বিজ্ঞাপন

গ্রামজুড়ে স্বজন হারানোর আহাজারি

May 10, 2024 | 7:23 pm

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট

হবিগঞ্জ: দীর্ঘদিন ধরে হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রামে চলছে গোষ্ঠীভিত্তিক দ্বন্দ্ব। বিগত ইউপি নির্বাচনে এই বিরোধ তুঙ্গে ওঠে। দুই গোষ্ঠীর দুইজন ইউপি সদস্য নির্বাচন করেন। এরপর থেকে গ্রামটিতে দুইপক্ষের লোকজনের মধ্যে বিরোধ বাড়তে থাকে। সেই বিরোধ থেকেই বৃহস্পতিবার সিএনজিতে যাত্রী ওঠানো নিয়ে দুইপক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। নিহতরা একপক্ষের লোক। এ ছাড়াও গুরুতর অবস্থায় কয়েকজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (১০ মে) সকালে হাওরাঞ্চলের প্রত্যন্ত আগুয়া গ্রামে সরেজমিনে গিয়ে লোকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, গত ইউনিয়ন নির্বাচনের জেরে এই ভয়াবহ সংঘর্ষ সংঘটিত হয়েছে। এ সময় গ্রামটিতে নিহতের স্বজনদের আহাজারি ও বিলাপের শব্দ শোনা যায়। এতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। এ ছাড়াও ভাঙচুর হওয়া কিছু ঘরবাড়ি দেখতে পাওয়া যায়। এরইমধ্যে ওই সংঘর্ষে জড়িত একপক্ষের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছেন। গ্রামের একটি প্রান্তে গিয়ে দেখা যায় তিনজনকে দাফন করার জন্য পাশাপাশি তিনটি কবরস্থান খোঁড়া হচ্ছে।

নিহত তিনজনের গোষ্ঠীর সর্দার মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘আগুয়া গ্রামের সিএনজি স্ট্যান্ডের ম্যানেজার বদরুল আলম বদির ও সোহেল মিয়া গত ইউপি নির্বাচনে মেম্বার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এতে সোহেল মিয়া জয়ী হন। এরপর থেকে বদরুল আলম ও তার লোকজন আমাদের গোষ্ঠীর লোকজনের সঙ্গে মারামারি করার জন্য ওঠেপড়ে লাগে। কিন্তু ঝগড়া এড়াতে তাদের উসকানিতে পা দেইনি।’

মো. হাবিবুর রহমান বলেন আরো বলেন, ‘বৃহস্পতিবার সকালে আমার ভাতিজা কাদির মিয়া বাড়ির পাশ থেকে সিএনজিতে একজন যাত্রী ওঠায়। বিষয়টি জেনে ম্যানেজার বদরুল আলম তাকে স্ট্যান্ডের অফিসে ডাকেন। কাদির মিয়া অফিসে গেলে তাকে কয়েকজন মিলে বাজে ভাষায় গালিগালাজ ও মারপিট করেন। ঘটনাটি লাইন সভাপতি আশিক মিয়াকে জানানো হলে তিনি বিষয়টি দেখার আশ্বাস দেন। দুপুর ২টার দিকে বদরুল আলম ও তার লোকজন কাদিরের বসতবাড়ি ঘেরাও করে হামলায় চালায়। এরপর দুইপক্ষের সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে আমাদের তিনজনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে বদরুলের লোকজন।’

বিজ্ঞাপন

নিহত লিলু মিয়ার মা সুন্দর বানু বলেন, ‘যারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে তাদের ফাঁসি চাই। আমার চারজন নাতি-নাতনি এতিম হয়ে গেল। এখন তাদের মুখে ভাত দেওয়ার কেউ রইল না।’

নিহত সিরাজ মিয়ার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় সবাই মিলে আহাজারি করছেন। ১০ বছরের মেয়ে মার্জিয়া বিছানায় লুটোপুটি খেয়ে বলছে, ‘এখন আমি কাকে বাবা ডাকব? আমাদের কে আদর করবে।’

বিজ্ঞাপন

অপর নিহত সিএনজি-অটোরিকশাচালক কাদির মিয়ার বাড়িতেও একই দৃশ্য। বাড়ির উঠোনে কাদির মিয়ার ১ বছর বয়সী সন্তানকে কোলে নিয়ে তার মা আহাজারি করে বলেন, ‘দুপুরের মধ্যে আমার কাদির দুইতিনবার তার সন্তানদের দেখতে বাড়িতে আসত। বাপের জন্য তারা অপেক্ষায় থাকত সবসময়। এখন এরা কার জন্য অপেক্ষা করবে? এদেরকে কারা দেখে রাখবে?’

নিহত লিলু মিয়ার চাচাত ভাই খলিল মিয়া বলেন, ‘বদরুল আলম বদির অনেকদিন ধরে আমাদের সঙ্গে ঝগড়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গতকাল সামান্য বিষয় থেকে পরিকল্পনামাফিক হামলা চালিয়ে আমাদের তিনজন মানুষকে হত্যা করেছে তারা।’

স্থানীয় ইউপি সদস্য সোহেল মিয়ার ভাই বাবুল মিয়া বলেন, ‘আমার ভাইয়ের কাছে নির্বাচনে পরাজিত হয় বদরুল আলম বদির। এরপর থেকে বদির ও তার লোকজন আমাদের সঙ্গে ঝগড়ার পরিকল্পনা নিচ্ছিল। গতকাল তুচ্ছ বিষয়কে কেন্দ্র করে মুহূর্তের মধ্যে অস্ত্রসস্ত্র নিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছে। আমরা নিজেদের আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরোধ করতে চেয়েছি। এর মধ্যে তারা আমাদের তিনজনকে মেরে ফেলে।’

এদিকে শুক্রবার দুপুরে কাদির মিয়া, লিলু মিয়া ও সিরাজ মিয়ার মরদেহ ময়নাতদন্তের পর স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বিকেলে মন্দরী ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স প্রাঙ্গণে তিনজনের নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য ময়েজ উদ্দির শরীফ, সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুল মজিদ খান, সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান ও হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হাডিবুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন। এর আগে, ডিআইজি নিহত তিনজনের স্বজনের সঙ্গে কথা বলে তাদের ন্যায়বিচার পাওয়ার আশ্বাস দেন।

বিজ্ঞাপন

সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি শাহ মিজান শাফিউর রহমান নিহতদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে বলেন, ‘প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার করা হবে। গ্রাম্য-রাজনীতির মারপ্যাচে কোনো নিরীহ ব্যক্তিকে যেন ফাঁসানো না হয়। ৪/৫ মাসের মধ্যে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। পুলিশের কাজে কেউ যেন হস্তক্ষেপ না করে।’

বানিয়াচং থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন জানান, ময়নাতদন্তের পর স্বজনের কাছে তিনটি মরদেহ হস্তান্তর করার পর বৃহস্পতিবার আছরের নামাজের পর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ ঘটনায় এখনও কোনো মামলা দায়ের হয়নি। তবে স্বজনরা বলছে, মরদেহ দাফনের পর মামলা দায়ের করবে। দোষীদের আটক করতে পুলিশের অভিযান চলছে। এ ছাড়াও অস্থায়ীভাবে আগুয়া গ্রামে একটি পুলিশের ক্যাম্প বসানো হয়েছে।

উল্লেখ্য, বৃহস্পতিবার (৯ মে) হবিগঞ্জের বানিয়াচং উপজেলার আগুয়া গ্রামে সিএনজি অটোরিক্সাতে যাত্রী ওঠানো থেকে দুইপক্ষের সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন।

নিহতরা হলেন লিলু মিয়া (৪০), সিএনজি চালক কাদির মিয়া (৩০) ও সিরাজ মিয়া (৫০)। এতে আহত হয়েছেন আরও অন্তত ৫০ জন। আশঙ্কাজনক অবস্থায় আহত তিনজন সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।

সারাবাংলা/একে

Tags: , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন