বিজ্ঞাপন

উপকূলে লবণাক্ততা-আর্সেনিক, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে হাইসাওয়া

May 30, 2021 | 11:20 am

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

খুলনা সাতক্ষীরা থেকে ফিরে: নদী, খাল, বিল, পুকুরসহ সমস্ত জলাশয় ও টিউবওয়েলে পানি থাকলেও পান করার পানি যেন কোথাও নেই। জলাশয়ের পানি লবণাক্ত, টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক। ফলে সুপেয় পানির এক চরম সংকট যেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় কয়েকটি জেলার জনগণকে এমন সংকটের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। বিশুদ্ধ পানি না পেয়ে দূষিত পানি পান করে নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন এসব এলাকার মানুষ।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে এই চিত্র দেখা গেছে। তবে আশার কথা হলো— স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সার্বিক সহযোগিতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত এলাকায় স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি সরবরাহের কাজও চলছে। আর এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে হাইজিন স্যানিটেশন অ্যান্ড ওয়াটার সাপ্লাই (হাইসাওয়া)। বাংলাদেশ সরকারের স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন অংশীদার হাইসাওয়া, সুইজারল্যান্ড সরকার ও দাতা সংস্থা এসডিসির আর্থিক সহায়তায় এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। অলাভজনক হাইসাওয়া বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় হাইজিন, স্যানিটেশন ও পানি সরবরাহ প্রকল্পগুলোতে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিয়ে আসছে।

স্থানীয়রা জানালেন, এলাকাবাসীর বিশুদ্ধ পানি ও নিরাপদ স্যানিটেশন সমস্যা সমাধানে বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে হাইসাওয়া নিজস্ব অর্থায়নে ‘পরিবারভিত্তিক ল্যাট্রিন’ ও ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম’ও নিমার্ণ করে দিচ্ছে। এছাড়াও প্রতিদিন এক হাজার পরিবারের মাঝে বিশুদ্ধ পানি পানি সররবাহ করতে ‘রিভার্স অসমোসিস পানি পরিশোধন ও সরবরাহ প্রকল্পে’র আওতায় বেশ কয়েকটি পানির প্ল্যান্টও স্থাপন করা হয়েছে। এসব প্লান্ট থেকে প্রতি লিটার ৫০ পয়সা দামে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এই পানির প্ল্যান্ট থেকে প্রতিদিন নিরাপদ পানি পাচ্ছেন লবণাক্ততা ও আর্সেনিক প্রবণ উপকূলীয় এলাকার হাজার হাজার মানুষ।

বিজ্ঞাপন

২০০৭ সালে যাত্রা শুরু হওয়া হাইসাওয়া নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন সংক্রান্ত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এমডিজি) অর্জনের জন্য কাজ করেছে। বর্তমানে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য যশোর, নড়াইল, খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা— এই পাঁচ জেলার ১২টি উপজেলার ৭০টি ইউনিয়নে কাজ করছে সংস্থাটি। এসব এলাকায় স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ও নিরাপদ পানি সরবরাহের মাধ্যমে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর পাশে দাঁড়িয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে (ইউনিয়ন পরিষদ) ২০১০ সাল থেকে তিন মেয়াদে ৮ হাজার ৭৫৬টি নলকূপ এবং ২২০টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ছাড়াও দুইটি রিভার্স অসমোসিস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনের মাধ্যমে হাইসাওয়া সুপেয় পানির চাহিদা পূরণে কাজ করছে। পানির উৎস ও নলকূপের মাধ্যমে মোট ৮ লাখ ৫৯ হাজার ৫৪১ জন সুবিধা ভোগ করছেন। উপকূলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর নিরাপদ পানির সংকট দূর করতে পানির উৎস গড়ে তুলেছে সংস্থাটি।

বিজ্ঞাপন

হাইসাওয়া থেকে সারাবছর নিরাপদ পানি ব্যবহারের জন্য ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম’র মাধ্যমে ৩ হাজার লিটারের ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানির ট্যাংক পেয়েছেন সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি উপজেলার দরগাপুর ইউনিয়নের শ্রীধরপুর গ্রামের মো. মিজানুর রহমান।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের এলাকার জলাশয়ের পানি লবণাক্ত, টিউবওয়েলের পানিতে আর্সেনিক। ফলে জলাশয় ও টিউবওয়েলের কোনো পানিই আমরা পান করতে পারি না। সারাবছর ইউপি থেকে প্রতি মাসে একটি পরিবার গড়ে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকার পানি কিনে খেতে হতো। যেখানে আমাদের কোনো আয়ই নেই, সেখানে প্রতি মাসে পানির জন্য ব্যয় করা খুবই কষ্টকর।

তিনি বলেন, টাকার অভাবে পানি কিনতে না পারলে পুকুরের ময়লা পানি পান করতাম। এতে করে আমরা গ্যাসট্রিক, পেটে পীড়া, ডায়েরিয়াসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হতাম। এ অবস্থায় হাইসাওয়া আমার বাড়িতে ‘রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম’ দিয়ে পানি সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এতে করে আমাদের পানি কেনার খরচ লাগছে না। আবার বিশুদ্ধ পানি পান করায় পানিবাহিত রোগ-বালাই থেকেও মুক্ত আছি।

বিজ্ঞাপন

খুলনা জেলার ডুমুরিয়া উপজেলার খর্ণিয়া ইউনিয়নের উকড়া গ্রামের প্রতিবন্ধী রেজাউল মোল্লা (৪৫) সারাবাংলাকে বলেন, একসময় ভ্যান চালাতাম। গত ১০ বছর ধরে আমার একটি হাত ও পা অবশ। চলাফেলা করতে পারি না। কাঁচা ল্যাট্রিন ব্যবহার করতে সমস্যা হতো। এ অবস্থায় হাইসাওয়া একটি পাকা ‘পরিবারভিত্তিক ল্যাট্রিন’ তৈরি করে দিয়েছে। ল্যাট্রিনটি ব্যবহার করায় অনেক সুবিধা হচ্ছে।

একই উপজেলার ১৪ নম্বর মাগুরখালি ইউনিয়ন পরিষদে ৪২ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি পানির প্ল্যান্ট করে দিয়েছে হাইসাওয়া। ইউপি‘র মাধ্যমে পানির প্ল্যান্টটি রক্ষণাবেক্ষণ ও পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিদিন এই পাম্প থেকে আশপাশের ৮/১০টি গ্রামের মানুষ মাত্র ৫০ পয়সা লিটার দরে ৮০০ থেকে এক হাজার পরিবার পানি সংগ্রহ করছেন। পানি বিক্রির এই টাকা ইউনিয়ন পরিষদের আয়ের একটি অন্যতম উৎসও।

মাগুরখালি ইউনিয়ন পরিষদদের সংরক্ষিত ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য অনিমা মন্ডল বলেন, হাইসাওয়া‘র পক্ষ থেকে মাগুরখালি ইউনিয়ন পরিষদে ‘রিভার্স অসমোসিস পানি পরিশোধন ও সরবরাহ প্রকল্পে’র আওতায় অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে পানি শোধনাগার নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। এখান থেকে মাগুরখালি ইউনিয়নের হেতাইল, বুনিয়া, মাগুরখালি, আলাদিপুর, পাতিবুনিয়া, গাজিনগর, গুরুনিয়া, শিবনগর, রাগারদাইর, কাঞ্চনপুর গ্রামের প্রায় এক হাজার পরিবার প্রতি লিটার পানি মাত্র ৫০ পয়সা করে কিনে নিতে পারছেন। এতে একদিকে যেমন এলাকাবাসী বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে, অন্যদিকে প্রতিদিন ৬ থেকে ৭ হাজার লিটার পানি বিক্রির কারণে ইউপি পরিষদেরও একটি বৈধ আয়ের পথ হয়েছে।

তিনি বলেন, হাইসাওয়ার পক্ষ থেকে এই ধরনের একটি পানি পরিশোধনাগার করে দেওয়ায় আমরা এলাকাবাসী বিশুদ্ধ পানি পান করতে সক্ষম হয়েছি।

এ ব্যাপারে হাইসাওয়া‘র প্রোগ্রাম অফিসার মাহবুব রশিদ সারাবাংলাকে বলেন, হাইসাওয়া মূলত হাইজিন, স্যানিটেশন ও ওয়াটার সাপ্লাইয় নিয়ে ইউনিয়ন পরিষদের মাধ্যমে সক্ষমতা তৈরির মূল কাজটি করে থাকে। খুলনা ও সাতক্ষীরা এলাকায় মূল সমস্যা নিরাপদ পানির সংকট। সারাদেশে গড়ে ৯৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানির আওতায় এলেও এখানকার কোনো কোনো এলাকায় ৫০ শতাংশেরও কম মানুষ নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন পচ্ছেন। এখানে নিরাপদ পানির মূল সমস্যা, গভীর নলকূপ স্থাপন করতে গেলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পাওয়া যায় না। বিশেষ করে সাতক্ষীরার আশাশুনি, দুর্গাপুর, কালিগঞ্জের পাশাপাশি বাগেরহাট ও খুলনা মিলিয়ে গোটা অঞ্চলটি সম্পূর্ণ লবণাক্ত এলাকা। পানিতে লবণাক্ততা ও আর্সেনিকের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে তা বাড়ছে।

তিনি বলেন, এলাকায় প্রায় প্রতিটি ঘরেই নিরাপদ পানির সমস্যা। এর মধ্যে সিডিএফের মাধ্যমে বাছাই করে একেবারেই দরিদ্র, পানি কিনে খাওয়ার সামর্থ্য নেই— এমন পরিবারগুলোকে অগ্রাধিকারভিত্তিতে পানি ও স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করছি।

মাহবুব রশিদ আরও বলেন, আমাদের প্রকল্পটি মূলত বাংলাদেশ ও বিভিন্ন দেশের সরকার এবং দাতা সংস্থাগুলোর অর্থায়নে বাস্তবায়ন করা হয়। বর্তমানে খুলনা-সাতক্ষীরা অঞ্চলের প্রকল্পটি সুইজারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে হচ্ছে। প্রকল্প বাস্তবায়নে হাইসাওয়া পরিচালনা পর্ষদের একটি বোর্ড রয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এই বোর্ডের প্রধান।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন