বিজ্ঞাপন

হিমালয়কন্যার দর্শনে (পর্ব-১)

June 25, 2021 | 8:58 am

মো. সুমন মিয়া

ভ্রমণপিপাসু এবং অ্যাডভেঞ্চার পছন্দ করেন এমন ব্যক্তিদের জন্য নেপাল পছন্দের একটি দেশ। হিমালয়ের পাদদেশে চীন ও ভারত বেষ্টিত নেপাল দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট দেশ। আমাদের এই গ্রহের আকর্ষণীয় ভূপ্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময়তা, যেমন— তুষারাবৃত পর্বত ও প্রায় ক্রান্তিও অরণ্য একসঙ্গে থাকার কারণে গর্ব বোধ করে নেপাল। অক্টোবর ও নভেম্বর নেপালের শুষ্ক মৌসুম। এ সময় আকাশ থাকে পরিষ্কার, আর গ্রেট হিমালয় তার অপার রূপ মাধুর্য মেলে ধরে প্রত্যাশার চেয়ে বেশি।

বিজ্ঞাপন

করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হওয়ার আগে, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২০১৯ পর্যন্ত নেপাল ট্যুরের সিদ্ধান্ত নিলাম। এটাই জীবনের প্রথম বিদেশ ট্যুর। তাই মনটা পুলকে দুলে উঠল। মোট দশ জনের গ্রুপ ট্যুর। সবার টিকেট বুকিং শেষ। বাধ সাধল আমারটায়। আমার পাসপোর্ট নবায়ন করতে দিয়েছিলাম, কিন্তু যথা সময়ে হাতে পাইনি। অবশেষে যাওয়ার মাত্র একদিন আগে পাসপোর্ট হাতে পেলাম। নির্ধারিত তারিখে পাসপোর্ট হাতে নিয়ে সোজা বিমানবন্দর চলে গেলাম। সেখানে সবাই একসঙ্গে টিকেট নিয়ে ভিতরে গেলাম।

জানালার পাশেই আমি সিট পেলাম। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে কাঠমান্ডু ত্রিভুবন বিমানবন্দর প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। যথা সময়েই আমাদের বিমান গন্তব্যের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করল। মাঝে মাঝে ক্যামেরায় ফটো উঠাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমি। যতক্ষণ বিমানে ছিলাম পুরোটা সময়ই দৃষ্টি ছিল বাইরে। ঊর্ধ্ব আকাশে মেঘের অপরূপ খেলা আর দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত গগন আমাকে প্রতি মুহূর্তে বিমোহিত করেছে। জানালা দিয়ে নিচের দিকে তাকালে ভূপৃষ্ঠকে অ্যাকুরিয়ামের তলানির মতো মনে হয়। নদী আর প্রশস্ত রাস্তাগুলো মানচিত্রে আঁকা রেখাগুলোর মতো দেখায়।

বিজ্ঞাপন

হঠাৎ চমৎকার একটি ঝাঁকুনি দিয়ে বিমান নিচে নামা শুরু করল। বুঝতে পারলাম আমরা কাঠমান্ডুতে চলে এসেছি। সিট বেল্ট আবার শক্ত করে বাঁধলাম। ধীরে ধীরে দৃষ্টি সীমানার মধ্যে পাহাড়, গাছপালা, বাড়িঘর স্পষ্ট হতে লাগল। আমরা পৌঁছে গেলাম ‘দ্যা মোস্ট ডিফিকাল্ট এয়ারপোর্ট অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’-এ। সার্কভুক্ত দেশ হওয়ার কারণে অন অ্যারাইভাল ভিসার সুবিধা পেয়ে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে লাগেজপত্র নিয়ে বাইরে চলে আসলাম।

আমাদের দেখে কয়েকজন ট্যাক্সি ড্রাইভার এগিয়ে আসলো।

-কাহা জায়গা সাব?

বিজ্ঞাপন

আমাদের অনেকে উৎসাহ ভরে হিন্দি ভাষায় কথা বলার জন্য এগিয়ে এলো। বাংলাদেশে থাকতেই আমাদের হোটেল বুক করা ছিল।

– থামেল, উম তারা হোটেল।

গুগল ম্যাপ দেখে অবস্থান বলতেই ড্রাইভার চিনে ফেললো। এই শহরের কোথায় কোন হোটেল, বার, রেস্তরাঁ ও রাস্তাঘাট আছে সবই তাদের চেনা। দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক সকল বিষয়ে তার অগাধ পাণ্ডিত্য। ইংলিশও দুই এক কথা বলতে পারে, তবে বুঝে আরও বেশি। অনেক দিনের অভিজ্ঞতা তার এই পেশায়। দেখতে দেখতে অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম।

কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে খাওয়ার উদ্দেশে বের হলাম । কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে থামেল এলাকায় খুঁজে বের করি বিসমিল্লাহ ও মোহাম্মদী নামক দুটি সুস্বাদু হালাল খাবারের হোটেল।থামেল হলো কাঠমান্ডুর পর্যটকদের প্রাণকেন্দ্র। হাজার হাজার হোটেল, সুভেনিরের দোকান, হাইকিংয়ের দোকান, রেস্টুরেন্ট, বার এখানে বসে আছে প্রাণচাঞ্চল্য কী জিনিস তার আভাস দিতে। রাস্তায় সারি সারি দোকান ও ফেরিওয়ালা নানারকমের পসরা সাজিয়ে এখানে পর্যটকদের আকৃষ্ট করার আশায় বসে থাকে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত। থামেল মার্গ হলো এলাকার প্রধান রাস্তা, যা নানা রঙের পতাকা দিয়ে সাজানো। এখানে পাওয়া যায় সিঙ্গিং বোলের আওয়াজ আর ধুপ ধুনোর গন্ধ। মান্ডালা স্ট্রিট থামেলের আরেকটি রাস্তা যা তার বইয়ের দোকান, কফি শপের জন্য বিখ্যাত। থামেল থেকে আপনি চাইলে গোর্খা ক্রয় করতে পারেন। এছাড়া চুড়ি থেকে শুরু করে সিঙ্গিং বোল, পশমিনা চাদর, মান্ডালা ওয়াল পেইন্ট ও অন্যান্য অনেক কিছু কিনতে পারেন। আমরা বিকেলের সময়টাতে বের হলাম কাছাকাছি ঘুরে সময়টা কাটানো এবং পরিচিত হওয়ার জন্য।

বিজ্ঞাপন

পরের দিন সকালে নতুন প্রোগ্রাম। হোটেল ম্যানেজার একটি টুরিস্ট গাইড হাতে দিলো। এটার মধ্যে মোটামুটি কাঠমান্ডুতে কী কী দর্শনীয় স্থান আছে তার বিস্তারিত আছে।

কাঠমান্ডুর দর্শনীয় স্থান

পশুপতিনাথ মন্দির: হিন্দুদের পবিত্র ও নামকরা মন্দিরগুলোর মধ্যে নেপালের পশুপতিনাথ মন্দির সবচেয়ে বিখ্যাত। পশুপতিনাথ গড়ে উঠেছে শিবের সেবার জন্য এবং নেপাল ছাড়াও বছরে ভারত থেকে অজস্র মানুষ এখানে শিবের পূজা করার জন্য ছুটে আসেন। এখানে দেখা পাওয়া যায় নানা প্রকৃতির সাধুদের।

স্বয়ম্ভূনাথ স্তূপ: নেপালের বিখ্যাত বৌদ্ধমন্দিরগুলোর তালিকা করলে স্বয়ম্ভূনাথ থাকবে এক থেকে তিনের মধ্যে। এটি কাঠমান্ডু শহরের পশ্চিমে পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থিত। সেখানে যেতে হলে পাড়ি দিতে হবে গুণে গুণে ৩৬৫টি পাথরের তৈরি সিঁড়ি। অবশ্য সিঁড়ি চড়ার আগেই নজর পড়বে বানরের দিকে। মন্দিরের চত্বর ও তার আশেপাশে একশর উপরে বানর বহুদিন থেকে বাস করে আসছে। এসমস্ত বানরকে নেপালিরা পবিত্র দূত মনে করে। তাদের ধারণা, বুদ্ধ দেইতি মঞ্জুশ্রির মাথার উকুন থেকে এসমস্ত বানরের জন্ম এবং তারা এখানে তার সময় থেকেই রয়েছে।

এই মন্দিরটি নেপালের প্রাচীনতম মন্দিরগুলোর একটি। পঞ্চম শতকের শুরুর দিকে এর অস্তিত্ব আবিষ্কার হয়। আশার কথা হচ্ছে ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে বলার মতো তেমন কোনো ক্ষতিই হয়নি স্থানটির। মন্দিরটি অধিকাংশ সময় প্রবল পর্যটকের ভিড়ে ভারী থাকে, তাই সকাল ৭টা থেকে ৭.৩ হলো স্বয়ম্ভূনাথ মন্দির ঘুরার জন্য সবচেয়ে ভালো সময়। মন্দিরের অংশগুলোর মধ্যে বুদ্ধ অমিদেভা পার্ক, পশ্চিমের স্তূপ বা স্তম্ভ, পূর্বের সিঁড়ি অবশ্য দ্রষ্টব্য। একটি নির্দিষ্ট ফি-এর মাধ্যমে মন্দিরটি ঘুরে দেখা যায় এবং স্থানীয় পুরোহিতকে আলাদা কিছু ফি দিলে সে আপনাকে মন্দিরের অভ্যন্তরে নিয়ে তাদের ধর্মীয় রীতিনীতিতে অংশ নেওয়া সম্পর্কে ধারণা দেয়।

বৌদ্ধনাথ স্তুপ: থামেল থেকে ৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বৌদ্ধের স্তুপা বা স্তুপ নেপাল পর্যটকদের অবশ্য দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটি। এটি এশিয়ার সবচেয়ে বড় স্তুপাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এটি এত বড় যে, অনেক দূর থেকে দেখা যায়।

কোপান মনেস্ট্রি: কোপান মনেস্ট্রি কাঠমান্ডুতে একটি লুকায়িত হীরার মতো জায়গা। এখানে তিব্বতীয় সাধুরা মেডিটেশন করতে আসেন। কোপান মনেস্ট্রি থেকে কাঠমান্ডু শহর পুরোটার ১৮০ ডিগ্রি ভিউ পাওয়া সম্ভব। আগে এই জায়গাটি সম্পর্কে খুব বেশি মানুষ জানতো না, কিন্তু বর্তমানে প্রচার লাভের পর এই স্থানটিতে বহু পর্যটক আসেন। কোপান মনেস্ট্রি স্থাপত্যকলার সৌন্দর্যের জন্য খুব সমাদৃত পর্যটকদের কাছে।

কাঠমান্ডু দরবার স্কয়ার, পাটান, ভক্তপুর: কাঠমান্ডুর প্রাচীন দিকটি থামেলের দক্ষিণে, বসন্তপুরে অবস্থিত দরবার স্কয়ারকে ঘিরে গড়ে উঠেছে। উনিশ শতক পর্যন্ত নেপালের রাজা ও তার পরিবারের সদস্যগণ এখানেই বসবাস করতেন। জায়গাটি এতটাই বনেদী এবং ঐতিহ্যের সাক্ষী যে, ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো একে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করে। রাজপ্রাসাদ ছাড়াও ১২ শতকের প্রচুর হিন্দু এবং বৌদ্ধ মন্দিরের নিদর্শন এখানে পাওয়া যায়।

দরবার স্কয়ার: থামেল থেকে মাত্র ৭০০ মিটার দূরে। এখানে প্রচুর পায়রা দেখা যায় যা আলাদা মাধুর্য যোগ করে। দরবার স্কয়ারে দেখার মতো রয়েছে সাদা ভৈরব বা সেতো ভৈরব, জগন্নাথ মন্দির, তেলেজু মন্দির, ইন্দ্রপুর মন্দির, মহেন্দ্রশ্বর মন্দির। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৫ সালের তীব্র মাত্রার ভূমিকম্পে রাজপ্রাসাদসহ মন্দিরগুলোর দক্ষিণ দিক ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবুও এর অবশিষ্ট অংশ দেখেও প্রাক্তন সৌন্দর্যের আন্দাজ করা সম্ভব। সংস্কার কাজের জন্য বর্তমানে দরবার স্কয়ারের টিকেটের মূল্য বাড়লেও সার্কের নাগরিকদের জন্য তা নাগালের মধ্যেই আছে।

পাটানে এবং ভক্তপুরে কাঠমান্ডু ভ্যালির কাছাকাছি আরও দুটি দরবার স্কয়ারের মতো ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিদর্শন রয়েছে।

গার্ডেন অব ড্রিমস: গার্ডেন অব ড্রিমস বা স্বপ্নের বাগান কাঠমান্ডুর কায়সার মহলে অবস্থিত। এটি একটি নিউ ক্লাসিক্যাল বাগান। বাগানটি তৈরি করা হয় ১৯২০ সালে এবং এর ডিজাইন বর্তমান আধুনিক সমস্ত ইউরোপীয়ান বাগানের সঙ্গে মিলে যায়। আরকিটেকচারাল ভিউ এবং গাছগাছালির সমারোহ দেখার জন্য এই জায়গাটি টুরিস্টদের আকর্ষণ করে।

সিংহ দরবার: নব্য-ধ্রুপদী, পেলেডিয়ান এবং ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর মিশেলে তৈরি সিংহ দরবার বা সিংহ প্রাসাদ কাঠমান্ডুর মধ্যাঞ্চলে অবস্থিত রাণা বংশের একটি প্রাসাদ।

আসান বাজার: আসান টোলে বা আসান বাজার হলো নেপালের তাজা শাকসবজি ও ফলের বাজার। বাড়িতে বানানো স্থানীয় পানীয় রাকশি থেকে শুরু করে নানারকম মশলা, স্থানীয় নাম না জানা ফল, সমস্ত কিছু এখানে পাওয়া যায়। এখানে কাঠমান্ডুর বাইরে থেকে রোজ কৃষকরা তাদের পণ্য বিক্রি করতে আসে। স্থানীয় পণয় ও মানুষদের কাছে থেকে দেখার জন্য আসান টোলে শহরের বাইরের সেই সুপার মার্কেটের মতো কাজ করে, যা ভ্রমণে অনন্য মাত্রা যোগ করে থাকে। এছাড়া আসান টোলের আশেপাশে অন্নপূর্ণা ও কৃষ্ণ নামে দুটি দেখার মতো মন্দির আছে। গঠন ও অবস্থানের জন এ দুটি মন্দির বিখ্যাত।

লেখক: সিনিয়র অফিসার (এডমিন) গাজী অটো টায়ার্স, গাজী গ্রুপ; সম্পাদক, চান্দিনা দর্পন

সারাবাংলা/আইই

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন