বিজ্ঞাপন

এসডিএসে আটকা ৫ হাজার গ্রাহকের ১৯ কোটি টাকা

April 30, 2023 | 10:22 pm

গোলাম সামদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট টাঙ্গাইল থেকে ফিরে

ঢাকা: টাঙ্গাইলের সদর উপজেলায় সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সংসদে (এসডিএস) আটকে রয়েছে গ্রাহকের লগ্নি করা ১৯ কোটি টাকা। প্রতিষ্ঠানটিতে গ্রাহকের কোটি কোটি টাকা আটকে থাকলেও এসডিএস‘র সম্পদটি লুটেপুটে খাচ্ছে স্থানীয় প্রভাবশালী মহল। ২০০১ সালে প্রতিষ্ঠানটি দেউলিয়া হওয়ার পর গত ২২ বছর ধরে ৫ হাজার গ্রাহক এক টাকাও ফেরত পাননি।

বিজ্ঞাপন

দ্বিগুণ মুনাফার আশায় এই প্রকল্পে অর্থলগ্নি করে প্রতারিত হওয়া গ্রাহকদের অর্থ ফেরত পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন এসডিএস‘র ১৫২ একর জমি। কিন্তু সেই জমি থেকে স্থানীয় কিছু প্রভাবশালীর ভেকু দিয়ে রাতের আঁধারে মাটি কেটে নিয়ে বিশাল বিশাল গর্ত সৃষ্টি করেছে। শুধু তাই নয় এসডিএস জমি সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদীর ওপর নিমির্ত ব্রিজের নিচ থেকেও মাটি কেটে নিচ্ছেন প্রভাবশালীরা। ফলে  হুমকির মুখে পড়েছে ব্রিজটি।

এই অবস্থায় ৫ হাজার গ্রাহকের স্বার্থসংশ্লিষ্ট এসডিএস‘র জমি ও ধলেশ্বরী নদীর ব্রিজটি রক্ষায় উদ্যোগ নিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহক, স্থানীয় বিশিষ্ট নাগরিক ও জনপ্রতিনিধিরা। তাদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছে ৪৭ সদস্যবিশিষ্ট এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রিজ রক্ষা একটি কমিটি। সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলে গিয়ে এমন চিত্র দেখা গেছে।

সেতুর নিচ থেকেও কাটা হচ্ছে জমি

সেতুর নিচ থেকেও কাটা হচ্ছে মাটি

সরজমিনে গিয়ে এসডিএস সদস্য, রক্ষা কমিটি ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১৯৯৫-৯৬ সালের দিকে ১৫২ একর বা ৫০০ বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠে এসডিএস ফার্ম প্রকল্পটি। প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের ক্ষুদ্র বিনিয়োগে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রকল্পের অবস্থা ছিল রমরমা, ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে গ্রাহক। কিন্তু ২০০১ সালে এসডিএস গ্রাহকের টাকা না দিয়ে হঠাৎ করে প্রকল্পটি বন্ধ করে পালিয়ে যায়। অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে ৫ হাজার সদস্যের টাকা। তবে প্রকল্প বন্ধ থাকলেও জমি পড়ে থাকে। এরমধ্যে গত ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসে বিএনপি-জামায়াত সরকার। এসময় এখানে লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তৎকালীন বিএনপির স্থানীয় নেতা কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান সুমন আহমেদ ও কিছু প্রভাবশালীর। দেওয়ান সুমন ও তার লোকজন প্রথমেই প্রায় পুরো প্রকল্পের জায়গাকে বিরানভূমিতে পরিণত করে ফেলেন। এরপর মাটি বিক্রি করা শুরু করেন। গত দেড় দশকে জমি থেকে কোটি কোটি টাকার মাটি কেটে নিয়ে বিক্রি করায় বর্তমানে এসডিএস‘র প্রায় ৫০০ বিঘা সমতল ভূমিতে সৃষ্টি হয়েছে বিশাল বিশাল গর্ত।

বিজ্ঞাপন

এ ব্যাপারে এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রীজ রক্ষা কমিটিরি আহ্বায়ক দাইন্যা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আফজাল হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এসডিএস প্রকল্পটি বেশি মুনাফা দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নেয়। যা ২০০২ সালের দিকে বিলুপ্ত হয়। এতে প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় ৫ হাজার গ্রাহকের লগ্নি করা ১৯ কোটি টাকাও আটকে যায়। সেই হিসাবে দাইন্যা, কাতুলী ও পোড়াবাড়ী ৩ ইউনিয়নের সীমানা বরাবর এসডিএস প্রকল্পের জমির ৫ হাজার সদস্যর লগ্নি করা টাকা দিয়েই কেনা। সেই হিসেবে জমির অধিকারও তাদের। এই কথায় মাথা রেখেই সম্প্রতি আমরা গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার শেষ অবলম্বন জমিটি রক্ষার উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে এই জামিটি নিতে অনেকেই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। জমিটি বিক্রি করা সম্ভব হলে ৫ হাজার গ্রাহকের দীর্ঘদিনের কষ্ট লাঘব হবে। তারা তাদের টাকা ফেরত পাবেন।’

তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইল সদর আসনের ১১ নং কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা দেওয়ান সুমন আহমেদ ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা মিলে জমির মাটি কেটে নিচ্ছেন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগেরও কিছু লোকও তাদের এ কাজে সহায়তা করছেন। এভাবে মাটি কেটে নিতে থাকলে এ জমির আর কিছু করা সম্ভব হবে না। এমনকি তারা ধলেশ্বরী ব্রিজের নিচের মাটি কেটে নিচ্ছে। এর ফলে তারাবাড়ি তোরাবগঞ্জ রাস্তাটিও হুমকির মুখে পড়েছে। এ নিয়ে মানবন্ধন করাসহ প্রসাশনের কাছে আমরা স্মারকলিপিও দিয়েছি। কিন্তু প্রতিকার পাচ্ছি না।’

কেটে ফেলা হচ্ছে জমির মাটি

কেটে ফেলা হচ্ছে জমির মাটি

অন্যদিকে প্রতিরোধ কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ও কাতুলী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেনে বলেন, ‘এসডিএস রক্ষা করার প্রধান কারণ হলো এখানকার স্থানীয় লোকজন প্রতিষ্ঠানটির কাছে ১৯ কোটি টাকা পাবেন। আমাদের চিন্তা-চেতনা হলো আমরা যদি ভূমিদস্যুদের কাছ থেকে এই সম্পদ রক্ষা করতে পারলে গ্রাহকরা তাদের টাকাটা অনন্তত সরকারের মাধ্যমে বুঝে পাবে। কিন্তু তার আগেও তো সম্পদটা রক্ষা করতে হবে।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘এসডিএসের পাশে ধলেশ্বরী নদী, এই নদীর ওপর একটা বড় ব্রিজ রয়েছে, যেটি এসডিএস জমি সংলগ্ন। ধলেশ্বরী নদীর ব্রিজ থেকে মাটি তুলে নেয়ার কারণে ব্রিজের পিলারগুলো ঝুকির মুখে পড়েছে। ফলে যে কোনো সময় ব্রিজটি ধসে পড়তে পারে।’

এসডিএস প্রকল্পের সদস্য টাঙ্গাইল ফতেহপুর এলাকার বাসিন্দা মো শহিদুল ইসলাম জানান, ১৯৯৭-৯৮ দিকে ৫ বছর দিগুণ মিলবে এমন কথায় এসডিএস প্রকল্পে ৩ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তিনি। প্রতিমাসে তাকে সুদও দেওয়া হতো। কিন্তু হটাৎ প্রকল্প বন্ধ হয়ে গেলে তার টাকাও আটকে যায়।

আরেক গ্রাহক ইসলাম হোসেন আইয়ুর বলেন, আমি গ্রাহকের সন্তান। আমার বাবা মো. আসাদ আলী গ্রাহক ছিলেন। তিনি ১৯৯৭ সালে সরকারি পেনশন পেয়ে এসডিএসে চার লাখ টাকা মুনাফার বিনিময়ে বিনিয়োগ করেন। কিছুদিন আমরা লাভও পেয়েছি। কিন্তু হঠাৎ এসডিএস বিলুপ্ত হয়ে যায। তারপর বিভিন্ন সন্ত্রাসীরা এখানকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায। মালিক ইসমাইল হোসেন সিরাজি জেলে চলে যায়। ফলে আমরা চাই এসডিএস জমি রক্ষা পাক।

অন্যদিকে এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রীজ রক্ষা কমিটির সদস্য সচিব ও টাঙ্গাইল সদর উপজেলা শ্রমিক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও সাবেক উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান আব্বাস আলী খান সারাবাংলাকে বলেন, ‘এই প্রকল্প থেকে প্রতিনিয়ই কোটি টাকার মাটি কেটে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে এই ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। এর প্রতিবাদে আমরা আন্দোলন করছি।’

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘প্রতি রাতে ৪/৫টি করে ভেকু দিয়ে মাটি কেটে ৩০/৪০ টি ড্রাম ট্রাক দিয়ে মাটি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে গ্রাহকরা খুবই অসহায়, বর্তমানে তাদের কেবল চোখের পানি পড়ছে। ফলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমি অনুরোধ করছি যাতে তিনি ডিসি এসপি বলে সম্পদটি রক্ষা করেন।’

ছবিতে এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রীজ রক্ষা কমিটির সদস্যরা

ছবিতে এসডিএস ও ধলেশ্বরী ব্রীজ রক্ষা কমিটির সদস্যরা

অভিযুক্ত কাতুলী ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিএনপি নেতা দেওয়ান সুমন আহমেদের বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা বলে দাবি করে তিনি জানান, রাজনৈতীক প্রতিপক্ষ তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য এমনটি করছে।

এ বিষয়ে টাঙ্গাইল সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) রানুয়ারা খাতুন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে আমরা নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। কিন্তু সমস্যা হয়েছে চক্রটি দিনে মাটি না কেটে রাতে মাটি কাটছে। রাতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা যায় না, ফলে সেভাবে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘আজও (৩০ এপ্রিল) সেখানে মোবইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। এর আগে আমরা সেখানে মোবইল কোর্ট পরিচালনা করে ভেকুও জব্দ করেছি।’

অন্যদিকে টাঙ্গাইল সদর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আবু ছালাম মিয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের বিষয় দেখার জন্য পরিবেশ অধিদফতরসহ অন্যান্য দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা রয়েছে। তবে আমাদের কাছে অভিযোগ এলে আমরা ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।’

সারাবাংলা/জিএস/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন