বিজ্ঞাপন

গুড়ের জিলাপি জাগিয়ে তোলে শৈশব স্মৃতি

March 31, 2024 | 6:14 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

রংপুর: গনগনে চুলার আগুন আর টগবগে গরম তেলে ভাজা হয় গুড়ের জিলাপি। মুখে তুললেই অন্যরকম স্বাদ আর সুগন্ধি। এই জিলাপি মুখে তুললেই যে কাউকে মোহাবিষ্ট করে ফেলবে। এখানকার নিয়মিত ক্রেতারা বলছেন, ছোট থেকেই এই জিলাপির সঙ্গে পরিচিত হন। পরিণত বয়সেও সেই একই রকম স্বাদের লোভে এখনও তারা আসেন। আর যদি হয় রোজার মাস, তাহলে তো কথাই নেই। এই জিলাপি ছাড়া ইফতারের কথা ভাবতেই পারেন না স্থানীয়রা। বলছি রংপুরের নবাবগঞ্জ বাজারের জিলাপিপট্টির মুসলিম মিষ্টান্নের গুড়ের জিলাপির কথা।

বিজ্ঞাপন

নবাবগঞ্জ বাজারে প্রথম জিলাপির দোকান এই মুসলিম মিষ্টান্ন। ১৯৬০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত। রংপুরের নবাবগঞ্জ বাজারে গুড়ের জিলাপি বানানো শুরু করেন মুসলিম মিষ্টান্ন ভান্ডারের আবুল কাশেম। তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর চার ছেলের মধ্যে দুই ছেলে ব্যবসা দেখতেন। তাঁদের মৃত্যুর পর বাকি দুই ভাই বাবার ঐতিহ্য ধরে রাখতে গুড়ের জিলাপির ব্যবসার হাল ধরেছেন।

বংশপরিক্রমায় চলছে এ ব্যবসা। এই দোকানের অদ্ভুত এই স্বাদের পেছনে কোনো সিক্রেট নেই বলে জানান জিলাপি তৈরির প্রধান কারিগর মনির উদ্দিন। তিনি জানালেন, ভালো মানের ময়দা গুলিয়ে রেখে দেওয়া হয়। পরদিন সকালে জিলাপি ভেজে গুড়ের শিরায় চুবানো হয়।

ষাটের দশকের শুরুতে প্রতি সের পঁচিশ পয়সায় বিক্রি হতো। দেশ স্বাধীনের পরও এখানে ৫০ পয়সা সের দরে জিলাপি বিক্রি হতো। সবকিছুরই দাম বেড়েছে। আর এখন ১৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে মুসলিম মিষ্টান্নের গুড়ের জিলাপি।

বিজ্ঞাপন

এক সময় এখানে মাটির হাঁড়ি আর বাঁশের খাঁচায় করে দেওয়া হতো জিলাপি। কুটুমবাড়ি বেড়াতে গেলে হাঁড়ি বা খাঁচায় ঝুলিয়ে এখান থেকে জিলাপি নিয়ে যেত। হাঁড়ি-খাঁচার প্রচলন উঠে যাওয়ায় কাগজের বাক্স দেওয়া হয় জিলাপি বহন করতে। আগের তুলনায় বিক্রি অনেক কম।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের চিকিৎসক আল মামুন সরকার লিমন বলেন, ‘রংপুর জেলা স্কুলে যখন মাধ্যমিকে পড়াশোনা করতাম তখন আমরা স্কুল থেকে মেসে ফেরার পথে এই দোকানের জিলাপি কিনে খেতে খেতে যেতাম। এখনও এই জিলাপির স্বাদ ভুলতে পারিনি। ছোটবেলায় যে স্বাদ পেতাম এখনও সে রকম স্বাদই আছে। রংপুরে গেলে এই জিলাপি না খেলে হয় না। যখনই এই জিলাপিতে কামড় দেই সেই ছোট্ট বেলার কথা মনে পড়ে যায়।’

বিজ্ঞাপন

রংপুরের পীরগঞ্জের চতরা কলেজের ইতিহাস বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হারুন অর রশিদ চৌধুরী অতীতের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘কারমাইকেল কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়াকালীন সময়ে আমাদের আড্ডা দেওয়া কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গিয়েছিল এই মুসলিম মিষ্টান্ন। সারাদিন ক্লাস, বিকেলে টিউশনি শেষে বন্ধুদের সঙ্গে মুসলিম মিষ্টান্নর জিলাপির সঙ্গে আড্ডা এখনও ভুলতে পারি না।’

তিনি বলেন, ‘অন্যান্য সময়ে জিলাপি খাওয়া হয়, কিন্তু রোজা এলে এই জিলাপি প্রতিদিন না খেলে মনে হয় ভালোই লাগে না। জিলাপির একটা স্বাদ যেন সবসময় মুখে লেগে থাকে। এর স্বাদই আলাদা। গুড়ের জিলাপি এখন অনেক দোকানে তৈরি করা হলেও মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের গুড়ের জিলাপির তুলনা হয় না।’

এই দোকানের জিলাপির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে আশপাশে আরও বেশ কিছু জিলাপির দোকান গড়ে উঠেছে। তাই এ স্থানটির নামই হয়ে গেছে জিলাপিপট্টি। এখানকার একেকটি দোকানে ৫ থেকে ৭ মণ জিলাপি বিক্রি হয় বলে জানান দোকানিরা। তবে মুসলিম মিষ্টান্ন ভাণ্ডাররে দিনে প্রায় ১০ মনের কাছাকাছি বিক্রি হয়।

মুসলিম মিষ্টান্নের প্রধান কারিগর মনির উদ্দিন জানান, মাত্র পাঁচ বছর বয়সে এখানে এসে কাজ শুরু করেন। তখন দোকানের ধোয়া-মোছা ও কারিগরের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন। সেই কাজ করতে করতে এখন তিনি জিলাপি বানানোর প্রধান কারিগর।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, ‘আগে জিলাপির কত-না কদর ছিল। রংপুরের বাইরে থেকে এসেও এখানে বসে জিলাপি খেতেন মানুষজন, আবার কেউ খাঁচায় ভরে জিলাপি নিয়ে যেতেন আত্মীয়বাড়িতে। এখন দোকানে বসে খাওয়ার চেয়ে বাইরের অর্ডারই বেশি আসে।’

বর্তমানে এই দোকানটি পরিচালনা করছেন আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, ‘ভালো মানের গুড় ব্যবহার করায় দীর্ঘ ৬৪ বছর ধরে সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছি। শুধু এই সুনাম অক্ষুণ্ন রাখার কারণে জিলাপি ছাড়া অন্য কোনো খাবার বানাই না।’

সারাবাংলা/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন