বিজ্ঞাপন

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিক কার্যকলাপ

November 13, 2022 | 2:58 pm

সামিহা খাতুন

বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এর ব্যবহার। আর এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চার দেয়ালের মাঝে মানুষ প্রকৃতপক্ষে নিজের জীবন উপভোগ করাকেই যেন ভুলে গেছে। ইমেইল, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, ভাইবার, লিংকডইন জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যম। এদের মধ্যে শীর্ষে রয়েছে ফেসবুক। এসমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো প্রতিটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সাথে নানা ভাবে জড়িয়ে রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর যেমন উপকারিতা রয়েছে অপরদিকে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ফলেই মানুষের মাঝে সৃষ্টি হচ্ছে অশান্তি। এ সমস্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম যেন আমাদেরই সমাজের দর্পণ হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজে ইতিবাচক এর চেয়ে নেতিবাচক চিন্তার মানুষ যে বেশি এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বদৌলতে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বেড়েছে একে অপরের জীবনের সাথে তুলনা, অন্যকে অনুকরণ করার প্রবণতাসহ নানা ধরনের অসামাজিক আচরণ। দিন দিন মানুষের প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়েছে, মানুষে মাঝে সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়েছে। সভ্যতার আদি যুগ থেকেই মানুষ সামাজিক জীব। সামাজিক মাধ্যমের দৌরাত্ম্য মানুষের এ চিরন্তন পরিচিতির সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাড়িয়েছে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বুঁদ হয়ে থাকার কারণে মানুষের মাঝে তৈরি হচ্ছে হতাশা ও বিষণ্নতা। ক্রমেই তারা অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। অনলাইনে যোগাযোগের বিষয়টিকে প্রাধান্য দেওয়ায় সরাসরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে তাদের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা কমছে। অনেকক্ষেত্রে অন্যদের ছবিতে লাইক বা কমেন্ট বেশি হলে তারা ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়ছে। তাছাড়া প্রেম সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে খুন, মারামারি এবং আত্মহত্যার প্রবনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এসবকিছুই হচ্ছে অধিক সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করার কারণে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর প্রতি আসক্তি আমাদের তরুণ সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। পড়ালেখা ও সুস্থ বিনোদন ছেড়ে তারা স্মার্টফোনে অধিক সময় ব্যয় করছে। শুধু তাই নয়, অনেকক্ষেত্রে ফেসবুক, টিকটকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অধিক লাইক পাওয়ার আশায় তারা নানা ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে মূল্যবান সময় যেমন নষ্ট হচ্ছে তেমনই তাদের প্রাত্যহিক জীবনেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের জীবনের একটি অংশ হলেও এটি আমাদের থেকে কোন না কোন ভাবে কেড়ে নিচ্ছে আমাদের সুন্দর সময় গুলো।

বিজ্ঞাপন

এখনকার শিশু কিশোররা গল্প, উপন্যাস, কবিতা পড়তে শেখে না, তারা সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলায় মত্ত হয়না, তারা বাগান করেনা, মাঠে খেলতে যাওয়ার তাড়া তাদের নেই। তাদের সুন্দর দিনে গুলো শেষ হয়ে যাচ্ছে এই সমস্ত সোশ্যাল মিডিয়ায়। সামাজিক মাধ্যমে মাত্রাতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে গিয়ে প্রতি বছর কত বইয়ের পাঠক, গানের শ্রোতাও, মাঠের খেলোয়াড় এদেশ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে তা গবেষণার দাবি রাখে। একঘরে থেকেও তারা বিচ্ছিন্ন, এক আড্ডায় থেকেও সবাই সবার কাছ থেকে দূরে। ইমেইল, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবে বুঁদ হয়ে আছে প্রতিটি প্রাণ। কেউ কারও সঙ্গে ভাববিনিময় করছে না, কথা বলছে না। চিন্তার বিষয় হচ্ছে এতে কারও কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। তথ্যপ্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত উত্থান এক কল্পিত জগৎ তৈরি করেছে। ছবি, শব্দ, লেখার সাহায্যে সামাজিক মাধ্যমে যে জগৎ তৈরি হচ্ছে সেটি কৃত্রিমতায় ভরপুর। এটি গ্রাস করে নিচ্ছে আমাদের সুন্দর বাস্তব জগৎকে। সৃজনশীলতা ও মননশীলতা অন্য প্রাণী থেকে মানুষকে আলাদা করেছে। দিন দিন আনন্দ, বেদনা, ভালোবাসা, অভিমানের মতো মানবীয় অনুভূতি গুরুত্ব হারাচ্ছে। জ্ঞানের পরিধিও সংকুচিত হচ্ছে। এগুলো ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলে নিজেদের প্রদর্শনের এক অসুস্থ প্রতিযোগীতা। একটি নতুন পোশাক পরিধান, কোনো রেস্টুরেন্টে যাওয়া, দামী মোবাইল বা ডিভাইস ব্যবহার, নিজের হাতে কোনো খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করার মতো সাধারণ বিষয়গুলো উদযাপনের উপলক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুকের কল্যাণ। এজন্যই বোধ হয় বেগম রোকেয়া বলেছিলেন, বিলাসিতা ওরফে সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গে অনুকরণপ্রিয়তা নামক একটি ভূত মানুষের স্কন্ধে চাপিয়া আছে। একজনকে অনুকরণ করা, সাইবার বুলিং এর শিকার হওয়া যেন নিত্যদিনের ঘটনা। এই সকল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলোর সাহায্যে অতি সহজে কোনো বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া ও ক্ষেত্র বিশেষে কোনো অসাধু চক্র দেশে অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে সরকারসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিবিশেষের নামে অপপ্রচার চালিয়ে থাকে।

বিদ্বেষ, রুচিবিকৃতি ও উগ্রবাদ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে উঠেছে ফেসবুক। গোয়েবলস বলেছিলেন, একটি মিথ্যা কথা দশবার বললে এটি সত্য হয়ে যায়। গোয়েবলসের তত্ত্ব প্রচারের ধারক হয়ে উঠেছে সামাজিক মাধ্যমগুলো। এছাড়াও বিভিন্ন নিষিদ্ধ দল ও গোষ্ঠী ভুয়া আইডি ব্যবহার করে কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ বিকৃতভাবে উপস্থাপনের মাধ্যমে প্রায়শই অপপ্রচার চালায়, যা সমাজে একে অপরের প্রতি বিরূপ মনোভাব, হিংসা, বিদ্বেষ তৈরি করে। এ সকল অপপ্রচার আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। যে কোনো বিষয়ে মতভিন্নতা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পর্যবসিত হয় কদর্য গালমন্দে। ধর্ম ও জেন্ডারের মতো সংবেদনশীল বিষয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে অনেকেই শালীনতার সীমা অতিক্রম করেন।কিছু ব্যক্তি কোনো ইস্যু কে কেন্দ্র করে ট্রলের মাধ্যমে বিপন্ন করে তোলেন কোনো ব্যক্তির জীবন।আর ব্যক্তিটি যদি হয় নারী, তাহলে আক্রমণের মাত্রা বেড়ে যায় কয়েকগুণ । ‘ট্রল’ নামে অভিহিত এ অনাচারকে ‘ভার্চুয়াল গণপিটুনি’ আখ্যা দেওয়াই বোধহয় বেশি সঙ্গত৷। এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ট্রলের শিকার হয়ে আত্মহত্যার ঘটনার নজিরও রয়েছে। প্রমথ চৌধুরী বলেছিলেন, ‘ব্যাধিই সংক্রামক, স্বাস্থ্য নয়।’ সংক্রামক ব্যাধির মতোই অপসাংবাদিকতা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমের দেয়ালজুড়ে। প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মাধ্যম এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। যে দ্বীপ আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে আমাদের পরিবার থেকে, আত্মীয়তা থেকে, নিজেদের সৃজনশীল চিন্তা চেতনার বিকাশ ঘটানো থেকে, সামাজিকতা পালনের থেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অসামাজিকতা অপরাধপ্রবণতার জন্ম দিচ্ছে। বিখ্যাত ‘দৃষ্টিপাত’ বইয়ে যাযাবর লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ এ অকাট্য উচ্চারণের যথার্থতা নিয়ে বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো সন্দেহ প্রকাশ করার অবকাশ নেই । সামাজিক মাধ্যমের অপব্যবহার এ স্বার্থপরতাকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। সামাজিক মাধ্যমে কোনো ইতিবাচক চর্চা যে হচ্ছে না এমন নয়। কিন্তু নেতিবাচক ভূমিকার কাছে সেটি ম্লান হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম অজস্র কবি, সংগীতশিল্পী, অভিনেতা, নির্মাতার জন্ম দিচ্ছে, অগণিত ‘ভিউ’ ও ‘শেয়ার’ হচ্ছে। তাদের মধ্যে কত শতাংশ আসলেই প্রতিভাবান সেটি আমরা ভেবে দেখেছি না। অযোগ্যদের প্রাদুর্ভাবে প্রকৃত প্রতিভা যে আড়ালে চলে যাচ্ছে সেটি বড় দুশ্চিন্তার বিষয়।গভীরভাবে চিন্তা করার, কোনো কিছু তলিয়ে দেখার অবকাশ নেই সামাজিক মাধ্যমে।এর মূলধন হচ্ছে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া। এভাবে একটি অস্থির জনগোষ্ঠী তৈরি হচ্ছে এদেশে।

বর্তমান প্রজন্মকে এই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অসামাজিকতা থেকে রক্ষা করার জন্য অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি শিশুই অনুকরণ প্রিয় হয়ে থাকে। তারা বড়দের যা করতে দেখে তাই নিজেদের মধ্যে আত্মস্থ করে ফেলে। শিশুদের সামাজিক বিকাশের ক্ষেত্রে বড়দেরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েই যাচ্ছে। একটি শিশুর সামনে কেউ যদি প্রতিনিয়ত বই পড়ে, বাগান করে, গান করে, ছবি আঁকে বা নানা রকম প্রোডাক্টিভ কাজে নিজেদের জড়িয়ে রাখে শিশুরা তখন সেগুলোই অনুকরণ করে। এগুলো ছাড়াও কিশোর তরুণদের নিয়মিত বই পড়ার, নানারকম সামাজিক কর্মকাণ্ডের সাথে নিজেদের যুক্ত করার, নিজেদের মূল্যবান সময়গুলো কোন প্রডাক্টিভ কাজ বা কোন স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদির মাধ্যমে ব্যয় করা।পরিবারের সদস্যদের উচিত অবসর সময়ে সকলে মিলে আড্ডা দেওয়া। এছাড়াও নানারকম সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানারকম অপব্যবহার ও সময়ের অপচয় সম্পর্কে দেশের সাধারণ মানুষদের সচেতন করার জন্য নানা রকম সেমিনার ও প্রচার-প্রচারণা করা। সর্বোপরি আশা রাখাই যায় সকল নেতিবাচকতার মধ্যেও ইতিবাচক দিক গুলো গ্রহন করে একটি সুন্দর প্রজন্ম তৈরি হবে।

বিজ্ঞাপন

লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই/এএসজি

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন