুরুতর অসদাচরণ ও আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের অধীনে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে তদন্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তারা। কিন্তু দেশে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল আছে কিনা সেটা নিয়ে নতুন বিতর্ক দেখা দেয়।

বিজ্ঞাপন

এ ধরনের আইনি বিতর্ক এড়াতে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনটি দ্রুত নিষ্পত্তির তাগিদ দিয়েছেন।

ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে করা রিভিউ আবেদনের শুনানির বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘ষোড়শ সংশোধনীসহ আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মামলা রয়েছে, যেগুলো শুনানির অপেক্ষায় আছে। আমরা খুব শীঘ্রই এসব মামলা শুনানির জন্য উদ্যোগ নেব।’

তবে সুনির্দিষ্ট দিন-তারিখের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে দিন তারিখ বলতে পারব না। আমরা দ্রুতই শুনানি করা জন্য চেষ্টা করছি।’

তবে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল পুর্নবহাল আছে উল্লেখ করে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল চেয়ে করা রিটকারীকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ সরাবাংলাকে বলেন, ‘রায় হওয়ার পর ওই রায় বাতিল না পর্যন্ত ওই রায় বহাল থাকবে। রায়ের মধ্যে বলা আছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রিস্টোর (পুর্নবহাল) করা হলো। রায় হওয়ার পরে সেই রায় যতক্ষণ পর্যন্ত বাতিল না হবে, ততক্ষণ সে রায় বহাল আছে। রিভিউ করার কারণে তো রায় বাতিল হয়ে যায়নি। আর রায়ের মধ্যেই বলে দেওয়া আছে যে, এটা সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল রিস্টোর (পুর্নবহাল) করা হলো। রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল কার্যকর করার নির্দেশনা আছে। এর ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল জীবিতই আছে।’

রিভিউ শুনানির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগ যে রায় দিয়েছেন সেটিই কার্যকর। সরকার রিভিউয়ের উদ্যোগ নিলে শুনানি হবে। রিভিও শুনানির দায়িত্ব সরকারের।’

এদিকে ষোড়শ সংশোধনী মামলার রিভিউ শুনানির উদ্যোগ না নেওয়াটাকে বিচারহীনতার অংশ উল্লেখ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী মামলা দ্রুত শুনানি করা উচিত। এটি সরকারের দায়িত্ব। সরকার শুনানির উদ্যোগ না নেওয়াটাকে আমরা বিচারহীনতার অংশ হিসেবে মনে করতে চাই। কারণ রাষ্টের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা মামলা দীর্ঘদিন ধরে এভাবে ঝুলে থাকতে পারে না। দ্রুত রিভিউ শুনানির জন্য সরকারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ মামলাটি গুরুত্বপূর্ণ ও জনস্বার্থমূলক মামলা। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের উচিত মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা। মামলাটি দ্রুত নিস্পত্তির জন্য প্রয়োজনে প্রধান বিচারপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করা যেতে পারে। কারণ এটা আমাদের জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট একটি মামলা।’

২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। এতে বিচারক অপসারণের ক্ষমতা ফিরে পায় সংসদ। বিলটি পাসের পর একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশিত হয়।

পরে সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ৯ আইনজীবী। প্রাথমিক শুনানির পর হাইকোর্ট ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল দেয়। রুলে ওই সংশোধনী কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়।

পরে ২০১৬ বছরের ৫ মে হাইকোর্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয়। ওই বছরের ১১ অগাস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়।

তিন বিচারকের ওই বেঞ্চের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ বলে রায় দেন। অন্য বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল তাতে ভিন্নমত জানিয়ে আলাদা রায় দেন।

হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করলে ২০১৭ সালের ৮ মে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানি শুরু হয়। সব মিলিয়ে ১১ দিন রাষ্ট্র ও রিট আবেদনকারীর বক্তব্য শোনেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাসহ সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকেরা।

গুরুত্বপূর্ণ মামলাটির শুনানিতে আপিল বিভাগ আদালতের বন্ধু (অ্যামিকাস কিউরি) হিসেবে ১০ জন জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। তাদের মধ্যে কামাল হোসেনসহ নয়জনই সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের পক্ষে অর্থাৎ ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে মত দেন।

কামাল হোসেনের সঙ্গে একই মত পোষণকারীরা হলেন টি এইচ খান, এ এফ এম হাসান আরিফ, এম আমীর উল ইসলাম, রোকনউদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী, এম আই ফারুকী ও আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া। অন্যদিকে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনের পক্ষে অবস্থান জানান শুধু আজমালুল হোসেন কিউসি।

আদালত মোট ১২ জন আইনজীবীকে অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে নিয়োগ দিলেও তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রফিক-উল হক ও শফিক আহমেদ মতামত দেননি।

তাদের বাইরে ‘ইন্টারভেনার’ হিসেবে সংবিধানের এই সংশোধনের পক্ষে যুক্তি দেখান সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য আবদুল মতিন খসরু।

পরে সাত বিচারকের আপিল বিভাগ ৩ জুলাই যে রায় দেয়, তাতে হাইকোর্টের রায়ের কিছু পর্যবেক্ষণ এক্সপাঞ্জ (বাদ দিয়ে) করে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল ‘সর্বসম্মতভাবে’ খারিজ করে দেওয়া হয়। ওই বছরের ১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।

পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের প্রায় পাঁচ মাস পর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চেয়ে আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। ৯০৮ পৃষ্ঠার এই রিভিউ আবেদনে রাষ্ট্রপক্ষ মোট ৯৪টি যুক্তি তুলে ধরে। রায়ে দেওয়া কিছু আপত্তিকর পর্যবেক্ষণকে অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে তা বাতিলের দাবি জানায়। রিভিউ আবেদনে পুরো রায়টি রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) চাওয়া হয়। কিন্তু দীর্ঘ তিন বছরেরও বেশি সময় কেটে গেলেও রিভিউ আবেদনটির শুনানি আজও শুরু হয়নি।

সারাবাংলা/কেআইএফ/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন