বিজ্ঞাপন

ঢালাওভাবে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ সংবিধান পরিপন্থী

July 3, 2021 | 10:35 pm

গোলাম সামাদানী, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট

ঢাকা: আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে অনৈতিক বলে অভিহিত করেছেন বিশিষ্টজনেরা। তারা বলছেন, ঢালাওভাবে ফ্ল্যাট, জমি, শেয়ারবাজার, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্রে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি। কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও বাস্তবে তা দেশের কোনো কাজে আসে না। বরং বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া দুর্নীতির পৃষ্ঠপোষকতার নামান্তর। এতে সততা, নৈতিকতা ও সংবিধান পরিপন্থি দুর্নীতিবাজরা অবৈধ অর্থ উপার্জনে আরও উৎসাহিত হয়।

বিজ্ঞাপন

গত ৩ জুন সংসদে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবনা উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তবে বাজেট প্রস্তাবনায় কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো প্রস্তাবনা ছিল না। পরে ২৯ জুন প্রস্তাবিত বাজেটে কিছু সংশোধনী এনে অর্থবিল পাস করা হয়। এই সংশোধনী অনুযায়ী ফের উচ্চ হারে কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়। একইসঙ্গে যারা নতুন বিনিয়োগ করবেন, তাদের ১০ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করে নেওয়ার সুযোগও থাকছে।
বাজেটে ফের কালো টাকা সাদা করার এই সুযোগ দেওয়াকেই অনৈতিক বলছেন অর্থনীতিবিদরা।

এ বিষয়ে অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, নীতিগত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াকে আমি কোনোভাবেই সমর্থন করি না। কারণ সুযোগ দেওয়া হলেও তা কোনো কাজে আসে না। বরং এই সুযোগ দেওয়ার মাধ্যমে কালো টাকা তৈরিতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। অনেকেই মনে করেন, আমি যেভাবে পারি টাকা উপার্জন করি। কারণ সরকার তো কোনো না কোনো সময় কালো টাকা সাদা করার করার সুযোগ দেবেই।

তিনি বলেন, আগে মাত্র ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। আগামী বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৫ শতাংশ করা হয়েছে এবং আরও ৫ শতাংশ অর্থ জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। এর মাধ্যমে কালো টাকা উপার্জনকারীদের সুযোগ কিছুটা কমানো হয়েছে। তবে আমার মতে, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ একেবারেই বন্ধ করে দেওয়া উচিত। পাশাপাশি কালো টাকা উপার্জনের সব পথও বন্ধ করতে হবে।

বিজ্ঞাপন

মির্জ্জা আজিজ বলেন, প্রতিবছরই বাজেটে কম-বেশি কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না। বরং কালো টাকা উপার্জন করতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। তাই এটা বন্ধ করা উচিত।

অন্যদিকে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর সারাবাংলাকে বলেন, বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু এই অযৌক্তিক কাজটি বারবার করা হচ্ছে। প্রতিবছরই বিভিন্ন অজুহাতে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

তিনি বলেন, ঢালাওভাবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি বাজেট ঘোষণার সময় পরিকল্পিতভাবে অর্থবিলে ঢোকানো হলো না। অর্থবিলে থাকলে এটি নিয়ে সংসদেও আলোচনা করা যেত। কিন্তু তা না করে সংসদে অর্থবিল পাসের আগে আগে এই সুযোগ দেওয়া হলো। বলা যায়, অনেকটা অগণতান্ত্রিক উপায়ে কালো টাকা সাদা করার বিষয়টি পাস করিয়ে নেওয়া হলো। প্রতিবছর এই সুযোগ দিয়ে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কালো টাকা উপার্জনকে উৎসাহিত করা হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

তিনি বলেন, এক্ষেত্রে একটি পার্থক্য রাখা উচিত। সেটি হলো— কালো টাকার মধ্যেও দুই ধরনের টাকা আছে। একটি হলো অনুপার্জিত অর্থ যা চাঁদাবাজি, কমিশনবাজি, ঘুষ, অনিয়ম দুর্নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে অর্জন করা হয়। এটি একেবারেই অনৈতিক উপার্জন। এই অর্থ সমাজকে কলুষিত করে। ফলে দুর্নীতির টাকাকে কোনোভাবেই সাদা করার সুযোগ দেওয়া উচিত না।
আহসান এইচ মনসুর বলেন, বাস্তবে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হলেও দেশের কোনো লাভ হয় না। বরং দেশের বদনাম হয় যে এই দেশটাতে কালো টাকা সাদা করা সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ সারাবাংলাকে বলেন, ঢালাওভাবে বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার পক্ষে নই। এই সুযোগ দেওয়া হলে যারা নিয়মিত ট্যাক্স দেন, তারা নিরুৎসাহিত হন। পাশাপাশি কালো টাকা সাদা করার যে নিয়ম বা পদ্ধতি রয়েছে, আমাদের দেশে তা অনুসরণ করা হয় না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিনা প্রশ্নে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার মানে হলো কালো টাকার মালিকদের আরও অবৈধ অর্থ উপার্জনের আইনিত গ্যারান্টি দেওয়া। এটি যেকোনো বিচারে নৈতিকতাবিরোধী, দুর্নীতিসহায়ক, বৈষম্যমূলক ও সংবিধান পরিপন্থি।

তিনি বলেন, কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা নিয়ে সরকার এবার রীতিমতো অশুভ চালাকির আশ্রয় নিয়েছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে বিতর্ক ও সমালোচনা এড়াতেই সুযোগটি প্রাথমিকভাবে বাজেটে কোথাও রাখা হয়নি। বিষয়টি সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় শুরু থেকেই ছিল।

টিআইবির এই নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, এভাবে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া বাজেট প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতাকেই কেবল প্রশ্নের মুখে ফেলেনি, বরং সরকারের মাঝে জবাবদিহিদতার সংস্কৃতি ক্রমেই বিলুপ্ত হওয়ার ইঙ্গিতও বহন করে। সরকারের এই পদক্ষেপ প্রধানমন্ত্রীর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ অঙ্গীকারকে পদদলিত করছে।

বিজ্ঞাপন

এর আগে, বিদায়ী ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ হারে ট্যাক্স দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ ছিল। তবে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে ২৫ শতাংশ কর এবং ওই করের ওপর আরও ৫ শতাংশ জরিমানা দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হযেছে। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২৬ দশমিক ২৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করতে হবে। এক্ষেত্রে নগদ টাকা, ব্যাংকে রাখা টাকা, সঞ্চয়পত্র কিনেও টাকা কালো টাকা সাদা করা যাবে। একইভাবে শেয়ারবাজার, জমি ও ফ্ল্যাট কিনে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রয়েছে। আজ ১ জুলাই থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত এ সুযোগ পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে কালো টাকা বিনিয়োগে কর দিতে হবে মাত্র ১০ শতাংশ। অর্থনৈতিক অঞ্চল ও হাইটেক পার্কে ১০ শতাংশ কর দিয়ে ২০২৪ সাল পর্যন্ত কালো টাকা সাদা করার বিদ্যমান সুযোগটিও অব্যাহত রাখা হয়েছে।

সারাবাংলা/জিএস/টিআর

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন