বিজ্ঞাপন

আত্মবিশ্বাসের ষড়যন্ত্র

December 9, 2017 | 5:24 pm

খাইরুল জর্দা। বন্ধুরা তার নাম দিয়েছে খাইরুল জর্দা। বন্ধু হলো এমন এক বিশেষ গোত্র, যারা বাবা মায়ের দেয়া নাম মুহূর্তে পাল্টে দিতে পারে। তাতে আকিকা ধরণের কোনো আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজন পরেনা। শুধু দরকার একটু আত্মবিশ্বাস এবং সময়। আত্মবিশ্বাসী হয়ে এবং সময় নিয়ে মুখে মুখে নতুন নামটি প্রচার করা মাত্র। এরপর এমন এক সময় আসে, মানুষ নিজের আদি নাম নিজেই ভুলে যেতে বসে।

বিজ্ঞাপন

এই যেমন খাইরুল জর্দা। বেচারা। মাঝে মাঝে অপরিচিত কাউকে ফোন দিয়ে নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে নিজেই বলেই ফেলেন, ‘আমি খাইরুল জর্দা বলছি, থুক্কু খাইরুল জোয়ারদার বলছি। জ্বি জ্বি জোয়ারদার জোয়ারদার।’ ‘থুক্কু’ শব্দ টুকু মনে মনে বলেন, আর সেই সাথে ছুড়ে দেন প্রচুর অপ্রীতিকর শব্দ বন্ধুদের উদ্দেশ্যে, মনে মনে।

এই নামের হেরফেরের কারণে তার আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি হয়না। এই আত্মবিশ্বাসের কারণেই তার নাম খাইরুল জর্দা। তিনি গর্বিত। বন্ধুরা ভেবে দেখলেন, খাইরুলের আত্মবিশ্বাস অনেকটা জর্দার মতন। পানের মাঝে বেশি করে চুন, খানিকটা সুপারিগুঁড়ো’র সাথে জর্দা ছিটিয়ে খেলে, যেমন ফুরফুরে আর আত্মবিশ্বাসী ভাব জাগে, খাইরুলের ব্যাক্তিত্বটি অমন। ফুরফুরে, আত্মবিশ্বাস তার বর্ডার লাইন ছাড়িয়ে ঊর্ধ্বগতিতে।

আত্মবিশ্বাস যদি ডায়াবেটিস ধরণের অসুখ হতো, তবে প্রতিদিন নিয়ম করে খাইরুল সাহেবকে ইনসুলিন নিতে হতো। ভাগ্যিস ওমনটি নয়। আর তাই প্রতিদিনের আড্ডায় বা কর্মজীবনে, অন্যদের জন্য খাইরুলের উপস্থিতি বন্ধু মহলের জন্য একঝলক ঠান্ডা বাতাসের মতন। সারাদিন রোদে হেঁটে, হুট করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকে, এক গ্লাস বরফ কুচি মেশানো ঠান্ডা পানি পান করবার মতন, আরামদায়ক।

বিজ্ঞাপন

কিন্তু এই আত্মবিশ্বাসের আতিশয্য খাইরুলের জীবনে যে টুকটাক বিপর্যয় ঘটায় না তাতো না। অন্যদের জন্য ছোটখাটো অঘটন বিনোদনের খোরাক, খাইরুলের জন্য খানিকটা বিপর্যয়। খাইরুলের ভাষায় তা ‘নিছক ষড়যন্ত্র’।

এই যেমন, কলেজের প্রথম বর্ষর দ্বিতীয়বার্ষিকী পরীক্ষার পর, অর্থনীতির স্যার খাইরুলকে দশে শূন্য দিলেন। কেন? খাইরুলতো সব ঠিকঠাক লিখলো। যোগান চাহিদা রেখা দিয়ে খাতা ভর্তি করে ফেললো। সে তো মানবেনা এই অন্যায়।

স্যার বললেন, ‘খাইরুল, তুমি তো যোগান আর চাহিদা রেখা ওলোটপালোট করে ফেলেছো, উল্টো এঁকেছো। নম্বর তো দেয়া যাবেনা বাবা। শূন্য কেন তোমাকে মাইনাস পাঁচ দিলে ভালো হতো।’

বিজ্ঞাপন

– ‘স্যার প্রশ্নেই লেখা আছে, ‘মনে করো, বাজারে যোগান আর চাহিদা সমান।’ তা আমি সেটা মনে করেই তো আঁকলাম। তো দুই রেখার ওলোট পালট নাম দিলে সমস্যা কই স্যার?’, খাইরুলের আত্মবিশ্বাসী প্রশ্ন।

থাক। এর পরের গল্প আজ থাক। তাতে খানিকটা ‘ভায়োলেন্স’ জড়িত। কিন্তু এরপর থেকে স্যার খাইরুলের নাম দিলেন ‘অকাট মূর্খ বেয়াদব’। আর খাইরুলের কাছে পুরো ঘটনা তার বিরুদ্ধে এক ‘নিছক ষড়যন্ত্র’।

‘খাইরুল জর্দা’ এমন ষড়যন্ত্রে হার মানেনি। ‘চল চল’ গতিতে উনি আত্মবিশ্বাসের সাথে পথ চলছেন। এই সেদিন, ব্যাংক থেকে তার চেকটা ফেরত এলো, কারণ, ‘ইনসাফিসিয়েন্ট ফান্ড’। প্রবল আত্মবিশ্বাসে তিনি ব্যাংকে চিঠি লিখলেন, ‘কার ইনসাফিসিয়েন্ট ফান্ড? ব্যাংকের না আমার?’

ব্যাংকের ম্যানেজার স্কুলের এক বড় ভাই। ফোন করে বললেন, ‘দেখো খাইরুল, তুমি তো এমন বড় গোছের কোনো কাস্টমার না, এই ধরণের চিঠি টিঠি না লেখাই ভালো, বুঝলানা? একে একাউন্টে টাকা পয়সা তেমন নাই, এর পর যদি এসব লেখো…’
উত্তরে খাইরুল বললেন, ‘এ এক নিছক ষড়যন্ত্র।’

বিজ্ঞাপন

‘চল চল’ ধরণের উদ্যমী চলার পথের নিছক ষড়যন্ত্র খাইরুলকে খুব একটা পরাস্ত করতে পারেনি, এতদিন অবধি। সেই গতিতেই খাইরুল জর্দা পাড়ায় একটি ছোট ডিপার্টমেন্টাল স্টোর খুলে ফেললেন। ইংলিশ নামে কদর বাড়ে। তাই আত্মবিশ্বাসের সাথে দোকানের নাম দিলেন, খাইরুল’স’। প্রথমদিন ফিতা কেটে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে দোকানের উদ্ভোধন করলেন।

এতদিন বড় বড় দোকানে গিয়ে দেখতেন, দোকানের মালিকরা প্রবল আত্মবিশ্বাসে খদ্দেরদের অপেক্ষা করিয়ে ফোনে অনর্গল কথা বলে চলেন। ব্যবসাসংক্রান্ত কথাবার্তা। খাইরুলেরও আজ সে সময় এলো। উদ্ভোধন শেষে, দোকানে প্রবেশ করেই ব্যাতিব্যস্ত হয়ে দোকানের ফোন থেকে যোগানদারকে ফোন দিলেন। কাজের কথাবার্তা। চাল, ডাল, ময়দা কোন ব্র্যান্ড, কবে পাঠাতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। বন্ধুরাও আনন্দিত, যাক, খাইরুল জর্দা এখন আর নিছক বিনোদনের নাম নয় শুধু, নিজে কিছু করেটরে খাবে।
এরমধ্যে দুজন কাস্টমারও চলে এলো দোকানে। খাইরুল সাহেব আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ফোনে কথা বলতে বলতেই হাত দিয়ে ইশারা করে তাদের অপেক্ষা করতে বললেন। কাস্টমার দুজন ও মুগ্ধ চোখে দোকানের সাজসজ্জা দেখছেন।

মিনিট তিনেক পরে যোগানদারের সাথে ফোনে কথা বলা শেষ করে, খাইরুল কাস্টমারদের প্রশ্ন করলেন, ‘তা কি লাগবে ভাই?’
বন্ধুরাও উন্মুখ, প্রথম কাস্টমার, কি কেনে দোকান থেকে দেখা যাক।

দুজনের একজন উত্তর দিলেন, ‘ভাই আমরা টেলিফোন অফিস থেকে এসেছি। আপনার দোকানের ফোনে কানেকশন দিতে।’
এর পরের গল্পটি খানিকটা করুণাদায়ক, কিছুটা লজ্জার। বন্ধুদের সামনে অতি আত্মবিশ্বাসী খাইরুলের সেদিন কি নাজেহাল অবস্থা হলো, সে গল্প আজ থাক। কানেকশনহীন ফোনটি লজ্জায় হাত থেকে পরে গিয়েছিলো। লোকমুখে শোনা যায়, এ ঘটনার পর থেকে খাইরুল জর্দা’র আত্মবিশ্বাসের গতিপথেরও কিছু পরিবর্তন হয়েছে।

সময় বদলায়, মানুষ ও। বেঁচে থাকা, শুধু নিশ্বাস নেয়া ছাড়াও আরো কত কিছু যে শেখায়। অলস সময়ে দোকানে বসে বসে ইদানিং তাই ভাবেন খাইরুল জর্দা। ছোটবেলায় শিখেছেন, ‘আত্মবিশ্বাসী হও, জীবনে উন্নতি হবে।’ তা সে আত্মবিশ্বাসের সীমারেখা কতটুকু তাতো আর তাকে কেউ বলে দেয়নি।

বিশ্বাস, অতি বিশ্বাস, আত্মবিশ্বাস এর পার্থক্যটা তিনি বোধহয় আস্তে আস্তে বুঝতে শিখছেন। দেরিতে হলেও শিখছেন তো। তাই বোধহয় এখন মনের কোণ বেয়ে, বহুদিন ধরে অতি আত্মবিশ্বাসের তলায় আটকে থাকা ভুলগুলো উঁকি ঝুঁকি দেয়। তাতে চোখের কোণ ভেজে, কিন্তু তাতে জীবনের বেহিসাবগুলো ভেসে যায়। আত্মবিশ্বাসের উর্ধ্বগতির লাগামটি আয়ত্ত্বে আনা যায়, উর্ধ্বগতির ছন্দহীনতাকে জীবনের ছন্দে মেলানো যায়।

অতি আত্মবিশ্বাসের লাগামহীন রেসের জিতে যাবার এই ক্লান্ত খেলার একঘেয়েমি থেকে মুক্ত হয়ে তার বড় ভালো লাগে। কিছুটা ভুল আর বিশ্বাস মেশানো বেঁচে থাকা নির্ভার করে তাকে। অন্যের কাছে জিতবার চেয়েও নিজের কাছে জিতে যাবার অনুভূতি তাকে আনন্দ দেয়। জীবন সহজাত হয়, সরল হয়, সাধারণ হয়।

‘খাইরুল’স’ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের প্রবেশ পথে এখন বড় বড় কালো সাদায় লেখা এক বোর্ড টাঙানো, তাতে লেখা, ‘আত্মবিশ্বাস মিষ্টির মতো। অতিমাত্রায় ধারণ করলে, মনের ডায়াবেটিসের হতে পারে। সাবধান।’

কিযী তাহনিন : লেখক ও উন্নয়নকর্মী।
[মত-দ্বিমত বিভাগের সব মতামত লেখকের নিজস্ব]

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন