বিজ্ঞাপন

বাবার মৃত্যু নেই- অপেক্ষায় আমি আর লাল কলাবতী

September 4, 2018 | 2:40 pm

পর্ব-২৮।।

বিজ্ঞাপন

নানুর ন্যাওটা ছিলাম বড্ড বেশি। বাবাকে নিজ সন্তান বলে বিশ্বাস করতেন তিনি। তাই তাঁকে দীদু ডাকা শিখিয়েছিলেন।

স্কুলের ছুটির দিন দীদুর প্রধান কাজ ছিল একবারে কাক ডাকা সকালে নামাজ শেষে আমাকে তৈরি করে রিক্সা নিয়ে বের হওয়া। একেক দিন একেক মাজারের সামনে বসে থাকা মুসাফিরদের মাঝে বাবাকে খুঁজে বেড়ানো ছিল তাঁর নেশা, আমি থাকতাম দীদুর নীরব সাথী হয়ে। বাবার অপেক্ষায় থাকা আমরা বাবার জন্য সময় পার করতাম এভাবেই। শেষ মুহূর্তেও দীদু বিশ্বাস করতেন, বাবা ফিরে আসবে ঘন রোদ্দুর মাখা এক তপ্ত দুপুরে। ঝাকড়া কেশ নাড়িয়ে তাঁকে বলবেন, বাসা খুঁজে পেতে দেরি হয়েছে আমার। বড্ড খিদে লেগেছে, তাড়াতাড়ি ভাত দাও মামনি।

আরেকটু বড় হওয়ার পর, একটু করে বুঝতে পারতাম যে, বাবা আর আসবে না বোধহয়, হারিয়ে গেছে সে। ছোট্ট মনে প্রশ্ন আসতো মানুষ মরে গেলে কবর থাকে, তাহলে বাবার কবর কোথায়!

বিজ্ঞাপন

প্রিয় মিষ্টি মামাকে একদিন রাতে ভাত খেতে খেতে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আমি। সে মুখ বুঁজে ভাত খেয়ে উঠে গিয়েছিল তখন। পরের দিন অফিস কামাই দিয়ে আমাকে সাভার জাতীয় সৃত্মিসৌধে নিয়ে গিয়েছিলেন। গেট দিয়ে ঢুকতেই তিনি বলেছিলেন, এখানে তোমার বাবা ঘুমিয়ে আছে। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলেছিলাম, আমার বাবার কবর এতো বড়। এতো এতো গাছ। এতো এতো মাটি। বাবা তো তাহলে অনেক বড় মানুষ ছিল।

 

বিজ্ঞাপন

দীদু আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় আমি বেশ বড় হয়েছি। জাতীয় সৃত্মিসৌধ বাবার কবর নয়, বুঝতে শিখেছি। অনেক প্রশ্ন মাথায় ঘুরতো সবসময়। বাবা তাহলে কি একেবারে চলে গেছে, দীদুর সাথে সাথে!

উত্তর না পেয়ে সবচেয়ে প্রিয় মিষ্টি মামাকে একদিন চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, দীদুকে কবরে দিয়ে এসেছ, তাহলে বাবার কবর কোথায়? আর মিথ্যা বলবে না আমাকে। উত্তর না দিয়ে নিথর হওয়া মিষ্টিমামা নীরবে চোখের জল ফেলেছিল বহুক্ষন। ধীরে ধীরে বড় হওয়া ভাগ্নিটিকে আর কি দিয়ে বুঝ দিবেন, জানতেন না তিনি।

 

বাবার জন্য অপেক্ষারত বহমান পরিবারে বড় হলেও চারপাশের অন্যান্য স্বাভাবিক পরিবারগুলো দেখতে দেখতে নিজ থেকেই এক বোধদয় এসেছিল। বাবাকে যতই খুঁজি না কেন, সে আর ফিরবে না। বাবার মৃত্যুদিন নেই, মৃতদেহ নেই, সমাধি নেই, বাবার মৃত্যু নেই। বাবার কবর বলে আসলে কিছু নেই, পুরো বাংলাদেশের মাটিটাই বাবার কবর। দেশের মাটি ছুঁলেই বাবাকে ছুঁয়ে যাবো আমি। এই বাসায় উঠবার আগেই ছাদে তাই ড্রাম ভরে মাটি তুলেছিলাম প্রথম দিনই। ছাদে মাটি থাকবে, দেশের মাটি। মাটির সাথে মিলে যাওয়া আমার বাবা। প্রথম ড্রামটার মাটিতে বুনে দিয়েছিলাম লাল কলাবতী।

বিজ্ঞাপন

২৮, ২৯, ৩০, ৩১ অগাস্ট একাত্তরে পাকহানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে প্রচুর গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা গ্রেফতার করে। অনেককে ছেড়ে দিলেও এর মাঝে বাবাসহ আরো ছয় ক্র্যাক প্লাটুন সদস্যকে প্রচন্ড অত্যাচার করবার পরও তাঁদের থেকে কোন তথ্য আদায় করতে পারছিল না পাক সেনারা।

একাত্তরের ঠিক সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ দুপুর বারোটার পর থেকে তাঁদের আর কেউ দেখতে পায়নি। নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরির এমপি হোস্টেল বা রমনা থানায় সাতজনের নামের এন্ট্রি বা এক্সিট খুঁজে পাওয়া যায়নি। পাকবাহিনীর টর্চার সেল বা ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে তাঁদের খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে একটি উড়ো খবর বিশ্বাসে পরিণত হয়েছিল স্বজনদের কাছে। ১ সেপ্টেম্বর একাত্তরের দুপুরের পর কোন এক সময়ে এই সাতজনসহ আরো কিছু নাম না জানা মুক্তিযোদ্ধাকে ড্রাম ফ্যাক্টরীর টর্চার সেলের উঠোনে গর্ত খুঁড়ে সকল চিন্হ মুছে ছাই করে ফেলতে গায়ে পেট্রল ঢেলে দেয়াশলাই কাঠির আগুনে মৃতপ্রায় জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছিল। পুড়তে পুড়তে দেশের মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল সবাই।

আমি শোনা কথায় বিশ্বাস করি না। অপেক্ষা করি আমার সাত বীর বাবার জন্য। অপেক্ষা চলবে শেষ মুহূর্তেও। শহীদ রুমী, শহীদ বদী, শহীদ জুয়েল, শহীদ আজাদ, শহীদ হাফিজ, শহীদ বকর, শহীদ আলতাফ মাহমুদসহ সেদিনের নাম না জানা সকল গেরিলার জন্য ছাদবাগানের উঠানে তাই প্রতি বছর সেপ্টেম্বরে লাল কলাবতী মাথা উঁচু করে অভিবাদন জানায়। তাঁদের লাল সালামে সুস্বাগতম করবে বলে। লাল কলাবতী আর আমি অপেক্ষা করি, একসাথে।

 

 

সারাবাংলা/এসএস

Tags: , , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন