বিজ্ঞাপন

৪ বছরের প্রকল্পে লেগে যাচ্ছে ১০ বছর, ব্যয় বেড়ে দ্বিগুণ!

September 13, 2021 | 2:36 pm

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: রাজধানীর যানজট কমাতে সরকার যতগুলো উদ্যোগ নিয়েছে তার মধ্যে অন্যতম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্প। উন্নত বিশ্বের মতো সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থায় আধুনিকতা আনতেই ২০১২ সালে বাংলাদেশে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু বার বার নকশা বদল, নতুন নতুন অবকাঠামো যোগ আর সমন্বয়হীনতার কারণে চার বছর মেয়াদী এই প্রকল্প নয় বছরেও শেষ হয়নি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন কাজের গতি বেড়েছে। ২০২২ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে।

বিজ্ঞাপন

রাজধানী ঢাকার সড়ক ও পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে ২০ বছর মেয়াদী পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) করা হয় ২০০৫ সালে। সেই পরিকল্পনায় বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫ কিলোমিটার সড়কে বাসের জন্য আলাদা লেন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

এ পরিপ্রেক্ষিতে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পটি পরিকল্পনা করা হয় ২০১২ সালে। ওই বছরের ১ ডিসেম্বর সরকারের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) অনুমোদন পায় প্রকল্পটি। এর পর কাজ শুরু হয়। ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রকল্পে আন্তর্জাতিক তিন দাতা সংস্থা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসালিটি অর্থায়ন করছে। আর এই তিন সংস্থার সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশ সরকার।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, চার পরামর্শক সংস্থার অধীনে বিআরটি প্রকল্প সড়ক ও জনপথ, সেতু বিভাগ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি) এবং ঢাকা বিআরটি কোম্পানি প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। সওজের অধীনে এ প্রকল্পের অধীনে ১৬ কিলোমিটার সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণের কাজ হওয়ার কথা। জানা গেছে, এর পুরোটাই শেষ হয়েছে। কেনা হয়েছে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রপাতি এবং সড়কবাতি, যা সৌরবিদ্যুতে চলবে। এছাড়া বিআরটি লেন নির্মাণ, বিমানবন্দরের কাছে পথচারীদের চলাচলের জন্য পাতালপথ নির্মাণ, সাড়ে চার কিলোমিটার উড়ালপথ নির্মাণ, তিনটি বিআরটি লেন নির্মাণ, স্টেশন নির্মাণ এবং বর্তমান টঙ্গী সেতুর স্থানে ১০ লেনের একটি নতুন সেতু নির্মাণ করছে সেতু বিভাগ। বিআরটি প্রকল্পে স্টেশন থাকবে ২৫টি। আর ঢাকা বিআরটি কোম্পানির অধীনে বাস কেনা, বেসরকারি পরিবহন মালিকদের এ উদ্যোগে সম্পৃক্ত করা, আধুনিক পদ্ধতিতে বাস পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে গাজীপুর থেকে মাত্র ৪০ মিনিটে যাওয়া যাবে এয়ারপোর্ট রোড। উভয়দিকে ঘণ্টায় পরিবহন করা হবে ৪০ হাজার যাত্রী। ফলে যানজট কমবে ঢাকার রাস্তায়ও।

বিজ্ঞাপন

এমন পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেন কর্মকর্তারা। কিন্তু প্রকল্প বাস্তবায়নে করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রকল্প এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। ফলে পানি সরানো যাচ্ছে না। আরও বিপত্তি হয়ে দেখা দেয় বিভিন্ন সেবা সংস্থার লাইন নিয়ে। সেগুলো কীভাবে সরানো হবে তা নিয়ে আগে থেকে সমন্বয় ছিল না। এসব সমস্যার পাশপাশি সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে, কাজ চলাকালীন এই ব্যস্ততম সড়কে যানবাহন চলাচলের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা না রাখা। ফলে পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই যানচলাচলের জন্য সড়ককে দুই ভাগ করা হয়। এছাড়া প্রকল্পের নির্মাণ কাজের জন্য নয় বছর ধরে বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত পুরো সড়ক সরু হয়ে আছে। ফলে অর্ধেকেরও কম অংশে যান চলাচল করতে পারছে। যতটুকু সড়কে যানবাহন চলাচল করে তার বেশিরভাগই ভাঙা ও খানা-খন্দে ভরা। এই পথের যাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে বিআরটি প্রকল্প।

এসব কারণে প্রকল্পে নেমে আসে চরম ধীরগতি। গত নয় বছরে কয়েক দফা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। বিআরটি প্রকল্পের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, গত কয়েক মাসে এ প্রকল্পে কাজের অগ্রগতি দৃশ্যমান। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। বাস্তবায়নের সময় বাড়ার পাশাপাশি ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। এমনকি জনদুর্ভোগও বেড়েছে সমান্তরালে। জানা গেছে, ২ হাজার ৪০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। পরে মেয়াদ ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। পাশাপাশি মূল ব্যয়ের ১০৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়, যা টাকার অংকে ২ হাজার ২২৫ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে প্রকল্প ব্যয় ৪ হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায় পৌঁছায়।

কর্তৃপক্ষ বলছে, সব ঝামেলা মিটিয়ে দেশের প্রথম বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) ২০২২ সালের ডিসেম্বরেই যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে। সে অনুযায়ী কাজের অগ্রগতি সন্তোষজনক বলে মনে করছেন প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচাল সফিকুল ইসলাম। সারাবাংলাকে তিনি জানান, ইতোমধ্যে প্রকল্পের সংযোগ সড়ক এবং ডিপো নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। বর্তমানে সার্বিক কাজের অগ্রগতি ৬৩ দশমিক ২৭ শতাংশ। কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের লক্ষ্য ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এটি যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পটি চালু হলে রাজধানীবাসীর দীর্ঘদিনের ভোগান্তি থেকে মুক্তি মিলবে। এ প্রসঙ্গে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘যে সড়কে বিআরটি নির্মাণ করা হচ্ছে সেটা বিআরটি বান্ধব না। কারণ ওই সড়কে প্রচুর মানুষ হেঁটে চলে। রাস্তা পারাপার হয়ে থাকে। বিআরটির জন্য সঠিক জায়গা বাছাই করা হয়নি। ছিল চরম সমন্বয়হীনতা। সমীক্ষাও হয়নি আগে থেকে। যে কারণে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পদে পদে সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে।’ এসবই প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি ও ব্যয় বাড়ার কারণ বলে মনে করেছেন তিনি।

গত নয় বছর ধরে এই রুটের পথচারীদের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বিআরটি প্রকল্প। প্রায় বছর জুড়েই গাজীপুরের চান্দনা চৌরাস্তা থেকে আব্দুল্লাহপুর পর্যন্ত দীর্ঘ যানজট লেগে থাকে। বিআরটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জনভোগান্তি এতটাই চরমে উঠেছে যে, প্রকল্পের দ্বিতীয় অংশ বিমানবন্দর থেকে কেরাণীগঞ্জ পর্যন্ত বিআরটি লাইন নির্মাণ থেকে সরে আসছে সরকার। অথচ মাত্র ২০ কিলোমিটার আলাদা বাস লাইন নির্মাণ করে ওই সড়কে বাস নামানোর কথা ছিল। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতটুকু নির্মাণ হচ্ছে তা শেষ হলে অন্তত এই দুর্ভোগ থেকে মানুষের মুক্তি মিলবে।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন