বিজ্ঞাপন

ব্রিকস-কোয়াড: লাভ ও লোভের রসায়ন

June 19, 2023 | 2:27 pm

মোস্তফা কামাল

কাউকে বাদ দিয়ে বা কাউকে কাছে নিয়ে নিজের মতো ভালো থাকার একটা চিকন পথ একসময় ছিল। এখন একদম নেই। আবার সবার সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগোবার পথও রুদ্ধ। বিশ্বতাপ ও চাপের এ কঠিন সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের অভিভাবকত্বে চলা কোয়াড আর রাশিয়া-চিনের যুগলবন্দি ব্রিকস কারো জন্য আপদের। কারো জন্য বিপদের। যার যার সুবিধা মতো একটিতে একাকার না হয়ে থাকার অবস্থা নেই।

বিজ্ঞাপন

অবাধ ও মুক্ত ভারতীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল গঠনের উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে গঠন করা কোয়াডে যেতে আহ্বান পর্বের পর বাংলাদেশের ওপর চাপ অনেক দিনের। আবার না যাওয়ার চাপও ব্যাপক। এ পক্ষ বাংলাদেশকে চায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকার সংগঠন ব্রিকসে। কোন জোটে গেলে কী লাভ-কী ক্ষতি? দু’দিক থেকেই এ সংক্রান্ত বুঝ বা কানপড়া অন্তহীন। কোয়াডে গেলে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক হবে ‘যথেষ্ট খারাপ’ চীন এ ভয় দিয়ে রেখেছে বহু আগেই। আবার কোয়াডে গেলে বাংলাদেশকে লাভের লোভ যুক্তরাষ্ট্র অবিরাম দিয়েই আসছে। লাভ-লোভ আর ভয়ের এ রসায়নে হালনাগাদ খবর ব্রিকসের দিকেই এগোচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ শিগগিরই আঞ্চলিক এ অর্থনৈতিক জোট -ব্রিকসের সদস্যপদলাভের বার্তা দিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন৷ সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠক নিয়ে ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের তথ্যটি জানান তিনি। কথার নড়চড় না হলে এক মাস বাদে আমাদের শোকের মাস আগস্টে ব্রিকসে অভিষেক ঘটবে বাংলাদেশের।

ব্রিকস উদীয়মান অর্থনীতির পাঁচটি দেশ– ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার প্রথম অক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা একটি জোট। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগে এটি ‘ব্রিক’ নামে পরিচিত ছিল। পরে হয় ব্রিকস। ব্রিকসের ৫ম সদস্য দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকের পর দ্রুত বর্ধনশীল দেশগুলোর আর্থিক জোটটিতে সংযুক্তির ইঙ্গিত মিলেছে। আগামীতে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইন্দোনেশিয়াসহ প্রায় আটটি দেশ এই জোটে শামিল হওয়ার আভাসও রয়েছে। সব মিলিয়ে আরও ১৯টি জোটটিতে যোগদানে আগ্রহী বলে ব্রিকস বিষয়ক বিশেষ দূত অনিল সুকলালের বরাতে জানিয়েছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গ। ব্রিকস আরও সম্প্রসারিত হলে অর্থনীতির নতুন দিগন্ত উন্মোচনে সম্ভাবনা দেখার জানিয়েছেন জোটের নেতারা। সেই হিসাব-নিকাশ বাংলাদেশেরও।

সাম্প্রতিক কেপটাউনে সম্মেলনে বিশ্বে ‘নতুন ভারসাম্য’ প্রতিষ্ঠার ডাক দিয়েছেন ব্রিকস দেশগুলোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। তারা ব্রিকসকে দেখছেন শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট ‘জি-সেভেন’-এর বিকল্প হিসেবে। এখন পর্যন্ত ব্রিকস দেশগুলোর জনসংখ্যা ৩২০ কোটিরও বেশি – যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। কেপটাউনে সম্মেলনের প্রথম দিনে বাংলাদেশের প্রতিবেশি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শংকরের বক্তব্যে ছোট ছোট, কিন্তু কঠিন কিছু বার্তা রয়েছে। বর্তমান বিশ্ব বহু-মেরুভিত্তিক, এখানে নতুন ভারসাম্য তৈরি হচ্ছে এবং পুরোনো পথে নতুন পরিস্থিতির মোকাবিলা করা যাবে না বলে মত দিয়েছেন তিনি।

বিজ্ঞাপন

ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাউরো ভিয়েরার কথার মর্মও একই। তিনি বলেছেন, ‘বহু-মেরুভিত্তিক এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্রিকস অপরিহার্য’। যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজনের প্রতিফলন ঘটাবে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ, চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মা ঝাওশুর উপলব্ধিও এমনই। তাদের শক্ত অবস্থান কোয়াডের বিরুদ্ধে। যার পুরো নাম কোয়াড্রিলেটারাল সিকিউরিটি ডায়ালগ। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরে নৌ চলাচল ‘অবাধ ও স্বাধীন’ রাখার উপায় খোঁজার যুক্তিতে ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের মধ্যে এর সূচনা। আর ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড-ওবোর’ বাস্তবায়ন করে এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের ৭০টি দেশের সঙ্গে সড়ক, নৌ ও রেল সংযোগ করতে চাওয়া চীনের দাবি ঠিক এর উল্টো। তারা বলছে, কোয়াড নিজেকে অর্থনৈতিক কাজে সম্পৃক্ত বলে দাবি করলেও এটি একটি সামরিক জোট এবং এটা করাই হয়েছে চীনের বিরোধিতার জন্য। কোয়াড প্রশ্নে চীন আর প্রচ্ছন্ন নয়, প্রকাশ্য হুমকিই দিয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে। ঢাকায় নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং কোয়াডকে একটি ক্লাব মন্তব্য করে আগাম বলে রেখেছেন, ‘ চার সদস্যের এ ক্লাবে গেলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে না। চলমান বিশ্ব উত্তেজনায়ও ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়’ নীতি অনুসরণ করছে বাংলাদেশ। কিন্তু, বাস্তবে কোনো না কোনো দিকে যেতেই হচ্ছে। আবার বিশ্বে শত্রু-মিত্রের সংজ্ঞাও পাল্টে দিয়েছে নতুন বিশ্বায়ন।

বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে ভূ-রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশ একটি বড় ফ্যাক্টর। সেই আলোকে বাংলাদেশকে অনেক সমীকরণ মেলাতে হচ্ছে। বাস্তবতা দৃষ্টে মালয়েশিয়া, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলংকা, নেপালসহ অনেক দেশ চীনমুখী হয়ে পড়ছে। সেখানে বাংলাদেশকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া বেশির চেয়েও বেশি পর্যায়ে। ভারত সেখানে অতিমাত্রায় কৌশলী। ব্রিকস-কোয়াডের আড়ালে বিশ্ব অর্থনীতির হিসাবের খাতায় মার্কিন ডলার একটি বড় সাবজেক্ট। তা সরাসরি না বলে আশপাশে নানা উপাদান যোগ করা হচ্ছে। চীন-রাশিয়া মিলে মার্কিন ডলারের আধিপত্য চ্যালেঞ্জ করতে চায়। বিশ্ব বাণিজ্যে সবচেয়ে বেশি লেনদেন হয় ডলারে। বর্তমান বিশ্বে ব্যাংকগুলোর মোট রিজার্ভের ৭০ শতাংশই রয়েছে ডলারের দখলে। বিশ্বজুড়ে বৈদেশিক বাণিজ্যের লেনদেনে ডলার প্রধান মুদ্রা হলেও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন এক পরিস্থিতির ইঙ্গিত দিচ্ছে। বিশ্ব মুদ্রাবাজারে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব দেশে দেশে। অনেক দেশ আন্তর্জাতিক লেনদেনে ডলারের বিকল্প হিসাবে নিজেদের মুদ্রা ব্যবহার করার চেষ্টা করে কুলাতে পারছে না। এরপরও চেষ্টার কমতি নেই। ইউক্রেনে হামলা করার জেরে পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করার পর থেকেই তারা ঘোষণা করেছে, গ্যাস বা তেল বিক্রির অর্থ এখন থেকে রুবলে পরিশোধ করতে হবে। এর ফলে বিনিময় মূল্য কমে যাওয়ার বদলে বরং আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে রুবল। চীন, ভারত ও তুরস্কের মতো বড় অর্থনীতির দেশ রাশিয়া থেকে রুবলে তেল ও গ্যাস কিনছে। এমনকি ইউরোপীয় দেশগুলোও রুবলে রাশিয়াকে অর্থ পরিশোধ করতে বাধ্য হচ্ছে। সৌদি আরব থেকে ইউয়ান ব্যবহার করে তেল কেনার বিষয়ে আলোচনা করছে চীন। এর মধ্যেই তারা ফ্রান্সের টোটাল এনার্জির সঙ্গে ইউয়ানে লেনদেন শুরু করেছে।

গত মার্চে ব্রাজিল ও চীনের করা চুক্তির বলে দু’দেশের বাণিজ্যের লেনদেন নিষ্পত্তিতে পরস্পরের মুদ্রা ব্যবহার করা হবে। ইরান, ভেনেজুয়েলা ও রাশিয়ার মতো দেশগুলোয় পণ্য বিনিময়ে ২০১৮ সালে সাংহাই ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এক্সচেঞ্জ স্থাপন করেছে চীন, যেখানে তারা রেনমিনবি বা আরএনবিতে লেনদেন করছে। সামনে ব্রিকসের যে সম্মেলনেও ডলারের বিকল্প মুদ্রায় লেনদেনের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে। কেবল কোয়াড-ব্রিকস নয়, লাভ-লোভ মেলানো আঞ্চলিক ও স্থানিক জোট আরো প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার পেছনে এটিও বড় কারণ।

বিজ্ঞাপন

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; ডেপুটি হেড অব নিউজ, বাংলাভিশন

সারাবাংলা/এসবিডিই

Tags: , , ,

বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন
বিজ্ঞাপন