বিজ্ঞাপন

রাসয়াত রহমান জিকো-এর গল্প ‘আলো’

May 1, 2022 | 9:41 pm

গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম ঘুরতে। পাগল টাইপ লোকটার সাথে দেখা সেখানেই। পাগল না বলে জ্ঞানের স্বল্পতাও বলা যায়। অবশ্য জ্ঞান নিয়ে এত কপচাকপচি করে লাভ নেই। আমি নিজে জ্ঞানে টইটম্বুর— এমন না। আর প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা এই অতি সাধারণ লোক জ্ঞানের গভীরতা প্রকাশ করবে, এটা ভাবাও কঠিন। জ্ঞান শুধু বই পড়ে আসে বলে আমার মনে হয় না, দুনিয়াও দেখা লাগে।

বিজ্ঞাপন

এমনিতে গ্রামে গিয়েছি অনেকদিন পর। যে নির্মল বাতাস, পঙ্কিলতামুক্ত হাওয়া, সহজ-সরল জীবনের সন্ধানে এখানে আসা— তা খুব একটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। জীবন এখন কোথাও সহজ নয়। রবীন্দ্রনাথের গানের গ্রামের সেই মেঠোপথ এখন আর মেঠোপথ নেই। গ্রামেও এখন পাকা রাস্তা। ‘গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ’ও নেই।

নাস্তা খাওয়ার জন্য হোটেলের মতো এক জায়গায় এসেছি। গ্রামের লোকজন ছোটখাটো ব্যাপার নিয়ে গর্ব করতে ভালোবাসে। কী জানি এক মিষ্টি, এইটা নাকি বিশ্বের সেরা মিষ্টি। হোটেলের মালিক তাদের সেই মিষ্টি আমাকে খাওয়াবেই। পরোটা দিয়ে মিষ্টি খাচ্ছি, এমন সময় মুরুব্বি শ্রেণির একজন প্রশ্ন করলেন, ‘বাপধন কোন বাড়ির পোলা?’

বললাম, মাস্টার বাড়ি।

বিজ্ঞাপন

‘ওহ, মাস্টারের নাতি।’

‘জি, স্লামালাইকুম।’

গ্রামে আমাকে মাস্টারের নাতি হিসেবে চেনে। দাদাজান স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। বিশিষ্ট জ্ঞানী ব্যক্তি। স্কুলে লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেছেন। গ্রামে শিক্ষার আলো জ্বালিয়েছিলেন। গ্রামের প্রতিটি পরতে পরতে তার কীর্তি ছড়ানো।

বিজ্ঞাপন

যাই হোক, গল্পে ফিরে আসি। যেই লোককে সালাম দিলাম সেই লোকের গল্পে। তিনি এরপর বললেন, ‘মাস্টারের নাতি, আমি তোমার চাচা হই।’
‘জি, অবশ্যই।’

গ্রামের সব এই বয়সি লোকজনেরাই আমার চাচা, মহিলারা আমার ফুপু। এতটুকু সম্মান দিতেই হয়। তাদের সেই দাবি আছে। তাই আগের বাপধন এখন ভাতিজায় পরিণত হলো। ‘ভাতিজা কি ফার্স্ট স্ট্যান্ড করছিলা?’

এই প্রশ্নের জবাব কী দেবো, বুঝলাম না। স্ট্যান্ড জিনিসটা বিলুপ্ত হয়েছে বহু দিন আগে। আমাদের ব্যাচ থেকেই তা নেই। থাকলেও লাভ হতো না। আমি বরাবরই গড় মাপের ছাত্র। তবে আমার আত্মীয়-স্বজনদের ব্যাপার তা না। তাদের মধ্যে এই কীর্তি গড়ার রেকর্ড আছে। গ্রামে একটা গল্প প্রায়ই শোনা যায়, দাদার সাথে রাগ করে আমার বড় চাচার গ্রামত্যাগের খবর। দুই বছর পর যখন বড় চাচা যখন পূর্ব-পাকিস্তান বোর্ডে পঞ্চম হয়ে গ্রামে ফিরে এলেন, বাবা-ছেলের সেই মিলন দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন ভিড় জমিয়েছিল।

‘ভাতিজা লেখাপড়া কী বিষয়ে করছ?’

বিজ্ঞাপন

‘জি পদার্থবিজ্ঞান।’

‘ওহ! নিউটনকে চেন? আইনস্টাইন?’

‘ব্যক্তিগত পরিচয় নাই। নাম শুনেছি। আচ্ছা এখন আমি যাই। আপনি কিছু খাবেন?’

‘জি, মিষ্টি দিয়ে পরোটা খাব।’

এই মিষ্টির মধ্যে সবাই কী পেয়েছে কে জানে! হোটেলের মালিককে বললাম, উনি যা খেতে চায় দিন। বিকেলে আমি সব দাম একেবারে দিয়ে যাব। গ্রামে আমি চাচ্ছিলাম নিজের মতো করে সময় কাটাতে। অতিরিক্ত কথা বলার স্বভাব আমার আছে, কিন্তু সবসময়ের জন্য না। কখনো কখনো আমি নিজের মধ্যে হারিয়ে যাই। তখন না কারও কথা শুনতে ভালো লাগে, না বলতে। আমার এই স্বভাবের জন্য আমার বিরুদ্ধে আমার প্রিয়জনদের অভিযোগ আছে।

যে লোকটির সাথে হোটেলে পরিচয় হয়েছিল, শুনলাম তার নাম কামাল। তিনি স্কুল শিক্ষক ছিলেন। এখন আর পড়ান না। জনশ্রুতি আছে, তিনি আইনস্টাইন ও নিউটন— এই দুই বিজ্ঞানীকে একসাথে ভুল প্রমাণ করেছিলেন। এতটুকু শোনার পর তার ব্যাপারে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। অসুস্থ একজন মানুষকে নিয়ে মজা করতে চাচ্ছি না। তবে গ্রামের কেউ কেউ দেখা যাচ্ছে ঠিকই বিশ্বাস করে বসে আছেন ব্যাপারটা। করুক গিয়ে। বাংলাদেশে অনেক ব্যক্তিত্বদের ভুল প্রমাণ করাটা কঠিন হতে পারে। দেশে অনেক দুর্নীতি থাকলেও তারা সবাই নির্দোষ। আইনস্টাইন-নিউটনকে ভুল প্রমাণ করা সেই তুলনায় অনেক সহজ হওয়ার কথা।

কামাল চাচা নিউটন আর আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করেছেন, কিন্তু কী ভুল প্রমাণ করেছেন— এই ব্যাপারটা কেউ বলতে পারে না। এটা নিয়ে মোটামুট হাসাহাসি হলো রাতে খাওয়ার সময়। তবে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, গ্রামের সহজ-সরল মানুষদের জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনো মজা করা হবে না। কয়েকদিনের জন্য মাত্র গ্রামে এসেছি, আদর-আপ্যায়নে কোনো কমতি তারা দেখাচ্ছেন না। আইনস্টাইন-নিউটনকে ভুল প্রমাণ করা কামাল চাচাকেই দেখলাম ভোর ৫টার সময় খেজুরের রস নিয়ে আসতে। খেজুরের রসে ‘নিপাহ’ ভাইরাস থাকার সম্ভাব্যতা বিবেচনায় সেটা অবশ্য খাওয়া হলো না। তবে কামাল চাচাকে ধন্যবাদ দেওয়া দরকার, তাই তার বাসা খুঁজে বের করলাম।

আগেকার দিনে গ্রামে প্রতিটি বাড়ির সামনে পুকুর থাকত, এখন খুব একটা নেই। কামাল চাচার বাড়ির সামনে আছে। কামাল চাচা বাড়ির উঠানে ঝাড়ু দিচ্ছিলেন। বাইরে থেকেই বোঝা যাচ্ছে, বাসার ভেতরটা অন্ধকার।

‘স্লামালাইকুম।’

‘আসো ভাতিজা। তুমি আসবা জানতাম।’

‘তাই নাকি! কেউ বলে গিয়েছিল আপনাকে?’

‘হ, আলো বলছিল।’

আলো নামে কারও সাথে অবশ্য আমার খাতির নাই। একবার ভাবলাম, এই আলো ছেলে না মেয়ে! তবে চাচাকে কিছু বললাম না।

‘আচ্ছা আচ্ছা। আলো বলাতে ভালো হয়েছে। আপনি এত কষ্ট করে খেজুরের রস এনেছিলেন দেখে ধন্যবাদ।’

কামাল চাচা চুপ করে থাকলেন। ঝাড়ু হাতে উঠানে বসে রোদ পোহাচ্ছেন। বিদেশে মানুষ অনেক আয়োজন করে সমুদ্রের পাশে বসে এই কাজ করে। তিনি গ্রামে বসেই তা করছেন।

‘চাচা কি এই বাসাতে একা থাকেন?’

‘জি ভাতিজা। তোমার চাচির মৃত্যুর পর থেকে তাই আছি।’

‘আচ্ছা আচ্ছা।’

‘খেজুরের রস তো খাইলা না ভাতিজা।’

চাচাকে এই খবরটা কে দিল, বুঝলাম না। কেউ একজন বলে গেছে যে পুরা খেজুরের রসটা ফেলে দেওয়া হয়েছে। এটা যে সেই আলোর কাজ, এটা বুঝতে রকেট সায়েন্স পড়া লাগে না।

আমি চোখ-মুখ ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে বললাম, ‘আসলে নিপাহ ভাইরাস নামে একটা ভাইরাস আছে। বাদুড়ের কারণে ছড়ায়। বাদুড় রাতে খেজুরের রসের হাড়িতে মুখ দিতে পারে।’

‘হ, এটাতেও দিছিল। তবে ভাইরাস ছিল না। আলো সব ভাইরাস পরিষ্কার কইরা দিছে।’

কী বলব বুঝতে পারলাম না। আমার এইখানে আসার খবর আলো দিয়েছে বুঝলাম। কিন্তু আলো কীভাবে ভাইরাস দূর করল?

চাচার ওখানে থাকার আর কোনো মানে পেলাম না, চলে আসলাম। কিন্তু মনের মধ্যে খচখচ করতে লাগল, নিপাহ ভাইরাস দূর করা চরিত্র সেই আলো কে? তাই একটু খোঁজ নেওয়া জরুরি মনে করলাম। আমার দুঃসম্পর্কের দাদিকে বললাম, ‘দাদি, আলো কে?’ দাদী বললেন, ‘আলোকে মুই চিনি না।’ বাহ! দাদি চেনে না আলোকে।

গ্রামে গেলে নয়ন নামে এক ছেলের সাথে আমার মাঝে মাঝে গল্প হয়। সেই নয়নকে এবার পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কষ্ট করে নয়নকে পাওয়া গেল। নয়ন মারফত যা জানা গেল তা হলো— কামাল চাচা আসলে আমার চাচা না, আমার ফুপা। কারণ তার মৃত স্ত্রী ছিলেন আব্বার দুঃসম্পর্কের বোন। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে উনি মারা যান। কামাল ফুপা আর বিয়ে করেননি। বাচ্চার বয়স তখন ২ বছর। বাচ্চাকে খাটে রেখে চাচা নামাজ পড়ছিলেন। কোনোভাবে বাচ্চা পুকুরে নেমে যায়। সলিল সমাধি হয় তার।

স্ত্রীর পর সন্তানের মৃত্যুতেও কামাল ফুপা তেমন কান্নাকাটি করেননি। এমনকি এক ফোটা চোখের পানিও নাকি ফেলেননি। সোজা কোরআন খতম করা শুরু করেন। এরপর তিনি শিক্ষকতাও ছেড়ে দেন। তার মধ্যে ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। বেশিরভাগ সময় ঘর অন্ধকার করে রাখতে শুরু করেন। তবে কিছুতেই তেমন বাড়াবাড়ি করেন না।

‘আচ্ছা, নিউটন-আইনস্টাইনকে ভুল প্রমাণ করার ব্যাপারটা কী?’

নয়ন তার নয়ন কপালে তুলে বলল, ‘এটা আবার কী জিনিস? এরকম কিছু নাই।’

নয়ন জানাল, কামাল ফুপা বিজ্ঞান পড়াতেন। সেখান থেকে কেউ মজা করে এমনটা বলে। উনি নাকি নিজে কখনই ভুল প্রমাণ করার কথা কিছু বলেননি।

আমি বললাম, ‘কিন্তু তিনি আমাকে একবার বলেছিলেন, আমি তাদের চিনি কি না!’

‘কী জানি কী খেয়ালে বলছে।’

‘আচ্ছা, তাহলে আলো নামে আমাদের গ্রামে কেউ থাকে না?’

‘না তো! গ্রামের বেবাকডি লোক আমি চিনি। এই নামে কেউ নাই।’

আলো বিষয়ক কোনো কিছু মীমাংসা করার ইচ্ছা আর নেই। তবে আলো ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার— খেজুরের রস থেকে নিপাহ ভাইরাস দূর করে। আলো আমার, আলো ওগো আলোয় ভূবন ভরা।

রাত সাড়ে ১২ টা গ্রামে অনেক রাত। গ্রামের এক জায়গার এক ব্রিজে বসে আছি আমি আর নয়ন। নয়ন সিগারেট খাচ্ছে। এই জিনিসের অভ্যাস আমার নেই জেনে সে অবাক। তার ধারণা, আমি সিগারেট খেলে দেশ-বিদেশ ‘কাঁপাইয়া’ দিতে পারতাম। শুধুমাত্র সিগারেট খাই না দেখে সেইটা আমাকে দিয়ে হচ্ছে না।

গ্রাম থেকে ব্যস্ততম নগরী ঢাকায় ফিরে এলাম। ঢাকা শহরের নিজস্ব প্রাণ, নিজস্ব গতি থেকে অনেকদিন দূরে ছিলাম। অফিসে কাজ করায় ব্যস্ত হয়ে গিয়েছি। একদিন এক ঘটনা ঘটল। ঘটনা নাকি অঘটন, বলা মুশকিল। এটা অবশ্য নজরে আসার মতো কিছুও না, কিন্তু আমার নজরে আসলো।

বাথরুমে গিয়েছি। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। কিন্তু বাথরুমের লাইট নিভে যাওয়ার পরও আমার বাথরুম আলোকিত! কীভাবে সম্ভব!!

বিদ্যুৎ না থাকার পরও বাথরুমে আলো জ্বলে থাকাই কেবল নয়, কয়েকদিন ধরেই আমার মধ্যে একরকম অস্বাভাবিকতা লক্ষ করতে পারছি। সেটা কী, আমি জানি না। পরিবর্তনটা খুব সূক্ষ্ম, স্থূল না। এগুলা খেয়াল করার আমার কোনো দরকার আছে কি না, আমি জানিও না।

অফিসে বড় স্যারের কাছে ফাইল নিয়ে গিয়েছি। ফাইল দিয়ে একটু দূরে দাঁড়িয়েও আমি ফাইলের কিছু লেখা দেখতে পাচ্ছি। কেন পাচ্ছি, জানি না। আমার চোখ অতিরিক্ত ভালো হয়ে গেল কি না, কে জানে! চোখ দেখাতে গেলাম। মেশিনে চোখ রেখে পরীক্ষা করে জানানো হলো— আমার চোখ স্বাভাবিক। চোখে কোনো সমস্যা নেই।

এক এক্সিবিশনে গেলাম ক’দিন পর। আবার এক ব্যাখ্যাতীত ঘটনা। পূর্ণ বিম্ব দেখতে হলে সমতল দর্পণকে কমপক্ষে আমার অর্ধেক হতে হবে। কিন্তু এক্সিবিশনের ছোট এক আয়নাতেই আমি নিজেকে পুরাপুরি দেখলাম! পাশের লোককে বললাম, ‘ভাই, আয়নাতে কি আমাকে পুরাপুরি দেখা যায়?’ তিনি আমার সমস্যা বুঝলেন না। বললেন, ‘ভাই, আপনি কি নিজেকে বাগদাদের রাজপুত্র মনে করেন? তাহলে সেই চিন্তা বাদ দেন।’

আমার এই অস্বাভাবিকতার সাথে কীসের যোগসূত্র, আমি জানি না। পরিবর্তনগুলা এতই ক্ষুদ্র যে কাউকে বলে বোঝাতে পারছি না। পাত্তা না দিলেও হয়, কিন্তু মনের মধ্যে খচখচানি চলছেই। অফিস থেকে কয়েকদিনের ছুটি নিলাম। আবার গ্রামের বাড়ি যাব। একবার হলেও কামাল ফুপার সাথে দেখা করব।

কামাল ফুপা অসুস্থ। তিনি গ্রাম থেকে দূরে কোনো এক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আছেন। তার শরীরের অবস্থা বেশ খারাপ। মুখ হাসি হাসি। আমি গিয়ে বললাম, ‘কেমন আছেন?’

‘‘ভালো আছি। তোমার ছুটি নিয়ে আসা ঠিক হয় নাই। ঢাকায় তোমার নামে খারাপ কথা হচ্ছে।’

‘আপনি কীভাবে বুঝলেন?’

‘আলো বলেছে আমাকে।’

এবার আর পারলাম না। প্রশ্নটা করেই ফেললাম, ‘আলোটা কে?’

‘আমার ২ বছরের বাচ্চার নাম রেখেছিলাম আলো। তখনও জানতাম না, আলো আমাকে বাধ্য করেছে এই নাম রাখতে। আলোকে তারা নিয়ে গেছে। আমাকেও নিবে। এরপর তোমার পিছে লাগবে।’

‘আমি না আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না!’

‘আলো সরলরৈখিক পথে চলে এবং যখন তা আমাদের চোখে আঘাত করে, তখন সেই সম্পর্কে দর্শনানুভূতি জাগায়। এটা আলোর খুব সাধারণ নিয়ম। আলো কণাধর্মী, আবার আলো তরঙ্গধর্মী। কিন্তু এটাই সব সত্যি না। আলো আমাদের এতটুকুই জানার অধিকার দিছে। এর থেকে বেশি জানতে গেলেই আলো আমাদের নিয়ে যায়। যাক বাবা, আমি এর থেকে বেশি জানি না।’

কামাল ফুপার কথা শুনে তখনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না। তবে ফুপা বলতে থাকেন, ‘আমি যেদিন জানতে পারি, সেদিন থেকে তারা আমার পিছনে লেগে আছে। সেদিন থেকে তারা আর সরলরৈখিক পথে চলে না। বক্রপথে চলে। অনেক কিছু আমাকে দেখায়। সমাবর্তন-অপবর্তনের স্বাভাবিক নিয়ম তারা আমাকে দেখায় না। আমার ২ বছরের বাচ্চাকে আলো পথ দেখায় পুকুরে নিয়া যায়।‘

‘তারা বলতে কাদের বোঝাচ্ছেন? এই তারা কারা?’

‘এত কিছু আমি নিজেও জানি না। কিন্তু সবকিছু মিলায়ে তারা আলো। সেকেন্ডে প্রায় ২৯ কোটি ৯৭ লাখ ৯২ হাজার ৪৫৮ মিটার চলে। এটা আসলে আমাদেরকে দেখানোর জন্য।’

‘পৃথিবীতে এত এত নামকরা বিজ্ঞানী থাকতে আলো এই ব্যাপারগুলা আপনাকে বোঝাতে গেল কেন?’

‘হয়তো অনেকেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু কেউ প্রকাশ করেনি। সেই বিজ্ঞানীর মতো পরিণতি কেউ চায়নি যিনি বলেছিলেন, পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরে, আর সেটা বলার জন্য তাকে হত্যা করা হয়।’

‘শুনুন, ল্যাবরেটরি প্রমাণ ছাড়া বিজ্ঞান হয় না। জোর করে কথা বলার কোনো মানে হয় না।’

‘আমার ২ বছরের বাচ্চার নাম ছিল আলো। আলোরাই তাকে সৃষ্টি করেছে। আলোরাই তাকে নিয়ে গিয়েছে। কারণ আলোদের গোপন ব্যাপার আমি ধরে ফেলেছি। এখন তুমি কিছু কিছু জানবা। তোমাকেও নিয়ে যাবে। আমাকে নিতে দেরি করেছে। কারণ আমি কাউকে ব্যাপারটা বোঝাতে পারি নাই। আমি নিজেই ব্যাপারটা বুঝি নাই, আমি আর অন্যদের বোঝাব কী! আলো নিয়ন্ত্রণ করা যায়। চেষ্টা করলে পারবা।’

‘আমাকে বলার মতো আপনার আর কিছু আছে?’

‘না, নাই। তবে আমি জানি খুব তাড়াতাড়ি তুমি আলো ব্যবহার করতে পারবা। তবে আলোর ব্যাপারটা পছন্দ হবে না। যেই মুহূর্তে তুমি আলোকে ব্যবহার করা শুরু করবা, আলোরা তোমার পিছনে লেগে যাবে।’

আলো আমার সাথে আর কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করেনি। আলোকে কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তাও জানি না। গাঁও-গেরামের কেউ একজন বলবে আলোর সূত্র ভুল আর তার কথা শুনে বসে থাকতে হবে, এমন মনে করার কোনো কারণ নেই। ২ মাস পরে কামাল ফুপার মৃত্যু হয়। স্বাভাবিক মৃত্যু। শুধু শুধু আলোকে দোষ দেওয়ার কোনো কারণ দেখি না।

ক্রিকেট খেলা দেখতে গিয়েছি স্টেডিয়ামে। বাংলাদেশ বনাম অস্ট্রেলিয়া। শেষ ওভারে অস্ট্রেলিয়ার দরকার ৬ রান, হাতে ১ উইকেট। বাংলাদেশের বোলার যে বলটা করল, সেটা ফুলটস। অনায়াসে ছয় মেরে দিবে। আহা, কোনোভাবে যদি বলটা মিসটাইমিং হয়! ব্যাটসম্যান বলটা না দেখে!

হঠাৎ আমার কাছে মনে হলো, ব্যাটসম্যান বলটা নাও দেখতে পারে। কোনোভাবে বলটা থেকে যে আলো বের হবে, সেটা সরলরৈখিক পথে নেওয়া যাবে না। বক্রপথে ব্যাটসম্যানের চোখকে আঘাত করবে। আমার কল্পনায় স্পেকট্রামের সব রঙ। একেকটা একেক তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের। ব্যাটসম্যান কোনো কারণে ফ্লাইট মিস করেছে। বোল্ড। জিতে গেছে বাংলাদেশ।

আমি কি সত্যিই আলোকে ব্যবহার করে ফেলেছি? আলোরা তাহলে এখন আর আমাকে ছাড়বে না! নাকি পুরোটাই ভ্রম, যা হওয়ার তাই হয়েছে! আমাদের জেতার কথা ছিল, জিতেছি। শুধু শুধু কামাল ফুপার কথা ভেবে লাভ নেই। আলো আসলে কিছুই না। আলো এক ধরনের শক্তি বা বাহ্যিক কারণ, যা চোখে প্রবেশ করে দর্শনের অনুভূতি জন্মায়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন