বিজ্ঞাপন

বইমেলায় ‘লোকচক্ষুর অন্তরালে’ অযত্ন-অবহেলায় একুশের ইতিহাস

February 23, 2024 | 11:37 pm

রাজনীন ফারজানা, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে চলে অমর একুশে বইমেলা। মহান ভাষা আন্দোলনের মাসে আয়োজিত এই মেলায় শুধু বই কেনাবেচাই নয়, এটি বাংলাভাষীদের প্রাণের সম্মিলনও বটে। প্রতিবছর বইমেলা স্মরণ করায় বাঙালির গর্বের ইতিহাস— ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, ছয় দফা, সত্তরের নির্বাচনের পর ৭ মার্চের ভাষণ আর তারপর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস সর্বোপরি বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের জন্মের ইতিহাস। প্রত্যাশা থাকে ভাষা আন্দোলনের মাসে আয়োজিত বইমেলায় সেই ইতিহাস স্মরিত হবে সগৌরবে। এবারের বইমেলায় তেমন একটি ইতিহাসের প্রদর্শনী রয়েছেও। তবে সেটি ঠিক প্রকাশ্যে নয়, অনেকটাই লোকচক্ষুর অন্তরালে।

বিজ্ঞাপন

বাংলা একাডেমির মূল ভবন বর্ধমান হাউজের পেছনে কবি জসিমউদ্দীন ভবনের সামনে সড়কজুড়ে চলছে ইতিহাস বিষয়ক এই প্রদর্শনী। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪ উপলক্ষে ‘বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে বাংলা একাডেমি ও বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম বজলুর রহমান ফাউন্ডেশন। প্রদর্শনীর কিউরেটর মেজর জেনারেল মো. মজিবুর রহমান।

মেলায় আসা দর্শনার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল— এমন একটি প্রদর্শনী যে হচ্ছে, তা তারা জানেনই না। জানবেনই বা কীভাবে, ঠিক যে জায়গায় প্রদর্শনীটি রয়েছে, বাংলা একাডেমি ঘুরতে যাওয়া দর্শনার্থীদেরও সেটি সচরাচর চোখে পড়ার কথা নয়। অবস্থানগত দিক তো রয়েছেই, তার ওপর পুরো জায়গাটি মেলা আসা বিভিন্ন ব্যক্তিগত যানবাহনেও দখল  থাকতেই দেখা গেল বেশির ভাগ সময়। তাতে ওই এলাকায় গেলেও গাড়ির আড়ালে ঢেকে থাকায় প্রদর্শনীর ফ্রেমবন্দি ব্যানারগুলো চোখেই পড়ে না।

প্রদর্শনীর নাম লেখা ব্যানারটি বেশির ভাগ সময়ই ঢেকে থাকছে গাড়ির আড়ালে। ছবি: সারাবাংলা

শুক্রবার (২৩ ফেব্রুয়ারি) মুগদাপাড়া থেকে দুই সন্তানকে নিয়ে ইমেলায় এসেছিলেন মোহাম্মদ কামরুল। পেশায় ব্যবসায়ী কামরুল বলেন, ‘এখানে অনুষ্ঠান হচ্ছে দেখে সন্তানদের নিয়ে ঢুকেছি। প্রদর্শনীটা কোথায় হচ্ছে জানতে পারলে ছেলমেয়েকে দেখাতে নিয়ে যেতাম। ওরা ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারত। এমন চমৎকার আয়োজন কেন সবার আড়ালে করতে হবে, বুঝতে পারছি না।’

বিজ্ঞাপন

মেলায় ঘুরতে আসা চার তরুণ-তরুণীর সঙ্গে কথা বলেও জানা গেল— প্রদর্শনীর বিষয়ে তারা কিছুই জানেন না। আজ বর্ধমান হাউজের দিকে ঘুরেছেন তারা। প্রদর্শনীর বিষয়ে জানলে ঘুরে দেখতেন।

বর্ধমান হাউজের পাশের খোলা জায়গায় স্থাপিত মঞ্চের পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিন শিল্পী। পাশেই বড় বড় ব্যানারে সচিত্র ইতিহাস। দেখেছেন কি না— জানতে চাইলে বললেন, ‘এগুলো কী, তাই তো বুঝিনি। এখানে এগুলো যে রাখা তা খেয়ালই করিনি!’

বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধু শীর্ষক প্রদর্শনী এলাকা। ছবি: সারাবাংলা

প্রদর্শনীর ব্যানারগুলোর সামনে দাঁড়িয়েও সেগুলো খেয়াল না করার কারণে তিন শিল্পীকে খুব একটা দোষ দেওয়া গেল না। কারণ এমন জায়গায় ও এমনভাবে যে একটি প্রদর্শনীর উপকরণ ফেলে রাখা যায়, তা সচরাচর কারও ভাবনাতেও আসার কথা নয়। বাংলা একাডেমি প্রান্তে ঢুকলে কোথাও এই প্রদর্শনী নিয়ে কোনো দিকনির্দেশনাও নেই বা উল্লেখ নেই প্রদর্শনীর বিষয়ে। উলটো ব্যানারগুলোর সামনের জায়গাটুকু যেন মোটরসাইকেল, প্রাইভেটকার, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির পার্কিং লট! কোথাও কোথাও উলটে আছে, আবার কোথাও বাঁকা হয়ে পড়ে আছে প্রদর্শনীর ব্যানার। রাতে নেই আলোর ব্যবস্থাও। অথচ ব্যানারগুলোতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার যাত্রাপথের সচিত্র প্রতিবেদন।

বিজ্ঞাপন

প্রদর্শনীর জায়গাটুকু ঘুরে দেখা গেল, বিশেষ এই প্রদর্শনীতে ৫৬টি ছবিতে ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস তুলে ধরা হয়েছে। আরও একটি আলাদা স্থানে জায়গা পেয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২১ বছরের শাসনামলে ২১টি বইমেলা উদ্বোধনের ছবি। মূল ভবনে প্রদর্শনীর কথা থাকলেও সেখানে সংস্কারকাজ চলায় বাইরেই ঠাঁই হয়েছে সেগুলোর।

বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষ বলছে, ‘বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধু’ শিরোনামের বিশেষ প্রদর্শনীটি করা হয়েছে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) আয়োজনে। তারাই ছবিগুলো প্রস্তুত করেছে। প্রথমে রাস্তায় বসানোর সিদ্ধান্ত হলেও পরে মেলা প্রাঙ্গণের ভেতরে আনা হয়েছে ছবিগুলোর চুরি ঠেকাতে।

প্রদর্শনীর ব্যানারগুলোর সামনের এলাকা যেন যানবাহনের পার্কিং। ছবি: সারাবাংলা

মেলা প্রাঙ্গণে ঠাঁই যখন দেওয়াই হয়েছে, এতটা অবহেলা কেন বা দিকনির্দেশনা নাই কেন— জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির পরিচালক ও বইমেলা পরিচালনা কমিটির সদস্যসচিব কে এম মুজাহিদুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি বইমেলারই নান্দনিকতার অংশ, আলাদা কোনো প্রদর্শনী নয়। তাই আমরা কোনো দিকনির্দেশনা রাখিনি। যারা এদিকে সেমিনারে আসা-যাওয়া করছেন, তারা দেখছেন। শুরুতে আমরা রাস্তায় রাখার চিন্তা করলেও চুরি হয় বলে ভেতরে এনে রেখেছি।’

মুজাহিদুল ইসলামের দাবি, ‘অবহেলার অভিযোগ সত্য নয়। প্রতিদিনই এগুলো পরিষ্কার করে গুছিয়ে রাখা হয়।’

বিজ্ঞাপন

এ দিন বাংলা একাডেমির ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌ ভবনের আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে চলছিল তিন দিনব্যাপী সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন। আয়োজনে ছিল এনআরবি/পিবিও। একাডেমির প্রবেশপথে তো বটেই, এর বেশকিছু দিকনির্দেশনা দেখা গেল ভেতরেও।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউজের সামনের বটতলায় এক টুকরো চটের ওপর ৩২টি বই সাজিয়ে সূচনা হয়েছিল আজকের বইমেলার। প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহার একক সেই আয়োজনে পরের বছর থেকে যুক্ত হয় বাংলা একাডেমি।

স্বাভাবিকভাবে প্রদর্শনীটি কারও চোখেই পড়ার সুযোগ কম। ছবি: সারাবাংলা

শুরুতে ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিশেষ হ্রাসকৃত মূল্যে একাডেমি প্রকাশিত বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। সঙ্গে যোগ দেয় আরও কিছু প্রকাশনী। পরের বছর ১৯৭৪ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করে বাংলা একাডেমি, যার উদ্বোধন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ উপলক্ষে বাংলা একাডেমি তার নিজস্ব প্রকাশিত বই প্রদর্শন ও ম্যুরাল প্রদর্শনীর আয়োজন করে।

ওই গণজমায়েতকে সামনে রেখে ঢাকার বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান একাডেমির পূর্বদিকের দেয়াল বরাবর নিজেদের পছন্দমতো জায়গায় যে যার মতো কিছু স্টল নির্মাণ করে বই বিক্রির ব্যবস্থা করে। ধাপে ধাপে নানা বিবর্তনের পর ১৯৮৪ সাল থেকে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হতে থাকে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। প্রথমদিকে ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আয়োজন হলেও ক্রেতা, দর্শক ও বিক্রেতাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৮৪ সাল থেকে ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে এ মেলা আয়োজিত হয়ে আসছে। আর শুরু থেকেই শুধু বই বিক্রিই নয়, সাহিত্য ও সম্মেলন ও প্রদর্শনীও এই মেলার সঙ্গে যুক্ত।

সারাবাংলা/আরএফ/একে

Tags: , , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন