বিজ্ঞাপন

পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে শেখ হাসিনার কাছে নাছির-সুজনরা

February 19, 2023 | 8:45 pm

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: পাল্টাপাল্টি অভিযোগ নিয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে গিয়েছিলেন দলটির চট্টগ্রাম মহানগরের নেতারা। নগর আওয়ামী লীগ ও তৃণমূলের ‘ঝুলে থাকা’ সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ জানাতেই নেতারা হাজির হয়েছিলেন গণভবনে। অভিযোগ পাল্টা অভিযোগের পর সভানেত্রী শেখ হাসিনা ওয়ার্ড ও থানার পরই নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার নির্দেশ দিয়েছেন বলে নেতারা জানিয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

সম্মেলন নিয়ে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে থাকা চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের নেতারা রোববার (১৯ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে রাজধানীতে গণভবনে যান। ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের নেতৃত্বে তাদের অনুসারীরা একসঙ্গে গণভবনে প্রবেশ করেন। সহসভাপতি নঈম উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক নোমান আল মাহমুদ, স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক ফয়সল ইকবাল চৌধুরী, সদস্য বিজয় কিষাণ চৌধুরী, বেলাল উদ্দিনসহ আরও কয়েকজন এ অংশে ছিলেন।

অন্যদিকে মাহতাব-নাছির বিরোধী হিসেবে পরিচিতরা একসঙ্গে গণভবনে ঢোকেন। এদের মধ্যে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, খোরশেদ আলম সুজন, জহিরুল আলম দোভাষ, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, কোষাধ্যক্ষ আবদুচ ছালামসহ আরও কয়েকজন নেতা ছিলেন।

সহসভাপতি ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল সারাবাংলাকে জানান, সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নগর আওয়ামী লীগের নেতারা গণভবনে প্রবেশ করেন। দেড়টার দিকে শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ফটোসেশন করে নেতারা বেরিয়ে যান।

বিজ্ঞাপন

সভানেত্রীর ডাকে গণভবনে গিয়েছিলেন কি না? জানতে চাইলে বাবুল বলেন, ‘নেত্রী ডেকেছেন এটা বলা যাবে না। সাংগঠনিক বিষয়ে বলার জন্য আমরাই নেত্রীর কাছে যাওয়ার সুযোগ চেয়েছিলাম। নেত্রী সম্মত হওয়ার পর আমাদের সাক্ষাতের সময় দেওয়া হয়। সাংগঠনিক বিষয়ে আমরা আমাদের বক্তব্য উনার কাছে তুলে ধরেছি।’

আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সম্মেলন হয়েছে গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর। এর আগে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন করার নির্দেশনা থাকলেও কয়েক দফা সময় ঘোষণা করেও শেষ পর্যন্ত হয়নি। এমনকি ওয়ার্ড-থানার সম্মেলনও সম্পন্ন হয়নি। শুধুমাত্র ইউনিট সম্মেলনগুলো সম্পন্ন হয়। মাহতাব-নাছির বিরোধীদের অভিযোগ, দুই শীর্ষ নেতার অনীহার কারণেই কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আগে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন সম্পন্ন করা যায়নি।

গণভবনে যাওয়া নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাহতাব-নাছিরের বিরোধীরা সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে সম্মেলন না হওয়ার জন্য এই দুই নেতাকে দায়ী করেন। তারা অভিযোগ করেন, ইউনিট কমিটিগুলো সাংগঠনিক বিধিবিধান ও গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করে একতরফাভাবে করা হয়েছে। কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে সম্মেলন নিয়ে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছিল, মাহতাব-নাছিরের বাধায় সেগুলো বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় ওয়ার্ড এবং থানা কমিটির সম্মেলনও একতরফাভাবে করে ফেলতে চাচ্ছেন তারা।

বিজ্ঞাপন

মাহতাব-নাছিরের বিরোধীরা প্রথমে নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন শেষ করে নতুন নেতৃত্বের তত্ত্বাবধানে ওয়ার্ড এবং থানা সম্মেলন করার দাবি জানান। অন্যদিকে, আ জ ম নাছির উদ্দীন সকল অভিযোগ খণ্ডন করেন। কী কী কারণে সম্মেলন করা যায়নি, কারা কারা বাধা দিয়েছেন এসব বিষয় তিনি সভানেত্রীর সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি ওয়ার্ড ও থানায় সম্মেলন শেষ করে নগর কমিটির সম্মেলন করার দাবি জানান।

জানা গেছে, পাল্টাপাল্টি অভিযোগ জানানোর সময় নেতাদের মধ্যে কয়েকদফা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময় হয়। সভানেত্রী শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করে পরিস্থিতি সামাল দেন। জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহ সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বলেছি, ওয়ার্ড সম্মেলন হবে থানা কমিটির অধীনে। কিন্তু বেশ কয়েকটি থানায় তো স্ট্রাকচারই ঠিক নেই। তারা সম্মেলন করবে কিভাবে? সেজন্য আমরা আগে নগর কমিটি সম্মেলন করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। নেত্রী সবকিছু শুনেছেন। তিনি সাংগঠনিক ধারাবাহিকতা রক্ষায় আগে তৃণমূলের সম্মেলন শেষ করতে বলেছেন। নগর আওয়ামী লীগের বিষয় সভানেত্রী নিজে ঠিক করবেন বলে জানিয়েছেন।’

নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন সারাবাংলাকে বলেন, ‘অনেকদিন পর নেত্রীর সামনে সাংগঠনিক বিষয়ে একেবারে খোলাখুলি আলাপ করেছি। সাংগঠনিক নানা প্রসঙ্গের মধ্যে সম্মেলনের প্রসঙ্গও এসেছে। নেত্রীর সামনে উনারা উনাদের কথা বলেছেন, আমরা আমাদের বিষয় বলেছি। নেত্রী আমার যে প্রস্তাব অর্থাৎ আগে ওয়ার্ড ও থানার সম্মেলন এরপর নগরের সম্মেলন সেটির বিষয়ে সম্মতি দিয়েছেন।’

নগর আওয়ামী লীগের বিষয়ে সভানেত্রী সিদ্ধান্ত দেবেন- বিরোধীদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে নাছির বলেন, ‘এমন কোনো কথা সভানেত্রী বলেননি। তিনি ওয়ার্ড-থানার পর নগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হবে, এই সিদ্ধান্তই দিয়েছেন।’

বিজ্ঞাপন

২০২১ সালের শেষদিকে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সম্মেলন শুরু হলে বিরোধ চাঙ্গা হয়। নেতারা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েন। ওই বছরের ১৬ নভেম্বর থেকে নগরীর ৪৪টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডে ইউনিট সম্মেলন শুরু করে নগর আওয়ামী লীগ। সেই সম্মেলন নিয়ে সংঘাত ও বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ ওঠার পর কেন্দ্র থেকে ওই বছরের ২৩ ডিসেম্বর ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।

তৃণমূলের সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পরস্পর বিরোধী দু’টি ধারার বিরোধ আরও জোরালো হয়। দু’টি ধারার একটির নেতৃত্বে মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও আ জ ম নাছির উদ্দীন আছেন। আরেকটি ধারা প্রয়াত নেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত। মহিউদ্দিনপুত্র শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল উভয়পক্ষকে ‘এক রাখার’ চেষ্টা করেন মাঝে মাঝে।

ইউনিট সম্মেলনের শুরু থেকেই মহিউদ্দিনের অনুসারীরা অভিযোগ করে আসছিলেন, মাহতাব-নাছিরের একক কর্তৃত্ব ও ইচ্ছায় তৃণমূলে সম্মেলন হচ্ছে। বিভিন্ন ইউনিটে মহিউদ্দিন অনুসারী নেতাকর্মীদের বিভিন্ন কৌশলে সদস্য করা হয়নি। তাদের বাদ দিয়েই সম্মেলন করে এক নেতার অনুসারীদের মাধ্যমে কমিটি করে ফেলা হয়েছে।

এ অবস্থায় ইউনিট সম্মেলন নিয়ে বিরোধ নিরসনে ২০২২ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্র থেকে পাঁচ সদস্যের একটি ‘রিভিউ কমিটি’ গঠন করে দেওয়া হয়েছিল। কমিটির সদস্যরা হলেন- নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, নগর কমিটির সদস্য শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন এবং সহসভাপতি নঈমউদ্দিন চৌধুরী ও জহিরুল আলম দোভাষ।

রিভিউ কমিটি কেন্দ্রের অনুমতিক্রমে ১৫ সাংগঠনিক থানার জন্য নগর আওয়ামী লীগের একজন করে নেতাকে দায়িত্ব দিয়ে ১৫টি সাংগঠনিক টিম গঠন করে। তাদের ইউনিট সম্মেলন নিয়ে অভিযোগ যাচাই-বাছাইপূর্বক দ্বন্দ্ব-সংঘাত নিরসন করে ঐক্যবদ্ধভাবে তৃণমূলের সম্মেলন সম্পন্ন করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু বিরোধ মেটেনি। ফলে ইউনিট সম্মেলন শেষ হলেও ওয়ার্ড এবং থানাগুলো ঝুলে আছে।

গত ১১ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরীর ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের সম্মেলন সম্পন্ন হয়। কেন্দ্রের নির্দেশে সম্মেলনের কথা বলা হলেও মাহতাব-নাছিরের বিরোধীরা হঠাৎ ওয়ার্ডে সম্মেলন নিয়ে আপত্তি জানান। এই প্রেক্ষাপটে সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে যান নেতারা।

২০০৫ সালে সর্বশেষ চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন হয়েছিল। এতে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও কাজী ইনামুল হক দানু। দানু মারা যাবার পর ২০১৩ সালে কেন্দ্র থেকে একটি কমিটি ঘোষণা করা হয়, যাতে মহিউদ্দিনকে সভাপতি ও আ জ ম নাছির উদ্দীনকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। ২০১৭ সালের ১৫ ডিসেম্বর মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর প্রথম সহসভাপতি মাহতাব উদ্দীন চৌধুরীকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন