বিজ্ঞাপন

নদী ও আধুনিকতা

April 24, 2023 | 9:09 pm

সোলায়মান সুমন

তুমি কিন্তু কথা দিয়েছ এমাসেই কিনে দেবে। এরিনা টেবিলে স্বসঙ্কোচে পড়ে থাকা চিঠিটার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে কথাটা বলল।
এরিনার কথায় সামান্য বিরক্ত হয়ে সফিক পরীক্ষার খাতা দেখা বন্ধ করে দেয়। মলিন কাগজে লেখা মায়ের চিঠিটার ভাঁজ খুলে আরেকবার পড়ার চেষ্টা করে।

বিজ্ঞাপন

“বাবা সফিক,

তুই বাবা কেমন আছিস? আমরা আল্লাহর রহমতে ভাল আছি।

পরসমাচার এই যে, তোমার বাবার হাঁপানিটা একটু বাড়িয়াছে। শ্বাসকষ্টের জন্য ডাক্তার তোমার বাবাকে দুধরনের স্প্রে দিয়েছে। একটার দাম সাড়ে আটশ টাকা। অন্যটা তিনশ পঞ্চাশ। ভাল কম্পানির স্প্রেগুলোর দাম আবার আরো বেশি। তোমার আব্বার প্রতিদিন প্রায় দুশ টাকার ঔষধ খাওয়া দরকার। অতগুলান টাকা খরচ করে তুমি ঢাকায় নিয়া যাইয়া তোমার আব্বাকে ডাক্তার দেখাইলে। কিন্তু ঠিক মতো ঔষধ কিনতে না পারায় কাজের কাজ কিছুই হইতেছে না। তার উপর গতবছর কালবৈশাখী ঝড়ে আমগাছের একটি বড় ডাল চালার উপর ভাঙিয়া পড়ায় চালার টিন দাবিয়া গেছে। তুমি গতবার আসিয়া তা দেখিয়া গেছ। সেই দাবানো জায়গাটা গ্রীষ্মের রোদে ফাটিয়া চৌচির। সেখান দিয়া বৃষ্টি হইলে পানি গড়িয়া পড়ে। তুমি তো জানো স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা ঘর তোমার বাবার জন্য কতটা ক্ষতিকর।

বিজ্ঞাপন

তুমি আমার বড় ছেলে। তুমি অবশ্যই জানো যে এত দিনের সংসারজীবনে নিজের জন্য তোমার বাবার কাছে কোনোদিন কিছু চাই নাই। যা চেয়েছি তা তোমার আর তোমার ছোটবোনের জন্য। তোমার কাছে এত কথা বলিলাম কারণ পরে যেন তুমি তোমার আব্বার দেখা শোনার বিষয়ে আমাকে দোষী করিতে না পারো। তাছাড়া একমাত্র ছেলে হিসেবে তোমার এসব জানিবার অধিকার আছে।

আমার দাদু নিহাল কেমন আছে? তোমাদের দেখতে বড় ইচ্ছে করে।

ইতি,
তোমার আম্মা”

বিজ্ঞাপন

‘তোমার পরিবারের লোকজন সেকেলেই রয়ে গেল।’ ব্যালকনি থেকে তুলে আনা শুকনো কড় কড়ে কাপড়গুলো ভাঁজ করতে করতে এরিনা ফোঁড়ন কাটল। অভিমান আর বিরক্তি মাখা কণ্ঠে সফিক ফুঁসে ওঠে, ‘কেন?’ কথাটা বলেই সে আবার পরীক্ষার খাতায় ডুব দেয়।
‘এই যুগে চিঠি লেখার মতো কষ্টের কাজটা কে করে বলো?’
‘চিঠিতে নিজের মন অন্যের কাছে যতটা খোলাসা করা যায় মোবাইলে তার এককোণাও সম্ভব না।’ সফিকের উত্তরে সন্তুষ্ট না হয়ে এরিনা তার মুখে কৃত্রিম হাসি ছড়িয়ে দেয়।
সফিক তা অবশ্য দেখতে পায় না সে খাতা দেখায় ব্যস্ত।
‘কী কিছু বললে না যে? ফ্রিজ কিন্তু এ মাসেই চাই।’
‘দেখি, কী করা যায়।’
‘দেখি না। তুমি এক বছর ধরে দেখি দেখি করে চলেছ। একমাস পর কোরবানির ঈদ, আতা ভাবি বলো আর আরিফ ভাইয়ের দোকানের ফ্রিজের কথাই বল, সবার ফ্রিজ তখন নিজেদের কোরবানির মাংসে ঠাসা থাকবে, আমাকে কিছু রাখতে দেবে ভেবেছ?
সফিক প্রসঙ্গ পাল্টানোর উদ্দেশ্যে বলে, ‘তোমার ক্লাস যখন বন্ধ, আমাকে একটু সাহায্য করলেই তো পারো।’
‘হ্যাঁ, বলো, কী করতে হবে?’
‘খাতার নম্বরগুলো মার্কসিটে তুলে দাও।’
‘আচ্ছা।’ এরিনা সফিকের পাশে এসে বসে।
‘শোন কোরবানি উপলক্ষ্যে বিভিন্ন কোম্পানি ভাল ভাল অফার দিচ্ছে। কেউ কেউ ফ্রিজের সাথে ইস্তিরি ফ্রি দিচ্ছে।’
‘এক স্ত্রীর জ্বালায় বাঁচি না আবার আরেকটা।’ সফিক হেসে ফেলল
‘উম ঢং।’ এরিনা হাসতে চাইলেও মুখে ঠিক মতো হাসি ছড়ায় না।
‘সিঙ্গার কোম্পানি তিনমাস মানে নব্বই দিনের মধ্যে মূল্য পরিশোধের সুযোগ দিয়েছে।’
‘কিস্তির কথা বলছ তো। ওতে আসল দামের চেয়ে দুতিন হাজার টাকা বেশি দেওয়া লাগে।’
‘আরে না। এটা তা না। মূল টাকাটা নব্বই দিনের মধ্যে দিলেই হবে। অতিরিক্ত একটা টাকাও লাগবে না। তবে একটা ডিড করতে হয়। ওতে দুশ সত্তর টাকা খরচ পড়ে।’
‘ভালই খবর রাখো দেখছি।’ সফিক একটু হাসার চেষ্টা করে।
এরিনার নাকটা লজ্জায় সামান্য রাঙা হয়ে ওঠে। ‘মালিবাগ, খিলগাঁও, মৌচাক, বাসাবোতে যতগুলো শোরুম আছে, গত একমাস ধরে সবখানে খোঁজ খবর নিয়েছি।’
সফিককে চুপ থাকতে দেখে এরিনা পরামর্শের গলায় বলে, ‘যা বাজার কর অর্ধেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। ফ্রিজ থাকলে অনেক সাশ্রয় হয়। আর রোজ রোজ বাজার করা তোমারও তো পছন্দ না।’

মানুষের আয় তো সেভাবে বাড়ছে না। অথচ জিনিস পত্রের দাম বাড়ছেই। ঢাকায় শিক্ষকতার চাকরি করে তিনজনের সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে সফিক। এরিনা ইন্টেরিয়াল ডিজাইনের উপর কোর্স করছে। প্রতিদিনের ক্লাস আর রান্না নিয়ে তার নাজেহাল অবস্থা। ফ্রিজটা আসলে খুবই জরুরি হয়ে পড়েছে। ঈদ বোনাস আর খাতা দেখার কিছু টাকা পাবে সে। ব্যাংকেও কিছু টাকা আছে। তা দিয়ে একটা ফ্রিজ ঘরে আনবে ভেবেছিল সফিক, কিন্তু বাড়িতেও টাকা পাঠানো দরকার। বাবা অসুস্থ, সে জানে মায়ের শরীরিক অবস্থাও ভাল না।
এরিনা সফিকের গলা ধরে গালে মৃদু চুমু খায়। ‘এবার কিন্তু কোনো অজুহাত চলবে না।’

কলেজ শিক্ষক সফিক এক দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায়। যদি বাড়িতে টাকা পাঠায় তবে এ বছর আর ফ্রিজ কেনার সম্ভাবনা সে দেখছে না। আর ফ্রিজ কিনলে বাড়িতে টাকা পাঠানো সম্ভব হবে না।

সফিকের মনে পড়ে, যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তার বাবা একটা একটা করে পয়সা জমিয়ে মানি অর্ডার করত। পরীক্ষা, শিক্ষাসফরসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে যখন অতিরিক্ত টাকার প্রয়োজন হতো তার জোগাড় দিতে গিয়ে বাড়িতে সারামাস মাছ-মাংস আসতো না। বাবা এখন অসুস্থ। সারাটা বছর হাঁপানিতে কষ্ট পায়। নদীর ঘাটে টোল ওঠানোর ব্যবসা আর করতে পারে না। সফিকের মনে আছে, মাঝে মধ্যে সে বাবার সাথে ঘাটে বেড়াতে যেত। কোনো সন্ধ্যায় হয়ত সে বাবার হাতে ভর দিয়ে চাঁদের রূপালি আলোয় নদীর বুকে ভেসে যাওয়া দূরের ছোট্ট নৌকাগুলো দেখছে অথবা ওতে জ্বলে থাকা হারিকেনের কমলা আলো নিয়ে নানা রাজ্যের কল্পনা করছে। এমন সময় হঠাৎ যদি নদীর ফুরফুরে ঠাণ্ডা বাতাস এসে শরীর শীতল করে দিত। বাবা খুশী গলায় বলতেন, ‘দেখলি বাবা, কেমন বেহেস্তি বাতাস। নদীঘাটের মতো এরকম সুখের ব্যবসা আর নাই। কত মানুষের সাথে পরিচয় হয়। যত মানুষ তত তাদের গল্প। তত তাদের সুখ দুঃখ। নদী এপারের গল্পকে ওপারে বয়ে নিয়ে যায়। ওপারের গল্প নিয়ে আসে এপারে।’
‘বাবা আমিও বড় হয়ে এই ব্যবসা করব।’
বাবা হাসতেন, ‘তোকে অনেক বড় হতে হবে। কিন্তু বড় হয়ে নদীর মানুষগুলোকে ভুলে যাসনে। আর ভুলে যাসনে নিজেকে।’
বাবার ওসব হাবি জাবি কথায় মানে তখন কিছুই বুঝত না সফিক। এখনও-কি বোঝে?
বাবা আর তার প্রিয় মহানন্দার রূপালি পাড়ে যায় না। গেলে নদীর ঠাণ্ডা বাতাসে শ্বাস কষ্টটা আরো বেড়ে যায়। বাবার বুকের মধ্যে থেকে এখন অনবরত ঘড় ঘড় শব্দ বের হয়। কথা বললে কথার সাথে শাঁ শাঁ একটা শব্দ শোনা যায়।

বিজ্ঞাপন

শেষ পর্যন্ত বাড়িতে বহু আকাঙ্খিত ফ্রিজ আসে। কালারটা বেশ পছন্দ হয় সফিকের। এরিনা হাসি মুখে ব্লাউজের কাল্পনিক কলার নাচিয়ে বলে, ‘হে হে, বুঝতে হবে তো কালারটা কার চয়েস করা।’ তবে একটা বিষয় নিয়ে ওরা কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারে না, আসলে এটা কী রঙ? অনেক আলোচনা ও চিন্তুা-ভাবনার পর এরিনা বলে, ‘এটা ওয়াটার কালার।’
সফিক হেসে বলে, ‘হতে পারে তবে নদীর পানির মতো রঙটা একটু কালচে। তাহলে এ রঙের নাম দেওয়া যাক রিভার কালার।’
রঙের নামটা এরিনার বেশ পছন্দ হয়। নামটার মধ্যে একটা ফ্যান্টাসি আছে। সে মুচকি হাসি দিয়ে ওটা সাদরে গ্রহণ করে নেয়। আসলে রঙের নামটা বড় কথা নয়। রঙটা যে দুজনার পছন্দ হয়েছে এটাই বড় কথা। ওরা মুগ্ধ দৃষ্টিতে বাড়ির নতুন সদস্যটির দিকে তাকিয়ে থাকে। ঠিক এমন সময় ওদের ছেলে নিহাল বায়না ধরে, এই ফ্রিজে ওকে এখনই আইসক্রিম করে দিতে হবে। এরিনা যত বুঝায়, সন্ধ্যায় আইসক্রিম খেলে ঠাণ্ডা লাগবে। গলা ব্যথা হবে, ততোই তার জেদ বেড়ে যায়। সে খুনখুনে কান্না শুরু করে। দোকান থেকে এনে দেওয়া আইসক্রিমে ওর চলবে না। ঐ ফ্রিজেই বানাতে হবে।

‘কী মুশকিল!’ এরিনা ভীষণ বিরক্ত হয়। অন্যদিন হলে হয়ত নিহাল মায়ের হাতের থাপ্পড় খেত। ‘এখন আমি কীভাবে আইসক্রিম বানাব? আইসক্রিমের জন্য আইস পাউডার লাগে, দুধ লাগে, ওসব তো বাড়িতে নেই।’
সফিক একটা শট কাট সমাধান বের করে। ‘তুমি এক কাজ করতে পারো। ট্যাং দিয়ে আইসক্রিম বানিয়ে দিতে পারো। আইসক্রিম উইথ অরেঞ্জ ফ্লেবার।’

সেদিন রাতে বাবার ঘড় ঘড় কাশির শব্দে সফিকের ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে সে ভাবে হয়তো কোনো স্বপ্ন দেখেছে। কিন্তু চোখ দুটো আবার লেগে আসলে ঘড়ঘড় কাশির শব্দটা পুনরায় শুনতে পায়। চমকে উঠে সে বিছানায় বসে পড়ে। আশ্চর্য ব্যাপার। সে তো ঢাকায়, বাবা তো গ্রামে। সে বিছানা ছেড়ে শব্দটার উৎস খুঁজতে খুঁজতে ডাইনিং রুমের দিকে যায়। ডাইনিং এ ফ্রিজটার কাছে গেলে সে বুঝতে পারে বাবার কাশির ঘড় ঘড় শব্দটা ওটার ভেতর থেকেই আসছে। সফিক ফ্রিজের পাল্লা খুলে উৎসুক দৃষ্টিতে ভেতরটার এদিক ওদিক খুঁটিয়ে খঁটিয়ে দেখতে থাকে।

এরিনা দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে প্রথম থেকেই সফিকের কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করছিল। এবার সে হাসি সামলাতে না পেরে খিল খিল করে হেসে ওঠে। ‘বোকা! ওটা ফ্রিজের শব্দ। সব ফ্রিজেই থেমে থেমে এমন শব্দ করে। এত পড়াশোনার পরও তুমি সেই সেকেলে থেকে গেলে। আধুনিক আর হতে পারলে না।’

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন