বিজ্ঞাপন

সিআরবিতে হাসপাতাল: সিডিএ-ওয়াসার ‘সুর নরম’

August 2, 2021 | 9:29 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে প্রথম ধাপের প্রস্তুতিমূলক কাজের জন্য কোনো ধরনের অনুমোদন নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট দু’টি সরকারি সংস্থা। হাসপাতালের বিরুদ্ধে নাগরিকদের আন্দোলন উপেক্ষা করে অনুমোদন ছাড়াই কাজ শুরু করা নিয়ে আপত্তি থাকলেও যথেষ্ঠ কঠোর অবস্থান দৃশ্যমান নয় সংস্থাগুলোর।

বিজ্ঞাপন

বরং চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত ফি পরিশোধ সাপেক্ষে ‘গভীর নলকূপ স্থাপনের’ লাইসেন্স নেওয়ার অনুরোধ করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে। আর সিডিএ বলছে, আবেদন করলে তখন অনুমোদন দেওয়া হবে কি না সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের আওতায় চট্টগ্রামের সিআরবিতে রেলওয়ের ছয় একর জায়গার ওপর ৫০০ শয্যার একটি হাসপাতাল, ১০০ আসনের মেডিকেল কলেজ ও একটি নার্সিং ইনস্টিটিউট করার অনুমোদন পেয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড। সানজি ম্যাক্স ও ওয়েল জেবি এবং ডেনিম মিলস লিমিটেড নামে আরও দু’টি প্রতিষ্ঠান আগ্রহী থাকলেও দরপত্র দলিলের শর্ত প্রতিপালন করতে না পারায় নন রেসপনসিভ হয়।

২০২০ সালের ২৮ জানুয়ারি অর্থনৈতিক সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির (সিসিইএ) কমিটির বৈঠকের পর ১৩ ফেব্রুয়ারি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) আওতায় প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী চূড়ান্ত অনুমোদন দেন।

বিজ্ঞাপন

প্রকল্পের মেয়াদকাল ধরা হয়েছে ১২ বছর। চুক্তির সময়কাল ধরা হয়েছে ৫০ বছর (নির্মাণসহ)। চুক্তি অনুযায়ী, বেসরকারি অংশীদার বা ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ চুক্তির সময়কালে অবকাঠামোর ডিজাইন, নির্মাণ, অর্থায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ করবে। চুক্তির মেয়াদ শেষে পূর্ণাঙ্গ চালু ও ভালো অবস্থায় সামগ্রিক অবকাঠামো সরকারি অংশীদার বা বাংলাদেশ রেলওয়েকে হস্তান্তর করবে।

আরও পড়ুন- আন্দোলন উপেক্ষা করেই চলছে হাসপাতাল নির্মাণের প্রথম ধাপের কাজ

সিআরবির মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ও ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত এলাকায় হাসপাতাল নির্মাণের খবর জানাজানির পর বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ। চলমান কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলেও গত প্রায় একমাস ধরে সিআরবিতে সভা-সমাবেশের মাধ্যমে প্রতিবাদ জানায় বিভিন্ন সংগঠন ও নানা শ্রেণিপেশার মানুষ। এর ধারাবাহিকতায় একুশে পদকপ্রাপ্ত বুদ্ধিজীবী ড. অনুপম সেনকে আহ্বায়ক ও আওয়ামী লীগ নেতা ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলকে সদস্য সচিব করে ‘নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রাম’ গঠন করা হয়েছে। অন্যদিকে বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. মাহফুজুর রহমানকে আহ্বায়ক করে ‘সিআরবি রক্ষা মঞ্চ’ গঠন করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

এ অবস্থায় গত গত ২৭ জুলাই বিকেলে নগরীর এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের গোয়ালপাড়া এলাকায় রেলওয়ের শহিদ আব্দুর রব কলোনি সংলগ্ন হাসপাতালের প্রস্তাবিত এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজের তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এরপর সেখানে জড়ো হন আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিসহ স্থানীয় শ’খানেক মানুষ।

তবে ইউনাইটেড এন্টারপ্রাইজ অ্যান্ড কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক (করপোরেট অ্যাফেয়ার্স) কায়েস খলিল খান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ হচ্ছে না। ভূর্গভস্থ পানির স্তর যাচাই করা হচ্ছিল। পরিবেশ অধিদফতরের অনুমোদনের আবেদনের জন্য এ কাজ করা হচ্ছে। একইসঙ্গে তারা মাটি, বায়ু ও শব্দের গুণগত মানমাত্রাও যাচাই করছিলেন। মাটির গুণগত মান যাচাই করা হচ্ছিল চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) বরাবরে নকশা অনুমোদনের আবেদন দাখিলের জন্য।

ভূর্গভস্থ পানির স্তর, মাটি, বায়ু ও শব্দের গুণগত মানমাত্রা যাচাইকে হাসপাতাল নির্মাণের লক্ষ্যে প্রাক প্রস্তুতিমূলক প্রথম ধাপের কাজ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন প্রকল্প পরিচালক রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী (সেতু) আহসান জাবির।

তবে নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের একটি প্রতিনিধি দল রোববার (১ আগস্ট) চট্টগ্রাম ওয়াসায় গিয়ে অনুমতি ছাড়াই সিআরবিতে বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণের জন্য গভীর নলকূপ স্থাপনের অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগ আমলে নিয়ে সোমবার (২ আগস্ট) ওয়াসার রাজস্ব কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। সেখানে গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য পরীক্ষামূলক খননের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায় ওয়াসা।

বিজ্ঞাপন

এরপর সোমবার রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রকল্প পরিচালক বরাবর একটি চিঠি দিয়েছেন চট্টগ্রাম ওয়াসার সহকারী সচিব ও প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা দিদারুল আলম। তাতে বলা হয়েছে, স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রজ্ঞাপনে ১৯৮৯ সালের ২ সেপ্টেম্বরের পূর্বাপর ওয়াসার অধীন এলাকায় স্থাপিত সব গভীর নলকূপ স্থাপন অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে। এরপর থেকে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনে ওয়াসার অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু সিআরবিতে প্রস্তাবিত হাসপাতাল প্রকল্প এলাকায় গভীর নলকূপ স্থাপনের জন্য কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমনকি অনুমোদনের জন্য কোনো আবেদনও করা হয়নি, যা বিধিসম্মত নয়। এ অবস্থায় গভীর নলকূপ স্থাপনের নির্ধারিত ফি পরিশোধ পূর্বক লাইসেন্স নেওয়ার অনুরোধ করেছে ওয়াসা।

আরও পড়ুন-

ওয়াসা কর্তৃপক্ষের এ চিঠি নিয়ে চট্টগ্রামের আন্দোলনকারীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরব হয়েছেন। তারা সরাসরি কাজ বন্ধের নির্দেশনা না দিয়ে ফি পরিশোধ করে লাইসেন্স নেওয়ার অনুরোধের মধ্যে ওয়াসার ‘নমনীয় অবস্থান’ দেখা যাচ্ছে বলে সমালোচনায় মেতেছেন।

জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী একেএম ফজলুল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে একটি চিঠি দিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগ করা হয়েছে যে প্রকল্প এলাকায় অনুমোদন ছাড়াই গভীর নলকূপ স্থাপনের কাজ চলছে। আমাদের টিম সরেজমিনে পরিদর্শন করে সেখানে টেস্ট বোরিংয়ের প্রমাণ পেয়েছে। কিন্তু আইনে আছে, ওয়াসার অনুমোদন ছাড়া গভীর নলকূপ স্থাপন অবৈধ। আমরা চিঠি দিয়ে প্রকল্প পরিচালক এবং সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়েছি, তারা যেন নির্ধারিত ফি পরিশোধ করে অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ করে। আমরা চিঠি দিয়েছি, তারা কী জবাব দেয় দেখি।’

গভীর নলকূপ স্থাপন নয়, ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পরীক্ষা করা হচ্ছে— প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের এমন দাবির বিষয়ে প্রকৌশলী ফজলুল্লাহ বলেন, ‘সেটি তারা চিঠিতে উল্লেখ করুক। সেখানে যেভাবে টেস্ট বোরিং হচ্ছে, তাতে মনে হয়েছে গভীর নলকূপের জন্য করা হচ্ছে। পানির স্তর পরীক্ষার জন্য হলে তো ৫০-৬০ স্পটে টেস্ট বোর করতে হবে। সেটার জন্যও ওয়াসাকে অবহিত করতে হবে। তবে শুধু সয়েল টেস্ট হলে অনুমোদনের দরকার নেই।’

এদিকে, সোমবার নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের আহ্বায়ক ড. অনুপম সেন ও সদস্য সচিব ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুলের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীদের একটি প্রতিনিধি দল সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা সিআরবিকে সিডিএ ঘোষিত হেরিটেজ উল্লেখ করে সেখানে অনুমোদনহীন হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প বন্ধ করার লিখিত দাবিনামা দেন।

নাগরিক সমাজের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, সাক্ষাতে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেছেন— চট্টগ্রাম শহরে যেকোনো স্থাপনা নির্মাণে সিডিএর অনুমোদন প্রয়োজন। কিন্তু রেল কর্তৃপক্ষ বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেউই সিডিএর কোনো অনুমোদন নেয়নি। সরকারি প্রতিষ্ঠান হোক কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান— কেউ অনুমোদনবিহীন স্থাপনা নির্মাণ করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করা হবে।

জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমার বক্তব্য— সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণের জন্য আমাদের কাছ থেকে অনুমোদনের কোনো আবেদন করা হয়নি। যখন আবেদন দাখিল করবে, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নেব। এখনও এ বিষয়ে কিছু বলার সময় আসেনি।’

আবেদন করলে অনুমোদন দেওয়া হবে কি না— জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, ‘আবেদন করলে তখন দেখা যাবে। এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয় যে অনুমোদন দেবো নাকি দেবো না। সিআরবিতে অনেক গাছপালা আছে। সেখানে স্থাপনা করার অনুমোদন দেওয়া যাবে কি না— সেটি আমাদের অবশ্যই যাচাই-বাছাই করে দেখতে হবে।’

নাগরিক সমাজ, চট্টগ্রামের কো-চেয়ারম্যান মফিজুর রহমান, বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. ইউনুচ, বিএফইউজের যুগ্ম মহাসচিব মহসিন কাজী, যুগ্ম সদস্য সচিব রাশেদ হাসান, সদস্য চৌধুরী ফরিদ, স্বপন মজুমদার, শুকলাল দাশ, আমিনুল ইসলাম মুন্না সেসময় ছিলেন।

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন