বিজ্ঞাপন

‘বিরোধ-বিতর্কে’ ছিটকে পড়লেন সামশুল-দিদারুল

November 26, 2023 | 8:59 pm

রমেন দাশ গুপ্ত, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামের ১৬টি আসনের প্রায় সবকটিতে ঘুরেফিরে আগের সংসদ সদস্যরাই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও ছিটকে পড়েছেন দুজন। এ ছাড়া দলটির বর্ষীয়ান নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন নিজেই নির্বাচনে অনাগ্রহ প্রকাশ করলে তার ছেলে মাহবুব রহমান রুহেলকে বেছে নিয়েছে আওয়ামী লীগ।

বিজ্ঞাপন

ছিটকে পড়া দুই সংসদ সদস্য হলেন— চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সামশুল হক চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও মহানগরের একাংশ) আসনের দিদারুল আলম। পটিয়ায় চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী এবং সীতাকুণ্ডে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুন মনোনয়ন পেয়েছেন।

সামশুল হক চৌধুরী নিজ আসনে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের মধ্যে ‘এমপি লীগ’ তৈরি করাসহ বিভিন্ন বিতর্কে জড়িয়েছেন। দিদারুল আলম প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি হলেও আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সেভাবে যুক্ত নন। এসব কারণে তারা ছিটকে পড়েছেন বলে আলোচনা চলছে। দুই সংসদ সদস্যের বিরোধীরা মনোনয়ন ঘোষণার পর এলাকায় মিছিল করে মিষ্টি বিতরণ করেছেন বলেও জানা গেছে।

রোববার (২৬ নভেম্বর) বিকেলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের জন্য আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

বিজ্ঞাপন

আরও পড়ুন- চট্টগ্রামে ‘জুড়ে বসা’ ৪ এমপি এবার চ্যালেঞ্জের মুখে

ঘোষণা অনুযায়ী চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে মাহবুব রহমান রুহেল, চট্টগ্রাম-২ (ফটিকছড়ি) আসনে খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, চট্টগ্রাম-৩ (সন্দ্বীপ) আসনে মাহাফুজুর রহমান মিতা, চট্টগ্রাম-৪ (সীতাকুণ্ড ও নগরীর একাংশ) আসনে এস এম আল মামুন, চট্টগ্রাম-৫ (হাটহাজারী ও নগরীর একাংশ) আসনে এম এ সালাম, চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনে এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-৭ (রাঙ্গুনিয়া ও বোয়ালখালীর একাংশ) আসনে হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম-৮ (বোয়ালখালী ও নগরীর একাংশ) আসনে নোমান আল মাহমুদ, চট্টগ্রাম-৯ (কোতোয়ালি-বাকলিয়া-চকবাজার) আসনে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম-১০ (পাহাড়তলী-ডবলমুরিং-হালিশহর) আসনে মহিউদ্দিন বাচ্চু, চট্টগ্রাম-১১ (বন্দর-পতেঙ্গা) আসনে এম এ লতিফ, চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনে মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৩ (আনোয়ারা-কর্ণফুলী) আসনে সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ, চট্টগ্রাম-১৪ (চন্দনাইশ) আসনে নজরুল ইসলাম চৌধুরী, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগড়া) আসনে আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী এবং চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে মোস্তাফিজুর রহমান মনোনয়ন পেয়েছেন।

এদের মধ্যে মাহবুব রহমান রুহেল, খাদিজাতুল আনোয়ার সনি, এস এম আল মামুন, এম এ সালাম এবং মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ছাড়া অন্যরা একাদশ সংসদেরও সদস্য। হাছান মাহমুদ তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী, সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ ভূমিমন্ত্রী এবং মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল শিক্ষা উপমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বিজ্ঞাপন

মনোনয়নবঞ্চিত সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী একাদশ সংসদে প্রতিমন্ত্রীর মর্যাদায় হুইপের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালের আগে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে তিনি পটিয়া থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। প্রথমবারই নির্বাচিত হয়ে ৩২ বছর পর পটিয়া আসনটি আওয়ামী লীগের হাতে ফেরত আনেন। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আরও দুদফায় নির্বাচিত হন।

যুবদল-জাতীয় পার্টি ঘুরে আওয়ামী লীগে আসা সামশুল হক চৌধুরী ২০০৮ সালে পটিয়া থেকে মনোনয়ন পেয়ে চমকে দিয়েছিলেন। দলটির নেতাদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, শুরুতে পটিয়ায় আওয়ামী লীগের একাংশ সামশুলের বিরোধিতায় সরব হলেও নির্বাচিত হওয়ার পর সেই বিরোধিতা আর টেকেনি। এরপর তিনি নিজের পছন্দে উপজেলা, পৌরসভা থেকে ওয়ার্ড-ইউনিয়ন পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটি সাজান, যাতে বাদ পড়েন তার বিরোধীরা। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা পরিষদ পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে নিজের পছন্দের প্রার্থীদের জিতিয়ে আনেন। এ নিয়ে গত ১৫ বছরে পটিয়ায় আওয়ামী লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।

আরও পড়ুন- যারা পেলেন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন [পূর্ণাঙ্গ তালিকা]

পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক পৌর মেয়র হারুনুর রশীদ চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, ‘উনি (সামশুল হক চৌধুরী) তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বঞ্চিত করে নিজের পছন্দে আওয়ামী লীগের কমিটি করেছেন। উনি চাপ প্রয়োগ করে নিজের পছন্দের লোকজন দিয়ে কমিটি করতে বাধ্য করতেন। এলাকার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে দল কিংবা দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কোনো সমন্বয় ছিল না, তাদের চাওয়া-পাওয়াকে প্রাধান্য দেননি। এগুলো বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী উনাকে পরিবর্তন করেছেন বলে আমরা মনে করি।’

বিজ্ঞাপন

তবে সাংসদ হিসেবে সামশুল হক চৌধুরী প্রথমবার কোণঠাসা অবস্থায় পড়েন ২০১৯ সালে। সেসময় সারাদেশে ক্যাসিনো-জুয়াবিরোধী অভিযান চলছিল। নগরীর হালিশহরে ‘চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডে’ র‌্যাব অভিযান চালানোর পর ওই ক্লাবের মহাসচিব হিসেবে দায়িত্বে থাকা হুইপ সামশুল হক চৌধুরী এর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান। এতে তিনি ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। দুর্নীতি দমন কমিশন হুইপের সম্পদের হিসাব জানতে চেয়েছিল। তার বিদেশযাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা এসেছিল। এরপর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি শিল্পগ্রুপের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েও গণমাধ্যমের অব্যাহত সমালোচনার শিকার হন তিনি।

এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের তোড়জোড়ের শুরুতেই সামশুল হক চৌধুরী মনোনয়ন পাবে কি না— তা নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত সামশুলকে মনোনয়ন না দেওয়ার খবর পাওয়ামাত্র তার বিরোধী উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মিছিল বের করেন। পটিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আইয়ূব বাবুলের নেতৃত্বে মিছিল করে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছে। পৌর সদরে সাবেক মেয়র হারুনুর রশীদের নেতৃত্বেও আলাদা মিছিল হয়েছে। এ ছাড়া যুবলীগ, ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেও কয়েক দফা মিছিল হয়েছে।

আইয়ূব বাবুল সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের মোতাহের ভাই মনোনয়ন পেয়েছেন। দলের শেকড় মনোনয়ন পেয়েছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল উজ্জীবিত হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা জীবন ফিরে পেয়েছে।’

আরও পড়ুন- গোপালগঞ্জ-৩ আসনে লড়বেন শেখ হাসিনা

মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার হয়েছিলেন। তিনি পটিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বর্তমানে তিনি দক্ষিণের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

এদিকে ২০১৪ সালে আকস্মিকভাবে সীতাকুণ্ড আসন থেকে মনোনয়ন পান দিদারুল আলম, যাকে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাকর্মী চিনতেন বিএনপি ঘরানার শিল্পপতি হিসেবে। বিএনপির মনোনয়নে নির্বাচিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম মনজুর আলম তার চাচা। ২০১৮ সালেও অনায়াসে মনোনয়ন পেয়েছিলেন তিনি।

কিন্তু গত ১০ বছরে দিদারুল আলম সীতাকুণ্ডে আওয়ামী লীগের ভেতর নিজের প্রভাব বলয় তৈরি করতে পারেননি। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মী বরং তাকে এড়িয়ে চলতেন। এ সুযোগে নিজের অবস্থান শক্ত করেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এস এম আল মামুন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নের আশায় তিনি সেই পদ ছাড়েন। মামুন সীতাকুণ্ডের আগের তিনবারের সাংসদ আবুল কাশেম মাস্টারের ছেলে। চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবলীগের সভাপতিও ছিলেন তিনি।

শেষ পর্যন্ত মামুনই মনোনয়ন বাগিয়ে নেওয়ার পর সীতাকুণ্ডে আনন্দ মিছিল বের হয়। দৃশ্যপট থেকে মুহূর্তের ‘আউট’ হয়ে গেছেন দিদারুল আলম। তবে মামুনের মনোনয়ন নিয়ে হতাশার কথা জানিয়েছেন উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া। তিনিও মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন।

আবদুল্লাহ আল বাকের ভূঁইয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘নেত্রী যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, এটা আর কী বলব! হয়তো মনোনয়ন পাওয়ার যোগ্যতা আমি অর্জন করতে পারিনি। ৩৫ বছর দলের বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করছি, হয়তো যাকে দিয়েছেন, আমার যোগ্যতা তার চেয়ে কম। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করব না।’

আরও পড়ুন- একাদশে ‘উপেক্ষা’ দ্বাদশে নৌকা পেলেন নানক-মায়া-রহমান-নাছিম

ছিটকে পড়া দিদারুল আলমের বিষয়ে জানতে চাইলে বাকের বলেন, ‘উনি তদবিরে হয়তো পিছিয়ে গেছেন। গত দুবার উনার তদবির শক্ত ছিল। এখানে তো যোগ্যতার কোনো বিষয় নেই, তদবিরই সব। যিনি পেয়েছেন, তার তদবিরের জোর বেশি, সেজন্য পেয়েছেন।’

এদিকে মনোনয়ন পাওয়া এস এম আল মামুন কিছু বলতে রাজি হননি। অন্যদিকে দিদারুল আলমের মোবাইল বন্ধ পাওয়া গেছে।

১৯৭০ সাল থেকে চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসন থেকে সাতবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন বর্ষীয়ান আওয়ামী লীগ নেতা ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। এখনো তিনি ওই আসনের সংসদ সদস্য। শেখ হাসিনার দুবারের শাসনামলে তিনি দুদফায় মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের আওয়াম লীগের হাল ধরা অন্যতম নেতা মোশাররফ বর্তমানে দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও নির্বাচন পরিচালনা বোর্ডে সদস্য।

এবার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ না করে মোশাররফ বলেছেন, তিনি আর নির্বাচন করবেন না। নিজের বদলে ছেলে মাহবুব রহমান রুহেলের জন্য মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন।

ফটিকছড়িতে মনোনয়ন পাওয়া খাদিজাতুল আনোয়ার সনি ২০১৮ সালেও মনোনয়ন পেয়েছিলেন। পরে মহাজোটের শরিক দল তরীকত ফেডারেশনকে আসনটি ছেড়ে দেওয়ায় সনি নির্বাচন করতে পারেননি। এবারও আসনটি শরিক দলকে ছেড়ে দেওয়া হতে পারে বলে আলোচনা আছে।

হাটহাজারীতে মনোনয়ন পাওয়া এম এ সালাম চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান। ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করে জিততে পারেননি। ২০০৮ সালে তিনি মনোনয়ন পেলেও পরে সেটি মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টির আনিসুল ইসলাম মাহমুদকে ছেড়ে দেওয়া হয়। গত ১৫ বছরে আরও দুদফা নির্বাচনে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ থেকে আর আসনটি নেয়নি আওয়ামী লীগ। এবার আনিসুল ইসলাম মাহমুদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমও।

আওয়ামী লীগে ‘জুড়ে বসা’ সংসদ সদস্য হিসেবে পরিচিত চারজনের মধ্যে শুধু দিদারুল আলম মনোনয়নবঞ্চিত হয়েছেন। কিন্তু সাতকানিয়া-লোহাগাড়া আসনের আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামউদ্দিন নদভী ও বাঁশখালী আসনের মোস্তাফিজুর রহমান চৌধুরী তৃতীয়বার এবং বন্দর-পতেঙ্গা আসনের এম এ লতিফ চতুর্থবার মনোনয়ন আদায় করতে সক্ষম হয়েছেন।

আরও পড়ুন-

সারাবাংলা/আরডি/টিআর

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন