বিজ্ঞাপন

শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রস্ফুটিত গোলাপ বঙ্গবন্ধু

March 17, 2022 | 1:44 pm

তাজিন মাবুদ ইমন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা শেখ লুৎফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। মাতা সায়েরা খাতুন। এই দম্পতির চার কন্যা এবং দুই পুত্রের সংসারে বঙ্গবন্ধু ছিলেন তৃতীয় সন্তান। ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। ৯ বছর বয়সে ১৯২৯ সালে গোপালগঞ্জ পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন তিনি। এখানে ৫ বছর শিক্ষা জীবন শেষ করে ১৯৩৭ সালে গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ ইনস্টিটিউট মিশন স্কুলে সপ্তম শ্রেনীতে ভর্তি হন বঙ্গবন্ধু।

বিজ্ঞাপন

১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচ.এস.সি এবং ১৯৪৬ সালে বি.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকা আগমন অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লক্লাশে ভর্তি হন।১৯৩৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বেগম ফজিলাতুন্নেসার সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হন শেখ মুজিবুর রহমান। তাদের ২ মেয়েশেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা এবং তিন ছেলেশেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট হয় যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। যার ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতি আজ বাংলা ভাষায় কথা বলছেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিব তার ঐতিহাসিক ছয় দফা দাবী পেশ করেন যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা উল্লেখিত হয়েছিল।

১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে গণসম্বর্ধনা দেওয়া হয়। সেখানেই উত্থাপিত হয় ১১ দফা দাবি যার মধ্যে ৬ দফার সবগুলো দফাই অন্তর্ভুক্ত ছিল। লাখো মানুষের এই জমায়েতে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিব এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করে যা ইতিহাসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন বাংলাদেশ। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চরাতের অন্ধকারে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙালির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা; শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট নামে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড। অশীতিপর বৃদ্ধ থেকে কোলের শিশুকেউ রক্ষা পায়নি পাক হায়েনাদের নারকীয়তা থেকে।

১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী ধানমন্ডির বাসা থেকে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর, ৩০ লক্ষ বাঙ্গালীর প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে আসে বিজয়। ১৬ ডিসেম্বর সেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যেখান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, সেখানেই বাংলাদেশভারত মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পন করে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী। পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের নতুন একটি দেশ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মধ্যরাতে একদল বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা হত্যা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের। কেবল তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সেই সময়ে দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু একটি নাম নয়। একটি ইতিহাস। এই বাংলাদেশে দলমত নির্বিশেষে তিনি সবার শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার এক প্রস্ফুটিত গোলাপ। স্বাধীনতার পর পাকহানাদার বাহিনীর বন্দীশালা থেকে ফিরে বঙ্গবন্ধু প্রথম যে দিন স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখলেন, তিনি সেদিন তার স্বপ্নের স্বাধীন বাংলা, মাটি ও মানুষ, রক্ত ও লাশের স্তূপ দেখে নিজেকে সংবরণ করতে পারেননি; কেঁদেছিলেন। দিনটি ছিল ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি। ১টা ৪১ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। প্রিয় নেতাকে বরণ করতে আসা মানুষের মুখে মুখে প্রতিধ্বনিত হয় জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান। আকাশ বাতাসে সে শব্দ সুরের সঙ্গে যেন বলে, আমৃত্যু বাংলার মানুষেকে প্রাণ ভরে ভালোবাসা মানুষটি তোমাদের মাঝে এসে গেছে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন– ‘জয় বাংলা স্বাধীন বাংলা। বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।’ বস্তুত, এ আন্তরিক উপলব্ধি এবং বিশ্বাসই ছিল বঙ্গবন্ধুর সব কর্ম ও সাধনার কেন্দ্রীয় প্রেরণাশক্তি।

বাংলাদেশ ও বাঙালি সত্তাকে তিনি কী বিপুলভাবে ভালোবাসতেন, তা বোঝা যায় ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে তিনি যে ভাষণ দেন, তা থেকে। ওই ভাষণে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবরও খোঁড়া হয়েছিল।আমি ঠিক করেছিলাম, আমি তাদের নিকট নতি স্বীকার করব না। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। জয় বাংলা।’ এ বক্তব্য থেকেই অনুধাবন করা যায়, দেশের জন্য, বাঙালির জন্য, বাংলাভাষার জন্য বঙ্গবন্ধুর অকৃত্রিম ভালোবাসা। ১০ জানুয়ারির ভাষণে কেবল দেশপ্রেম নয়, বঙ্গবন্ধুর উদার মানবতাবোধ এবং সদর্থক বিবেচনারও পরিচয় ব্যক্ত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে দেখলেন গুদামে খাদ্য নেই, মাঠে ফসল নেই, কেন্দ্রীয় ব্যাংকে রিজার্ভ শূন্য। বস্তুত কোনো ব্যাংকের কার্যকারিতা নেই। সড়ক ও রেলপথ বিচ্ছিন্ন, নৌ ও সমুদ্রবন্দরগুলো বিধ্বস্ত। স্কুলকলেজগুলো ছিল পরিত্যক্ত সেনাছাউনি। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পরাজয় নিশ্চিত জেনে সম্ভাব্য সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছিল।মুক্তিযুদ্ধের সময় কৃষি খাত মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।যুদ্ধবিধ্বস্ত এ দেশে যাতে একজন মানুষও না খেয়ে মারা না যায়, সেজন্য নানা ব্যবস্থা নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি ভর্তুকি দিয়েছিলেন। চাষাবাদের ক্ষেত্রে নতুন যান্ত্রিক পদ্ধতি প্রবর্তনের লক্ষ্য স্থির করেন। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে কৃষকের মাঝে সার, ওষুধপত্র ও উন্নতমানের বীজ প্রদান করেন। ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। এ প্রতিষ্ঠান জাতীয় প্রয়োজনের প্রতি লক্ষ্য রেখে কৃষিবিষয়ক ইন্সটিটিউট এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর মাধ্যমে কৃষি সংক্রান্ত গবেষণা, পরিকল্পনা পরিচালনা, সমন্বয়, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন করে যাচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার উন্নয়নের অন্তরায়। তাই তখনই তিনি পরিবার পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছিলেন। দেশের ১২ থানায় জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির পাইলটিং শুরু করেছিলেন তিনি। আমরা এখন সাত শতাংশের উপরে প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলি। অথচ বঙ্গবন্ধুর সময়ই বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৮ শতাংশ। তিনি তখনই বলতেন, বাংলাদেশ চিরদিন অনুন্নত থাকতে পারে না। অচিরেই উন্নত দেশের কাতারে যাবে।এ জনসংখ্যাকে শিক্ষিত ও দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করার পরিকল্পনাও নিয়েছেন। সেজন্য তিনি জাতীয় শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। স্কুল ও কলেজগুলোকে জাতীয়করণ করেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন গঠন করেন এবং ১৯৭০ সালেই তিনি বলেছিলেন, আমাদের শিক্ষাস্বাস্থ্যে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের মেডিকেল কলেজ এবং মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলতে হবে। কারিগরি শিক্ষার দিকে জোর দিতে হবে। এছাড়া মাত্র সাড়ে তিন বছর সময়ে এদেশের প্রত্যেক মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে বিদ্যুৎ, কৃষি ও সমবায়, শিল্প ও বিজ্ঞান, গৃহনির্মাণ, অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা, শিল্প ব্যবস্থাপনা জাতীয়করণ, শিক্ষা ও সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, ভূমি ব্যবস্থাপনাসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেছিলেন তিনি। আজও এ দেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কোনো কাজ করতে গেলে আমরা দেখতে পাই হয় প্রতিষ্ঠানটি জাতির পিতা নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন, না হয় প্রতিষ্ঠানটির যে প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়জাত করা হয়েছে তার শুরুটা জাতির পিতা করে দিয়ে গেছেন। তিনি অসংখ্য নীতি, পরিকল্পনা ও আইনের উদ্যোক্তা।

বিজ্ঞাপন

বঙ্গবন্ধু আজীবন স্বপ্ন দেখেছেন ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশের। তার সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে উন্নতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছেএগিয়ে যেতে হবে আরও অনেক দূর। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে হলে, শোষণমুক্ত অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে হলে, প্রকৃত দেশপ্রেম নিয়ে সচেতনতার সঙ্গে আমাদের এগিয়ে আসতে হবে।

লেখক: শিক্ষার্থী

প্রিয় পাঠক, লিখতে পারেন আপনিও! লেখা পাঠান এই ঠিকানায় -
sarabangla.muktomot@gmail.com

মুক্তমত বিভাগে প্রকাশিত মতামত ও লেখার দায় লেখকের একান্তই নিজস্ব, এর সাথে সারাবাংলার সম্পাদকীয় নীতিমালা সম্পর্কিত নয়। সারাবাংলা ডটনেট সকল মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তবে মুক্তমতে প্রকাশিত লেখার দায় সারাবাংলার নয়।

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন