বিজ্ঞাপন

অনলাইনে ঘরে তৈরি খাবার- নিশ্চিন্ত হোম ডেলিভারি

March 24, 2018 | 2:00 pm

রাজনীন ফারজানা ।।

বিজ্ঞাপন

রান্নাবান্না করতে ভালো লাগেনা কিংবা কাজের চাপে রান্নাঘরে ঢুকতে ইচ্ছা করেনা অনেকসময়। আবার সাপ্তাহিক আড্ডায় কিছু বন্ধুকে ডেকেছেন দুপুরের খাবার খেতে। বন্ধুদের সাথে গল্প করবেন নাকি রান্নাঘরেই কাটাবেন! এদিকে বন্ধুদের ঘরোয়া খাবারই খাওয়াতে চান। কী করবেন?

আবার কাজের চাপে অনেকেই হয়ত সারাদিনে একটা স্যান্ডুইচ বা বার্গার খেয়ে দিন কাটান। ঝামেলা এড়াতে অনেকেই দুপুরের লাঞ্চ হিসেবে খেয়ে থাকেন এক প্যাকেট বিরিয়ানি বা ফ্রায়েড রাইস। অফিস টাইম, ট্রাফিক জ্যাম সবকিছু মিলিয়ে দিনের অধিকাংশ সময় ঘরের বাইরে কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকেই। এসব ডামাডোলে সবচাইতে যেটা মিস করে মানুষ তা হল ঘরের খাবার। তাই খুব দ্রুত সহজে রান্না করা যায় এমন খাবারেই অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে এখনকার ব্যস্ত প্রজন্ম। শাক, ভর্তা, নানারকম মাছ বা মাংসের স্বাদ তো ভুলতেই বসেছে অনেকে।

যদি পুঁইশাক দিয়ে চিংড়ি মাছ খেতে চান কিংবা ঘরে তৈরি সমুচা তাহলে আপনার নিজেকেই করতে হবে অথবা এমন রেস্টুরেন্ট খুঁজে খুঁজে বের করতে হবে যেখানে এগুলো পাবেন।

বিজ্ঞাপন

অথচ নানারকম ভর্তা, সবজি পাওয়া যায় এমন রেস্টুরেন্ট হাতে গোনা। আর সেগুলোতে ঘরোয়া রান্নার স্বাদটাও ঠিকভাবে পাওয়া যায়না। আবার রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাওয়ার ঝামেলাও কম না। তাই বলে কি আমরা স্বাস্থ্যকর ঘরোয়া মজাদার খাবার পাবোনা?

এসব ঝামেলা যদি মিটে যায় মাত্র একটা ক্লিকে, তবে কেমন হয়? যদি অনলাইনেই অর্ডার দেয়া যায় ঘরের তৈরি নানারকম দেশি খাবার, নাস্তা, আচার বা মিষ্টি, আর তা যদি সময়মত হোম ডেলিভারি পাওয়া যায়, তবে ব্যাপারটা কেমন হয়?

খুব অভিনব অবশ্য নয় ইদানিং। বেশ কিছুদিন ধরেই অনলাইনভিত্তিক দেশি খাবার সরবরাহের ব্যবসা জমে উঠেছে। আর এই ব্যবসাগুলোর হাল ধরে আছে যারা তারা অধিকাংশই নারী।

বিজ্ঞাপন

দেশি খাবাদাবারের প্রতি আমাদের টান বুঝতে পেরেই ঘরে বসেই খাবার তৈরি করে তা হোম ডেলিভারি দিচ্ছেন তারা। অনলাইনভিত্তিক বলে এতে সাড়াও মিলছে প্রচুর। এই ফুড সার্ভিসের সবচেয়ে ভাল দিকটি হল, খাবারটি তৈরি হচ্ছে বাড়িতেই এবং ঘরোয়া পরিবেশে। যারা এ ধরনের ফুড সার্ভিস ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের অধিকাংশেই মহিলা এবং তারা ঘরে বসেই নিজের রান্নাঘরেই বড় বড় খাবারের অর্ডার নিচ্ছেন এবং সময়মত মানসম্মত খাবার ডেলিভারি দিয়ে ক্রেতাদের সন্তষ্টি অর্জন করছেন।

সাধারণত এসব ফুড সার্ভিস যারা দেন তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে পেইজ খুলে নেন। সেখানে খাবারের ছবি, পরিমাণ আর দামসহ পোস্ট দেওয়া হয়। কীভাবে খাবার অর্ডার দেবেন তাও লেখা থাকে, দেওয়া থাকে ফোন নাম্বারও।

পেইজে দেওয়া নাম্বারে ফোন দিয়ে নিজের চাহিদামত খাবারের অর্ডার দিতে পারেন যে কেউ।

এ ধরনের ফুড সার্ভিস ব্যবসায় জড়িত কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা গেল মূলত কর্মজীবী মানুষই তাদের ক্রেতা। আবার অনেকেই নিজেদের বাসার জন্য বা আত্মীয়স্বজনের কাছে পাঠাতে এসব খাবার অর্ডার করেন। আসুন জেনে নেই এমন কিছু জনপ্রিয় অনলাইন ফুড সার্ভিসের কথা।

বিজ্ঞাপন

হেবাং

খাগড়াছড়ির প্রিয়াংকা চাকমা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে প্রায়ই বন্ধুদের আদিবাসীদের নিজস্ব খাবার রান্না করে খাওয়াতেন। কম তেল মশলায় রান্না করা স্বাস্থ্যকর সেই খাবার ভীষন পছন্দ করতেন তার বন্ধুরা। পরে তাদেরই অনুপ্রেরণায় ফেসবুকে হেবাং নামে পেইজ খুলে খাবার অর্ডার নিতে শুরু করেন। হেবাং হল চাকমাদের রান্নার এক ধরণের বিশেষ প্রক্রিয়া।

হেবাংয়ের কিছু জনপ্রিয় খাবার হল চিকেন ঝাল মুরগি, চিংড়ি, মাছ বা চিকেন মরিচ ভর্তা, কলাপাতায় শুটকি ও চিকেন, ফ্রেঞ্চ বীনের বিচি ডাল, চ্যাপা শুটকি ভর্তা, চিকেন ঝাল কিমা, শামুক ফ্রাই, শুটকি হেবাং, শুটকি ফ্রাই, শুটকি ভুনা, বিফ হেবাং, ডিম হেবাং, কাকড়া ভুনা বা কাঁকড়া পিষানো ইত্যাদি।

খাবার অর্ডার, রান্না, ডেলিভারি মিলিয়ে একা সবকিছু করা সম্ভব না। এ ব্যাপারে প্রিয়াংকা পরিবারের পূর্ণ সহযোগিতা পান। তবে লোকবল কম থাকায় সব অর্ডার কুলিয়ে উঠতে পারেন না অনেকসময়।

চাকমা জাতিগোষ্ঠীর খাবারকে সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার মহৎ এই উদ্যোগের ভোক্তাও কম না এখন। বিশেষত তরুণরা আজকাল ভিন্নধর্মী খাবারের প্রতি আগ্রহী। তাই হেবাংয়ের অধিকাংশ ভোক্তাই তরুণ।

রসুইঘর

রসুইঘর পেইজে এর সম্পর্কে লেখা আছে,‘‘রসুইঘর’ এ থাকছে দেশি খাবার তৈরির সব বন্দোবস্ত। আপনার চাহিদা, রুচি এবং পরিমান মতো খাবার পৌঁছে যাবে আপনার ঠিকানায়’। রসুইঘর নিয়ে কথা হল এর প্রতিষ্ঠাতা লাখীয়া হাবিবার সাথে। তিনি জানালেন, মূলত হারিয়ে যাওয়া দেশি খাবারগুলোকে আবার জনপ্রিয় করতে ২০১৬’র জুনে যাত্রা শুরু করে ফেসবুকভিত্তিক অনলাইন খাবারের দোকান রসুইঘর।

কুমড়োবড়ি, দেশি মাছ, নদীর কইমাছ, শুটকি, গরুর মাংস, সবজি নানা রকম দেশীয় আর ভিন্নরকম পদ ছাড়াও এখানে পাওয়া যায় বিন্নি ধানের খই, পিঠা পুলি, মুড়ি-মুড়কি, ঢেকিভাঙা চালের ভাত ইত্যাদি।

তাদের রান্নায় ভিন্নতা আসে কীভাবে জানতে চাইলে লাখীয়া জানান, আচারি বেগুন, বেগুন বাহারের মত বেগুনের নানান পদ ছাড়াও গরুর মাংসের ভিন্ন ধরণের আঞ্চলিক রান্না পাওয়া যায় রসুইঘরে যা তাদের ক্রেতারা খুব পছন্দ করেন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নানারকম অনুষ্ঠান আয়োজনের খাবারের অর্ডার বেশি আসে। এছাড়াও যারা দেশের বাইরে থাকেন তারা দেশে থাকা পরিবারের জন্য রসুইঘরে খাবার অর্ডার করেন। শুধু বড় আয়োজনই না, ব্যস্ত জীবনে ঝামেলা এড়াতে কেউ কেউ রোজকার রান্না, নিতান্ত ঘরোয়া আয়োজনের জন্যও খাবার অর্ডার করেন রসুইঘর থেকে।

রসুইঘরে অন্তত আটজনের জন্য খাবারের অর্ডার নেওয়া হয়। খাবার সরবারহ করতে নানারকম স্থানীয় ডেলিভারি সার্ভিসের সাহায্য নেন লাখীয়া। হাতে সময় থাকলে নিজেও সরবরাহ করেন মাঝেমধ্যেই। পরিবার থেকে সবসময়ই পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছেন তিনি। রান্নাবান্নার প্রস্তুতিতে দুজন সাহায্যকারীর সাহায্য নেন।

রান্না করা খাবার ছাড়াও নিজেদের তত্ত্বাবধানে ভাঙানো তেল, মশলা, খাঁটি ঘি, মধু ইত্যাদিও সরবরাহ করেন তারা।

কাঁটা চামচ

নওশাবা তাবাসসুমের বড় হয়েছেন দেশের বাইরে। বিয়ের পরে দেশেই স্থায়ী হওয়ার পরিকল্পনা করেন। কিন্তু বাংলাদেশি নাগরিকত্ব থাকলেও জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকায় এদেশে কোন চাকরি পাননি। তাই নিজের মত করে একটা ব্যবসা করার চিন্তা থেকে নিজের শখকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন নওশাবা। রান্নাবান্না করাই তার শখ। নওশাবার রান্নার হাতেখড়ি হয়েছিল মায়ের কাছে। পরে নিজের মত করে রান্না করতে শুরু করেন। এর মাঝে সিস্টেরহুড নামক অনলাইনভিত্তিক এক সংগঠনে অনেক নারী উদ্যোক্তার সাথে পরিচিত হন। তাদের উৎসাহেই ২০১৫’র ডিসেম্বরে কাঁটা চামচ নামে অনলাইনভিত্তিক রেস্টুরেন্ট খোলেন।

এখানে দুপুরের ঘরোয়া খাবার ছাড়াও পাওয়া যায় নানারকম আচার ও কাবাব। দুপুরের খাবারের আয়োজনে এখানে নানারকম ভর্তা পাওয়া যায় যেমন, বরবটি ও চিংড়ির ভর্তা, শিম ভর্তা, কাবাব ভর্তা, কচুর ছড়ি ভর্তা, রুইমাছ ভর্তা, ডিমের কুসুম ভর্তা, চ্যাপা শুঁটকি ভর্তা ইত্যাদি। আবার আলু আর মটরশুঁটি দিয়ে রুইমাছ, চিংড়ি দিয়ে পালং শাক, গলদা চিংড়ির দোপেয়াজা, বাদাম চিংড়ি, চিংড়ি কাটলেট, শুঁটকির দোপেয়াজা, আলু বেগুন দিয়ে শুঁটকি, আনারস দিয়ে মুরগিসহ নানারকম ঘরোয়া সবজির আয়োজনও রয়েছে এখানে।

মূলত ঘরোয়া খাবার পাওয়া যায় এখানে। তাই তার ক্রেতার বড় অংশই কর্মজীবী নারী। অনেকে দেশের বাইরে থেকে বাবার বা শ্বশুরবাড়ির জন্য ঘরোয়া খাবারের অর্ডার দেন এই পেইজ থেকে।

রান্না ও খাবার সরবরাহ করার কাজে সাহায্য করার জন্য একজন নিয়মিত সহকারি ছাড়াও কয়েকজন অনিয়মিত লোক আছে বলে জানান নওশাবা তাবাসসুম।

সামিয়া’স কিচেন

অনলাইনভিত্তিক খাবারের দোকান হয়তো শুধু ঢাকাতেই আছে, এমনটাই ভাবি আমরা। কিন্তু সামিয়া’স কিচেন তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে লক্ষ্মীপুর জেলা শহরে।

সামিয়া ২০১৬’র জুনে তার অনলাইনভিত্তিক রেস্টুরেন্টের যাত্রা শুরু করেছিলেন ঢাকায়। পরে লক্ষ্মীপুরে গিয়ে মা ও বোনের সাহায্যে সেখানেই ব্যবসা করছেন।

তিনি শুরু করেছিলেন টুকটাক ফ্রোজেন ঘরোয়া নাস্তা দিয়ে। যেমন, ফ্রায়েড রোল, সমুচা, চিকেন ফ্রাই ইত্যাদি। শুরুতে নিজেদের আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধব ছিল তার ক্রেতা। ধীরে ধীরে পরিচিতি বাড়তে থাকে আর শুরু করেন দুপুরের খাবার অর্ডার নেওয়া।

অনেক সময়ই কারও বাসার অনুষ্ঠান আয়োজনের রান্নার দায়িত্ব নেন তারা। খাবার সরবরাহ করার কাজে সামিয়ার ভাই সাহায্য করেন। আবার পরিচিত অনেকেই এনে খাবার নিয়ে যান।

মিঠাই মন্ডা

সন্তানরা দেশের বাইরে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। এরকম ক্ষেত্রে আমাদের দেশের পঞ্চাশোর্দ্ধ গৃহিণীদের যেন আর কিছুই করার থাকেনা। মিষ্টির জন্য জনপ্রিয় ফেইসবুক পেইজ মিঠাইমন্ডার উদ্যোক্তা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সন্তানদের উৎসাহেই তার ব্যবসা শুরু করেন অনলাইনে। পারিবারিক ও বন্ধু মহলে তার রান্নার বেশ সুনাম ছিল। মা যেহেতু ভালো রান্না করে তাই মেয়ে একসময় মাকে উৎসাহ দেন রান্না নিয়ে কিছু করতে। এভাবে ২০১৬ এর সেপ্টেম্বরে মায়ের জন্মদিনে ফেসবুকে মিঠাই মন্ডা নামে পেইজ খুলে দেন। বাঙালির শেষ পাতে মিঠাই নাহলে কি আর চলে! তাই ঘরে তৈরি মায়ের হাতের মিঠাই মণ্ডাও দ্রুতই জনপ্রিয়তা অর্জন করে।

অনলাইনভিত্তিক নারীদের গ্রুপ থেকে প্রথম মাসে তিনটি অর্ডার পায় মিঠাই মন্ডা। এরপর, অক্টোবর মাসে এত অর্ডার আসতে থাকে যে প্রতিদিন সর্বনিম্ন পাঁচ কেজি করে লাল মোহন মিষ্টি বানাতে হয় একা হাতে।

এরপর নভেম্বর মাসে নতুন মিষ্টি নিয়ে আসেন, নারকেলের সন্দেশ। একে একে পাটি সাপটা, রসমালাই ইত্যাদি পণ্য নিয়ে আসেন। কিন্তু একা হাতে সব করতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠছিলেন রীতিমত। তাই পরে একজন সহকারী রাখেন।

খাবার সরবরাহের জন্য নানারকম পণ্য সরবরাহ সংস্থার সাহায্য নেওয়া হয় এই পেইজ থেকে। অবশ্য অনেকসময় অনেকে বাসায় এসেও নিয়ে যান অর্ডার করা পছন্দের মিষ্টি।

সংবাদ মাধ্যমে নিজের পরিচয় দিতে অনাগ্রহী নিভৃতচারিনী এই নারী উদ্যোক্তা। তবে জানালেন, স্বচ্ছল পরিবারের হলেও এই যে এখন নিজের মত করে কিছু করছেন এটা তার খুবই ভালো লাগে। নিজের টাকা খরচ করার মজাই আলাদা বলে জানান এই নারী উদ্যোক্তা।
সারাবাংলা/আরএফ/এসএস

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন